সাবেক অধিনায়ক তো বটেই, জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের মধ্যেও প্রথম বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ। দেশের নেতৃত্বে পালাবদলের রেশ ধরে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ফারুক আহমেদ বিসিবির নির্বাচিত সভাপতি হয়েছেন। অথচ সভাপতি হওয়া ফারুকের এক সময় নির্বাচন করারই যোগ্যতা ছিল না।
সাবেক অধিনায়ক তো বটেই, জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের মধ্যেও প্রথম বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ। দেশের নেতৃত্বে পালাবদলের রেশ ধরে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ফারুক আহমেদ বিসিবির নির্বাচিত সভাপতি হয়েছেন। অথচ সভাপতি হওয়া ফারুকের এক সময় নির্বাচন করারই যোগ্যতা ছিল না।
বিসিবির গঠনতন্ত্রের ‘সি’ ক্যাটাগরিতে কাউন্সিলরশিপের ব্যাখা রয়েছে ৯.৩ অনুচ্ছেদে। সেখানে ৯.৩.১–৯.৩.৯ পর্যন্ত কাউন্সিলরদের যোগ্যতা নির্ধারিত। এই ক্যাটাগরিতে একটি পরিচালক পদের জন্য গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ৯.৩.১–৯.৩.৬ পর্যন্ত কাউন্সিলরগণ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন। ৯.৩.৭–৯.৩.৯ ধারায় থাকা কাউন্সিলরগণ নির্বাচন করতে পারেন না। বিসিবি সভাপতি মনোনীত পাঁচ সাবেক অধিনায়করাও ৯.৩.৮ ধারায় পড়েছেন। সাধারণত বাংলাদেশের ক্রীড়া ফেডারেশনের নির্বাচনে কাউন্সিলরশিপ থাকলে ভোটাধিকার প্রয়োগ ও প্রার্থী হওয়া যায়। বিসিবির সি ক্যাটাগরিতে পাঁচ সাবেক অধিনায়কের পাশাপাশি আম্পায়ার্স এসোসিয়েশন (৯.৩.৭) ক্রিকেটারদের সংস্থার প্রতিনিধিও (৯.৩.৯) নির্বাচন করতে পারেন না।
সি ক্যাটাগরিতে সাবেক অধিনায়ক হিসেবে কাউন্সিলর রকিবুল হাসান। তিনি সাবেক অধিনায়কদের নির্বাচন অধিকার হরণ নিয়ে বলেন, ‘ভোট দেওয়ার যোগ্যতা থাকলে সে ভোটে প্রার্থীও হওয়ার অধিকার রাখে। এটা একেবারেই ফান্ডমেন্টাল রাইটস। সর্বত্রই একই নিয়ম ও চর্চা। আমাদের ক্রিকেট বোর্ডে নেই, এটা নিয়ে আমি এজিএমেও কথা বলেছি। দুঃখজনক হচ্ছে বলার পরও কোনো প্রতিকার হয়নি।’ চলতি সাধারণ পরিষদে রকিবুল হাসান, শফিকুল হক হীরা, ফারুক আহমেদ, হাবিবুল বাশার সুমন ও মিনহাজুল আবেদীন নান্নু সাবেক অধিনায়ক কোটায় কাউন্সিলর। এদের মধ্যে শুধু রকিবুল হাসানই এই বিষয়ে সোচ্চার ভূমিকা রাখেন। নান্নু ও সুমন বিসিবির চাকরি করেন, ফলে প্রতিবন্ধকতার মধ্যে থাকতে হয় তাদের।
নাজমুল হাসান পাপনের আমলে গঠনতন্ত্র তিনবার সংশোধন হয়েছে। কখনও পরিচালকের সংখ্যা কম-বেশি, কখনও কাউন্সিলর কমানো-বাড়ানো এমনকি ব্যবসা করার অনুমতির জন্য এজিএম হলেও, সাবেক অধিনায়কদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকেছে। উপেক্ষিত না সুকৌশলে এড়ানো– এটা নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ রয়েছে। সি ক্যাটাগরিতে ৯.৩.৩ ধারায় রয়েছে, বিসিবি সাবেক জাতীয় ও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের মধ্যে থেকে দশজনকে মনোনীত করবে। গত তিন নির্বাচনে সি ক্যাটাগরি থেকে নির্বাচিত পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজন। তিনিও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক। তাকে বিসিবি সভাপতি জাতীয় দলের অধিনায়ক কোটায় মনোনয়ন না দিয়ে বিসিবি থেকে দশজন সাবেক জাতীয় ও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার কোটায় কাউন্সিলরশিপ প্রদান করেন।
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদকে নাজমুল হাসান পাপন পাঁচজন সাবেক অধিনায়ক কোটায় কাউন্সিলর দিয়েছেন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সকল কাউন্সিলরদের মধ্যে থেকে ২ জনকে পরিচালক মনোনয়ন করতে পারে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ক্যাটাগরির পরিচালক জালাল ইউনুস ও আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববির পরিবর্তে নাজমুল আবেদীন ফাহিম ও ফারুক আহমেদ পরিচালক মনোনীত হন। নাজমুল আবেদীন ফাহিম বিকেএসপির কাউন্সিলর হয়ে সি ক্যাটাগরিতে নির্বাচন করেছিলেন। তিনি বিকেএসপিতে না থাকায় তার কাউন্সিলরশিপ ছিল না। তাই জালাল ইউনুস পদত্যাগ করায় এনএসসি তাকে প্রথমে কাউন্সিলর দিয়ে পরে পরিচালক মনোনয়ন করেছে। একদিনের মধ্যেই মনোনীত পরিচালক ফারুক সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ২ পরিচালক বাদে অন্য তিন ক্যাটাগরিতে পরিচালক পদে আনুষ্ঠানিক নির্বাচন হয়। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ২ পরিচালক সরাসরি মনোনীত। নির্বাচনের কোনো আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে যেতে হয়নি।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি সরকার মনোনীত। ২০১৩ সাল থেকে বিসিবি নির্বাচিত সভাপতি প্রক্রিয়া চালু করে। ২০১৩ সালে পাপন প্রথম নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে আখ্যায়িত হলেও, তিনিও ফারুকের প্রক্রিয়াতেই সভাপতি হয়েছিলেন। আবাহনী লিমিটেডের কাউন্সিলর হলেও ক্লাব ক্যাটাগরিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কোটায় পরিচালক হন এবং পরিচালকদের সভায় সভাপতি। প্রথমে মনোনীত ও পরে নির্বাচিত হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ নির্বাচিত সভাপতি বলা একটু কষ্টসাধ্যই। ২০১৭ ও ২১ সালে অবশ্য পাপন ক্লাব ক্যাটাগরি থেকে নির্বাচিত পরিচালক হয়েই এসেছেন। ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের ধারণা, ২০১৩ সালে প্রথম নির্বাচনে বিনা বাধায় সভাপতি হওয়ার জন্য পাপন এই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন।
বর্তমান গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচন দ্বি-স্তর। প্রথমে সকলকে পরিচালক হিসেবে নির্বাচন করতে হয়। পরবর্তীতে পরিচালকদের মধ্যে থেকে সভাপতি ও সহ-সভাপতি নির্বাচন। পরিচালকদের নির্বাচন সম্পূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা হলেও সভাপতি নির্বাচন একেবারেই অনানুষ্ঠানিক। পরিচালনা পর্ষদের সভায় একজন প্রস্তাব ও আরেকজন সমর্থনের ভিত্তিতে এবং অন্যরা কণ্ঠভোটে সম্মত হলেই সভাপতি নির্বাচিত হন।
গঠনতন্ত্রে সহ-সভাপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে আলাদা একটি উপধারা থাকলেও সভাপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু নেই। নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্যে শুধু রয়েছে– ‘‘সভাপতিকে অবশ্যই পরিচালক হতে হবে এবং পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক নির্বাচিত হবেন।’’ নির্বাচনের কথা বললেও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ নেই। ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চারবার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছে মূলত আনুষ্ঠানিক মনোনয়ন পত্র জমা-প্রদান ছাড়াই। ২০১৩ সালে দুই সহ-সভাপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্য আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করেছিল বিসিবি। আ জ ম নাসির, মাহবুব আনাম ও নজীব আহমেদ প্রার্থী ছিলেন, পরবর্তীতে নজীব আহমেদ প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেন। ২০১৭ ও ২০২১ সালে বিসিবি সহ-সভাপতি নির্বাচন দেয়নি।
সভাপতি একটি সংগঠনের প্রধান পদ। সেটা কাউন্সিলরদের ভোটেই সরাসরি নির্বাচিত না হয়ে পরিচালকদের মাধ্যমে হচ্ছে। এই বিষয়ে বিসিবির কাউন্সিলর দেবব্রত পাল বলেন, ‘সভাপতি নির্বাচনের অধিকারও কাউন্সিলরদের থাকা উচিৎ। বিদ্যমান গঠনতন্ত্রে অবশ্য সেই সুযোগ নেই। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নতুন সভাপতি (ফারুক আহমেদ) সম্পূর্ণ বৈধ প্রক্রিয়াতেই এসেছেন। ফারুক ভাই সভাপতি হওয়ার পরপরই গঠনতন্ত্রের সংশোধনের বিষয়ে বলেছেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সাবেক অধিনায়ক, আম্পায়ার্স ও ক্রিকেট সংস্থার প্রতিনিধির নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার না থাকাটা খুবই দুঃখজনক। সাবেক অধিনায়ক রকিবুল ভাই ও আমি এ নিয়ে এজিএমে কথা বলেছি।’
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা আইসিসিকে উদ্ধৃতি করে সরকারি হস্তক্ষেপ-মুক্তের বুলি আওড়ান। অথচ তাদের গঠনতন্ত্রেই সরকারি হস্তক্ষেপ অনুমোদিত। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সরকারি প্রতিষ্ঠান। সেই সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পাঁচজন কাউন্সিলর প্রদান ও সকল কাউন্সিলরদের মধ্যে থেকে ২ জন পরিচালক মনোনয়নের বিধান রয়েছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মনোনীত পরিচালক পরবর্তীতে সভাপতি নির্বাচিত হলেও মূলত সরকারি ব্যবস্থাতেই প্রবেশ। যেমনটা ২০১৩ সালে পাপন হয়েছিলেন। বিসিবির গঠনতন্ত্রে পরিচালকদের পদত্যাগ, অপসারণ ও শূন্যতা পূরণ স্ব স্ব ক্যাটাগরির নির্বাচন প্রক্রিয়ার মতোই হবে। মনোনীত পরিচালকের পরিবর্তন নিয়ে সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। সাধারণ দৃষ্টিতে, যে প্রতিষ্ঠান সরাসরি মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, সেই প্রতিষ্ঠান মনোনয়ন বাতিল ও পুনরায় দেয়ারও কথা। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সেটাই করেছে।
একমাত্র ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সরকারি কোনো অন্তর্ভূক্তি নেই। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ফুটবল ফেডারেশনের নন ভোটিং ডেলিগেট এবং অন্য সকল ফেডারেশনে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ২ জন সদস্য নির্বাহী কমিটিতে মনোনয়ন দেওয়ার এখতিয়ার রাখলেও, ফুটবল ফেডারেশনে নেই।
বিসিবির অনেক কিছুই প্রশ্নসাপেক্ষ, তেমনি গঠনতন্ত্রের কিছু বিষয়ও। ফুটবল, ক্রিকেট বাদে দেশের অন্য সকল ফেডারেশন মূলত সাধারণ সম্পাদক নির্ভর। তাই প্রতি ফেডারেশনের নির্বাচনে সর্বশেষ নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাউন্সিলরশিপ পান। এর পেছনে দুটি কারণ– প্রথমত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি যেন নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারেন এবং পরবর্তী নির্বাচনে জেলা-ক্লাবের কাউন্সিলরশিপ মুখাপেক্ষী না হয়ে নির্বাচন করার অধিকারও যেন থাকে।
বিসিবি সভাপতি নির্বাচিত বললেও সভাপতিকে কোনো সংস্থার কাউন্সিলর হয়েই আবার আসতে হয়। ফলে সভাপতিত্বের জায়গায় নিরপেক্ষতার প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। যেটা পাপনের ক্ষেত্রে উঠেছে আবাহনীর শিরোপা নিয়ে। পাপন শুধু আবাহনীর কাউন্সিলরই নন, ক্রিকেট কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলেন। বিসিবি সভাপতি সেই নির্বাচিত ৫ জন সাবেক অধিনায়ককে কাউন্সিলরশিপ প্রদান করছেন। সাবেক অধিনায়করা সাধারণত সংশ্লিষ্ট খেলা ও ফেডারেশনের কর্মকাণ্ড নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা ও মন্তব্য দিয়ে থাকেন। বিসিবি সভাপতির মাধ্যমে মনোনয়ন আসলে সেই অধিনায়করা বিসিবি প্রধানের সমালোচনা কতটুকু করতে পারেন সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। গঠনতন্ত্রে বিসিবি বা বোর্ড দশজন সাবেক খেলোয়াড়কে কাউন্সিলর দেয়, বোর্ড বললেও প্রধান হিসেবে সভাপতির অনুমতি বা ইচ্ছা-অনিচ্ছা নির্ভর করে। সি ক্যাটাগরির ৪২ কাউন্সিলরের মধ্যে ১৫ জনই বিসিবি সভাপতির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হয়। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ৫ জন কাউন্সিলর মনোনয়নের ক্ষেত্রেও বিসিবির প্রভাব থাকে।
বিসিবির গঠনতন্ত্রের দুর্বলতা আগেভাগেই বুঝতে পেরেছেন নতুন সভাপতি ফারুক আহমেদ। তাই আগামী বছর অক্টোবরে নির্বাচনের আগেই এতে হাত দিতে চান তিনি। গঠনতন্ত্র অনুমোদনের ক্ষেত্র বার্ষিক সাধারণ সভা। পাপন-মল্লিকের জমানা এখন শেষের পর্যায়ে থাকলেও অধিকাংশ ক্লাব কাউন্সিলররা মল্লিকের অনুগত। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ জেলা-বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা ভেঙে দেওয়ায় বিসিবির কাউন্সিলরশিপ নিয়েও সংকট তৈরি হবে। সাধারণত সাধারণ পরিষদের মেয়াদ ৪ বছর। এখন স্থানীয় ক্রীড়া প্রশাসনে রদবদল হওয়ায় বিসিবির কাউন্সিলরশিপে পরিবর্তন হওয়া সময়ের অপেক্ষা যেন!
এজেড/এএইচএস