যানজট নিরসনে পাগলা মলম

যানজট নিরসনে পাগলা মলম

বিশেষজ্ঞরা অনেক সময় নীতিনির্ধারকদের বিভিন্ন ধরনের কথা বলে বিভ্রান্ত করেন এবং তারা সব প্রকল্পে থাকেন আবার কোথাও ভুল হলে তৃতীয় পক্ষ হয়ে এমনভাবে পরামর্শ দেন যেন এই বিষয়টি আজকেই প্রকাশিত হলো।

হেলাল সাহেব বাসের জানালার পাশে বসে রোদ আর গরমে দরদর করে ঘামছেন আর জ্ঞানী জ্ঞানী চেহারার এক হকারের পাগলা মলমের কার্যকারিতা শুনছেন। প্রায় ২০ মিনিট বাস এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সকাল ৭.৩০মিনিট মহাখালীর বাসা থেকে বের হয়েও তিনি বেশিরভাগ দিন ৯ টার মধ্যে মতিঝিলের অফিসে পৌঁছেতে পারেন না আর আজ মগবাজার মোড়েই প্রায় ১০টা।

আর কত আগে তিনি বাসা থেকে বের হবেন সেট ভেবে পান না। ডাক্তার বলে দিয়েছেন ৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে যদি উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হয় কিন্তু অফিস থেকে ফেরার সময়ও একই যানজট পার হয়ে বাসায় পৌঁছে অন্যান্য কাজ শেষ করে তিনি যখন ঘুমাতে আসেন তখন পরেরদিনের অফিসের জন্য বের হতে তার হাতে সময় থাকে ৬ ঘণ্টারও কম।

তিনি ভেবে পান না আর কীভাবে তিনি টাইম ম্যানেজমেন্ট করবেন। বরং প্রায় প্রতিদিনের অফিসের দেরি আর বাসে ওঠার এই প্রতিযোগিতার কথা চিন্তা করলেই তিনি অসুস্থ অনুভব করেন। আজকাল কানেও কিছুটা কম শুনছেন আর অল্পতেই বিরক্ত হয়ে যাচ্ছেন কেন যেন। তার প্রায় মনে হয় যানজট থেকে হয়তো ঢাকা শহর আর মুক্তি পাবে না।

পত্রিকায় পড়লেন যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষজ্ঞদের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। হেলাল সাহেবের কেন যেন মনে হয় আমাদের বিশেষজ্ঞরা অনেক সময় নীতিনির্ধারকদের বিভিন্ন ধরনের কথা বলে বিভ্রান্ত করেন এবং তারা সব প্রকল্পে থাকেন আবার কোথাও ভুল হলে তৃতীয় পক্ষ হয়ে এমনভাবে পরামর্শ দেন যেন এই বিষয়টি আজকেই প্রকাশিত হলো।

তার খুব জানতে ইচ্ছা করে, যে বিশেষজ্ঞরা যানজট সমাধান করবেন তারা শেষ কবে তার মতো করে বাসে চড়েছেন, শেষ কবে তার মতো অফিসের ব্যাগ আর বাজারের ব্যাগ নিয়ে রিকশা বা বাস খুঁজতে গিয়ে প্রায় ২ কিলোমিটার গরমে হেঁটেছেন বা ঐ বিশেষজ্ঞরা শেষ কবে তার মতো বাসে ওঠার জন্য আরও অনেকের সাথে ইঁদুর দৌড় দিয়েছেন।

এসি রুমে বসে সব সমস্যার সমাধান হয় না। সিস্টেম বুঝতে গেলে সেই সিস্টেমের অংশ হতে হয়। সমস্যার কথা বইতে পড়ে বা অন্য কারও মুখে জেনে দূর থেকে দেখে যতটা উপলব্ধি করা যায় তার চেয়ে বেশি উপলব্ধি হয় যখন সমস্যা নিজের ঘাড়ে এসে পড়ে। তখন সেটাকে সমাধান করার একটা তাড়া থাকে।

বিশেষজ্ঞরা অনেক সময় নীতিনির্ধারকদের বিভিন্ন ধরনের কথা বলে বিভ্রান্ত করেন এবং তারা সব প্রকল্পে থাকেন আবার কোথাও ভুল হলে তৃতীয় পক্ষ হয়ে এমনভাবে পরামর্শ দেন যেন এই বিষয়টি আজকেই প্রকাশিত হলো।

আজ পর্যন্ত যানজট নিরসনে যতগুলো প্রচেষ্টা হয়েছে সবগুলোয় তো অনেক বিশেষজ্ঞ ছিলেন তাহলে কেন সমাধান হলো না সেটা জানা দরকার। তাদের কথা কি কেউ শুনছে না, নাকি অন্য কিছু? হেলাল সাহেবের মতো যারা প্রতিদিন যানজটে বসে ৫/৬ ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন তাদের এই অভিজ্ঞতা কয়টা প্রকল্পে কেউ জানতে চেয়েছে?

আজ যে চালক বাস নিয়ে যানজটে বসে আছে সে জানে কখন, কোথায়, কীভাবে যানজট হয়, যে মালিক যানজটের কারণে পরিবহন ব্যবসায় লাভ করতে পারছে না সেও জানে কী করলে সে আরও ভালো পরিবহন সেবা দিতে পারবে। যে ছোট গাড়িতে ৪ জনের জায়গায় মাত্র ২ জন বসে আছে সে কেন বাসে উঠছে না এটা তার চেয়ে ভালো আর কে জানে। কিন্তু কয়টা প্রকল্পে গোঁড়ার সমস্যা আমরা জানতে চেয়েছি?

ছুটির দিনে হেলাল সাহেব অনেকটা পথ হেঁটে বাজারে যান, কিন্তু ফুটপাত থাকলেও তিনি হাঁটতে পারেন না সেখানে, কারণ ফুটপাতে এত বেশি হকার আর ভাঙাচোরা যে তিনি একটু পর রাস্তায় নেমে যান। রাস্তায় নেমেও সস্তি নেই কারণ এক লেন দখল হয়ে থাকে ইচ্ছামতো পার্কিং-এ। এখন এই ফুটপাত থেকে হকার সরাতে হবে বা পার্কিং বন্ধ করতে হবে এটা সবাই জানে কিন্তু তাহলে সরছে না কেন?

তিনি যে হকারের কাছ থেকে একটু কম দামে সবজি নেন তাকে ফুটপাতে বসার জন্য দৈনিক ২০০ টাকা দিতে হয় চাঁদা। এই চাঁদা নাকি সবার কাছে যায়, আবার পার্কিং থেকেও নাকি টাকা তোলা হয়। তাহলে এই চাঁদাবাজি বন্ধ না করলে এই সমস্যা কীভাবে সমাধান হবে?

আরেকটা কথা তিনি প্রায় শোনেন যে, বাসগুলো শৃঙ্খলায় আনতে হবে। গণমাধ্যমে জেনেছেন যে, এ ধরনের একটা ব্যাপার নাকি পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছিল কিন্তু কিছুদিন পর ভেস্তে গেছে। তিনি বুঝতে পারেন না যে, একটা সিস্টেম পৃথিবীর সব দেশে ভালো ফলাফল দিচ্ছে কিন্তু সেটা বাংলাদেশে কেন থমকে যাচ্ছে?

তিনি একদিন অফিসের বাসের চালকে সেলিমের সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছেন। সেলিমের মতে, আগে বাস চলাচলের পরিবেশ দিতে হবে। অল্প শিক্ষিত সেলিম বিশেষজ্ঞদের মতো কঠিন টার্ম ছাড়াই তার মতো করে যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে, একজন মালিক কেন বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজিতে আসবে, যদি সে দেখে যে সেই রুটে এই সিস্টেমের বাইরেও বাস চলাচল করছে, তার সামনে রিকশা, সিএনজি এসে পড়ছে আর বাস স্টপেজগুলো ঠিকঠাক মতো নেই।

ফুটপাত থেকে হকার সরাতে হবে বা পার্কিং বন্ধ করতে হবে এটা সবাই জানে কিন্তু সরছে না কেন?

যদি অন্তত একটা লেন থাকত বাসের জন্য, যদি কয়েকটা রাস্তা থেকে রিকশাকে সরানো যেত, যদি বাস স্টপেজ থাকত আর সবাইকে মানতে বাধ্য করা যেত, যদি একটা কোম্পানি ছাড়া বাকি সব বাস তুলে নেওয়া হতো তাহলে মানুষ দেখত যে বাস তার লেন দিয়ে চলে যাচ্ছে আর বাকিরা অন্য লেনগুলোয় বসে আছে। আর তখন অনেকেই তার ছোট গাড়ি রেখে তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য বাসে চড়ত।

মানুষের চাহিদা বেড়ে গেলে ভালো বিনিয়োগকারী আসবে, বাসের মান বাড়বে, চালকের জীবনমান বাড়বে এবং টেকসই ব্যবস্থা পাওয়া যাবে। কিন্তু সেলিমের ধারণা এটা আসলে হবে না কারণ, কোম্পানিভিত্তিক বাস চালু করলে অনেক জানা-অজানা লেনদেন নাকি বন্ধ হয়ে যাবে, তাই ইচ্ছাকৃত ভাবেই অনেকেই চাইবে এই প্রচেষ্টা সফল না হোক।

সেলিম খুব একটা আশা দেখে না কারণ এইসব জানা-অজানা লেনদেন আর চাঁদাবাজির কথা সবাই জানে কিন্তু বন্ধ করার জন্য শক্ত কোনো কথা বা কাজ দেখা যাচ্ছে না। এসব বইয়ের বাইরে থাকা সমস্যার সমাধান না করে বিশেষজ্ঞদের কাজ করতে দিলে দিন শেষে সবাই একটা প্রকল্প পাবে, সবার লাভ হবে, আর থেকে যাবে যানজট।

হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচিতে হেলাল সাহেবের সংবিৎ আসলো, সামনের যাত্রীর মোবাইল ফোন একজন জানালা দিয়ে নিয়ে দৌড় দিয়েছে। সেটা নিয়ে বিশাল হইচই আর ইতিমধ্যে মলম বিক্রেতাও নেমে অন্য বাসে চলে গেছে।

হেলাল সাহেব বুঝতে পারল, যানজট আছে বলেই কেউ পাগলা মলম বিক্রি করতে পারে আর কেউ চুরি করে যেতে পারে। এ কারণেই মনে হয় অনেকেই চায় যানজট থাকুক।

কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ।। সহকারী অধ্যাপক, এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *