থিয়েটারে রাজনীতি কতটা স্পর্শকাতর?

থিয়েটারে রাজনীতি কতটা স্পর্শকাতর?

ন্যাশনাল থিয়েটার একটা আলাদা প্রতিষ্ঠান। সেখানে একজন প্রধান থাকবেন। একে আলাদা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বুঝতে হবে ন্যাশনাল থিয়েটার মানে কিন্তু একটা ভবন নয়, ন্যাশনাল থিয়েটারে পরিচালনা পর্ষদ থাকবে…

পৃথিবীর সব দেশের থিয়েটারে রাজনীতি বিদ্যমান। সে অর্থে থিয়েটার ও রাজনীতি, থিয়েটার অথবা রাজনীতি যে ভাবেই এই দুটি শব্দকে পাশাপাশি রাখি না কেন, দুই শব্দের সম্পর্ক খুব পুরোনো, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।

প্রথমে একটা উদাহরণ দিয়ে যদি শুরু করি, সফোক্লিসের ‘ঈদিপাস’ নাটকের বিষয়বস্তুতে রাজনীতির প্রভাব কতটুকু তা পাঠ করলেই বোঝা যায় গ্রিক ট্র্যাজেডিতে নায়ক-নায়িকাদের লড়াই শুধু দৈবের বিরুদ্ধে নয়। কেবলমাত্র নিয়তির কারণেই ‘ঈদিপাস’ ধ্বংস ও বিপর্যয়ের মধ্যে গিয়ে পড়েনি।

থিবাই নগরীর সংকট, নতুন নায়ক নির্বাচনের সংকট, সত্য অনুসন্ধানে ঈদিপাসের তীব্র অভিপ্সা। এক অন্ধ মেষ পালকের অতীত উন্মোচন, রানির ভাই ক্রিয়নের ক্রমবর্ধমান দাপট, এইসব ব্যাপার ব্যক্তির সংকটকে বহু পরিমাণে নিয়ন্ত্রিত করে। রাজা ও রানী সংকট  আক্রান্ত হবেন অথবা রাজ্য থাকবে অক্রান্ত তা কি হয়? পৃথিবীর সব রাজ্য সংকটের রূপ একই রূপে বর্ণিত।

বাংলাদেশের থিয়েটারে রাজনীতি প্রসঙ্গটি যারপরনাই স্পর্শকাতর। বিশেষ করে সমসাময়িক বিশ্বে রাজনীতি বস্তুটি যখন তার মৌলিক চরিত্র খুইয়ে দারুণভাবে বিতর্কিত হয়ে ওঠে তখন বাংলাদেশের দিকে একবার সাদা চোখে দেখেন, দেখবেন দেশের জনমানুষের প্রতিটি স্তরেই রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

নাট্যচর্চা এখন আর বিনোদনের বিষয় নয়। এর সামাজিক দায়বদ্ধতা বহুগুণে বেড়ে গেছে। আর সে কারণেই নাট্যকর্মীদের মাঝে রাজনীতি ব্যাপারটি একটি অবিশ্লেষণ যোগ্য অস্বস্তির সূচনা করেছে। অস্বস্তিটি রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার থেকেই উঠে আসছে মূলত। এখানে একটা কথা পরিষ্কার করে বলা যেতেই পারে যে—এই জনজীবনে যেকোনো পরিবেশ সচেতন মানুষের মতো নাট্যকর্মীরাও বিশ্বাস করে গণতন্ত্র বা মানুষের বাঁচার মৌলিক অধিকার, চলাফেরা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানব সভ্যতার ইত্যাকার জরুরি অনুষঙ্গের বহুল পরীক্ষিত সূতিকাগারই রাজনীতি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই রাজনীতি ছদ্মবেশ ধারণ ও এর অপ্রয়োগ নাট্যাঙ্গনেও প্রভাব ফেলেছে বৈকি। তবে অস্বীকার করার কোনো পথ নেই—মানবজীবনের কোনো কিছুই রাজনীতির প্রভাবের বাইরে নয়। সেই ক্ষেত্রে অবশ্যই রাজনীতিরও ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

ন্যাশনাল থিয়েটার একটা আলাদা প্রতিষ্ঠান। সেখানে একজন প্রধান থাকবেন। একে আলাদা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বুঝতে হবে ন্যাশনাল থিয়েটার মানে কিন্তু একটা ভবন নয়, ন্যাশনাল থিয়েটারে পরিচালনা পর্ষদ থাকবে…

যদি রাজনীতি বৃহত্তর জনকল্যাণমুখী হয় নাট্য অঙ্গনের প্রতিটি মানুষ সে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা উচিত। কিন্তু যদি হয় নিছক দলীয় ও গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার তাহলে তাকে বর্জন করে কল্যাণমুখী রাজনীতি নির্মাণের সহযোগী হওয়া উচিত।

আমাদের দেশে দ্বিতীয় ধারাটি চলছে। আমরা জানি নাট্যচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন নামে একটি সংগঠন জন্মলাভ করে। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় যেসব আমলাতান্ত্রিক, সামাজিক ও  আর্থিক বাধা দূর করা। নতুন প্রজন্মকে নাট্য শিক্ষায় গড়ে তুলবে জনরুচিকে চেতনা ও মননে পরিশীলিত করবে আরও অনেককিছুই।

বেশ ভালোই চলছিল ফেডারেশন। আন্দোলন, প্রতিবাদ, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্যভাষণে যেন নতুন পাওয়া। কিন্তু যখনই ফেডারেশনের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই, পদ-পদবীর লড়াই শুরু হয়ে গেল তখন থেকে থিয়েটার হারিয়ে গেল। এটা হচ্ছে থিয়েটারের রাজনীতি।

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন—নাট্যকর্মী, সংস্কৃতিকর্মীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। নাট্যকর্মীরা ফেডারেশনের থেকে হতাশ হয়ে সুস্থ ও জীবন জীবিকার জন্য হাত বাড়িয়ে ছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির দিকে।

বাংলাদেশের সংস্কৃতির ধারক বাহক বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। যদিও ফেডারেশনের আন্দোলনের মুখে শিল্পকলা একাডেমির প্রস্তাবনায় সরকার তৈরি করল ‘জাতীয়  নাট্যশালা’।

এই নাট্যশালার লক্ষ্য ছিল—ক) নাট্যচর্চার সার্বিক উন্নয়ন প্রসার ও বিকাশ; খ) যথাযথভাবে নাট্যচর্চার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করা; গ) মঞ্চায়ন উপযোগী যথার্থ থিয়েটার হল নির্মাণের মাধ্যমে নাট্যকর্মীদের জন্য নাট্যচর্চার বস্তুগত সুবিধা নিশ্চিতকরণ; ঘ) বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠী ও নাট্যকর্মীদের নাট্যচর্চায় অধিকতর উৎসাহ প্রদান; ঙ) নাট্যশিল্পীদের ক্রমান্বয়ে অন্যতম জীবিকাশ্রয়ী পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাসহ বাংলাদেশের নাট্য প্রযোজনার সম্মুখে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণ।

‘ক-ঙ’ পর্যন্ত তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশে নবনির্মিত ন্যাশনাল থিয়েটার থেকে এমন কাজ করবে তার থেকে ‘ক-গ’ বাদ দিয়ে ‘ঙ’ নম্বরটা নিয়েই যদি শুধু বলা যায়—আজ যে জাতীয় নাট্যশালা বা ন্যাশনাল থিয়েটার আমরা দেখতে পাচ্ছি তার অবকাঠামো কিন্তু নেই। তার পরিচালনা পর্ষদ, যা হওয়ার কথা বা উচিত তার কোনোটাই হয়নি।

ন্যাশনাল থিয়েটার শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা বিভাগের অন্তর্ভুক্তি করে পরিচালিত হচ্ছে ন্যাশনাল থিয়েটার যা জাতির জন্য লজ্জাজনক। জীবিকাশ্রয়ী পেশা হিসেবে কাজ করা তো দূরের কথা। একটা জাতীয় নাট্যশালা বা ন্যাশনাল থিয়েটারের রূপরেখাই নেই। আজ যদি ন্যাশনাল থিয়েটার স্বতন্ত্র থাকতো তবে পাল্টে যেত নাটকের দৃশ্য।

বর্তমানে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ডক্টর সৈয়দ জামিল আহমেদ তিনি আপাদমস্তক একজন থিয়েটারের মানুষ। যার হাত দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগ খোলা হয়েছে।

ন্যাশনাল থিয়েটার একটা আলাদা প্রতিষ্ঠান। সেখানে একজন প্রধান থাকবেন। একে আলাদা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বুঝতে হবে ন্যাশনাল থিয়েটার মানে কিন্তু একটা ভবন নয়, ন্যাশনাল থিয়েটারে পরিচালনা পর্ষদ থাকবে, সেখানে দুই বছরের জন্য জনবল নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। নির্দেশক থাকবে (পূর্ণকালীন নাও হতে পারে) কিন্তু কলাকুশলী পূর্ণকালীন থাকবে।

তাদের তিনটি গ্রেডের ভিত্তিতে সম্মানী প্রদান করা হবে। তবেই না সত্যিকার অর্থে অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক তাদের জীবিকা নির্বাহের জায়গা তৈরি হবে।

তবে আমরা এ বিষয় নিয়ে বর্তমানে আশাবাদী। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ডক্টর সৈয়দ জামিল আহমেদ তিনি আপাদমস্তক একজন থিয়েটারের মানুষ। যার হাত দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগ খোলা হয়েছে।

আমরা আশা করতেই পারি তার হাত ধরে জাতীয় নাট্যশালা স্বতন্ত্র হবে এবং রেপার্টরি দল তৈরি হবে। বিশ্বমানের নাটক তৈরি হবে। নাটককে ভালোবেসে এখনো মঞ্চে কাজ করে যাচ্ছে তাদের জীবিকা নির্ভরের জায়গাটা তৈরি হবে।

৬৪ জেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে শিল্পকলা একাডেমির অফিস আছে, সেখানে সঠিকভাবে পরিচালনা করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জীবন জীবিকা হতে পারে। গড়ে উঠতে পারে সাংস্কৃতিক আন্দোলন। একটি জাতিকে বিশ্ব চিনতে পারে তার সংস্কৃতি দেখে। একটি দেশে যখন থিয়েটার, নাটক, গান, নাচ বিস্তার করবে তখন এই দেশ মৌলবাদ থেকে রেহাই পাবে। এটাই হওয়া উচিত সংস্কৃতির রাজনীতি।

ড. আরিফ হায়দার ।। অধ্যাপক, নাট্যকলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *