জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবহীন অর্থনীতির স্বরূপ সন্ধান

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবহীন অর্থনীতির স্বরূপ সন্ধান

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষিখাত যতটা অবদান রাখছে তার এক-তৃতীয়াংশই হারিয়ে যাবে। অর্থাৎ বাংলাদেশে কৃষিখাতের অবদান ১২ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে অবস্থান করছে, যেটি আসন্ন বছরগুলোয় কমে ৮ থেকে ১০ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আর্থিক যে ক্ষতি হচ্ছে তার পরিমাণ নেহায়েত কম নয়। ধারণা করা হয়, প্রতি বছর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ১.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়। এই ক্ষতি আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে ৩.১ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গবেষণায় সম্পদ, স্থাপনা, মানুষের স্বাস্থ্য ও কৃষিখাতের ক্ষয়ক্ষতির ওপর ভিত্তি করেই এই হিসাব করা হয়েছে।

২০০১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ১৬৩টি দুর্যোগের ওপর ভিত্তি করে সম্পন্ন করা গবেষণায় তুলনামূলকভাবে দরিদ্র দেশগুলো এই ক্ষয়ক্ষতির প্রধান ভুক্তভোগী বলে মনে করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন করা যেতেই পারে যে, কী হতো যদি বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের শিকার না হতো? দেশটির অর্থনীতিতে কি আদৌ কোনো ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হতো? উত্তর খুঁজতে গেলে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের স্বরূপ বুঝতে হবে।

ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয় কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িঘর মেরামত করতে। উপকূলীয় অঞ্চলে মাথাপিছু ৬৬৮০ টাকা প্রতি বছর একটি পরিবারকে শুধু তাদের বাসস্থান মেরামতের জন্য ব্যয় করতে হয়।

উপকূলীয় অঞ্চলে সাড়ে ছয় হাজার পরিবারের ওপর পরিচালিত এই সমীক্ষায় আরও উঠে এসেছে, পরিবারগুলো এই অর্থ ভিন্ন কোনো উৎস থেকে নয়; বরং তাদের মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকে ঝুঁকিতে ফেলে ব্যবস্থা করে। এই কারণে দারিদ্র্যের দুষ্টু চক্র থেকে মুক্তি পাওয়া তাদের ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রভাব কেবল তাদের ব্যক্তি পর্যায়েই নয়; বরং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থেকে মুক্তির পথে একটি অন্তরায় হয়ে রয়েছে।

যে অঞ্চলগুলোয় বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের প্রচলন সবচেয়ে বেশি সে অঞ্চলগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এই অঞ্চলসমূহ জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক জেলাগুলো উপকূলীয় এলাকায় বিদ্যমান। আর তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব সরাসরি গিয়ে এই জেলাগুলোর ওপরে পতিত হচ্ছে। 

এতদঞ্চলের জনগোষ্ঠীদের যেসব কারণে ক্ষুদ্রঋণের ওপর নির্ভর করতে হয় তার মধ্যে অন্যতম জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব। মাথায় রাখতে হবে যে, দুর্যোগে যেসব ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয় সে সবকিছু সংস্কারের জন্যই এই ঋণ গ্রহণ করা হয়। তাই এ থেকে মুনাফা করা বা কোনো অর্থনৈতিক কাজে এই ঋণ কাজে লাগানোর কোনো উপায় থাকে না। এভাবে এসব অঞ্চলে তারা প্রায়শই দারিদ্র্যের কশাঘাতে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই মানুষগুলো নিজেদের সহায়-সম্বল হারিয়ে অর্থনীতিকে সচল রেখে নিজের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যমে জিডিপিতে অবদান রাখার পরিবর্তে রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

অন্যদিকে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-এর তথ্য অনুসারে, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা থেকে ৭৮৬ জন লোক চাকরির জন্য ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে, যা আগের বছরে ৪৭৭ জন ছিল এবং এটি স্পষ্টতই দ্রুত বর্ধিষ্ণু তথা মাত্র ২২ মাসের মধ্যে ৬৫ শতাংশ। প্রত্যাবর্তনকারী অভিবাসী কর্মীদের অভিজ্ঞতা ও সাক্ষ্যগুলো প্রকাশ করেছে যে, তাদের মধ্যে ৮১ শতাংশকে গন্তব্য দেশগুলোয় তাদের আগমনের সময় কাজের অনুমতি দেওয়া হয়নি।

প্রবাসে পাড়ি জমানোর পরে এভাবে প্রতারণা ও হয়রানির শিকার হয়ে শ্রমিকরা যখন আবার পুনরায় দেশে ফিরে আসে তখন তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে। তখন তাদের কাছে বাংলাদেশের জিডিপিতে অবদান রাখা তো দূরের কথা নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হিমশিম খেতে হয়। অথচ এই লোকগুলো যদি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের শিকার না হতো তবে হয়তো নিজ নিজ আবাসস্থলে একটি টেকসই উপার্জনের ব্যবস্থা করে তুলতে পারতো।

অর্থনীতিতে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব ছাড়াও আরও নানান পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর সহায়-সম্বল হারিয়ে বড় বড় শহরে পাড়ি জমানো ও ঘনবসতি সৃষ্টি করা। ধারণা করা হয় যে, ২০৫০ সাল অবধি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলবায়ু অভিবাসী সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এই শহরগুলোয় জনসংখ্যা ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে যানজটের মতো আরও নানা সমস্যা সৃষ্টি করে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ১০ বছরে রাজধানীতে গাড়ির গতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে কমে ৭ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। আগামী ২০৩৫ সালের মধ্যে যানজটে গাড়ির গতিসীমা ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে। যদি এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে, তাহলে দিনে ৫ মিলিয়ন ঘণ্টা কর্মক্ষমতা অপচয় হওয়ার তীব্র আশঙ্কা রয়েছে এবং অর্থনৈতিকভাবে বছরে প্রায় ১১ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যুক্ত হতো।

এছাড়া তারা নিজ নিজ অঞ্চলের নিজেদের জীবিকা চলমান রাখলে স্থানীয়ভাবে বাংলাদেশের মোট জিডিপিতে একটি টেকসই প্রবাহ বজায় থাকতো। মাথাপিছু একজন প্রান্তিক কৃষক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, বাংলাদেশে তা নির্ণয় করা বেশ দুষ্কর। 

বাংলাদেশে এই সংক্রান্ত উপাত্তের মারাত্মক সংকটও রয়েছে। তবে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষিখাত যতটা অবদান রাখছে তার এক-তৃতীয়াংশই হারিয়ে যাবে। অর্থাৎ বাংলাদেশে কৃষিখাতের অবদান ১২ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে অবস্থান করছে, যেটি আসন্ন বছরগুলোয় কমে ৮ থেকে ১০ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সাধারণত গাণিতিক নিয়ম কাজে লাগিয়ে আমরা দেখতে পাই, শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে আসন্ন বছরগুলোয় ৪৯.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কম আসবে। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব না থাকলে আমাদের পূর্ণাঙ্গ জিডিপিতে অন্তত এই পরিমাণ বা এর চেয়েও বেশি অর্থ যোগ হতো।

এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চাষযোগ্য জমির পরিমাপও আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে। সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস (সিইজিআইএস)-এর ২০২৩ সালের প্রকাশিত তথ্য বলছে, ২২ বছরে পদ্মা ও যমুনা নদীর ভাঙনে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। বিলীন হয়েছে ৫০ হাজার হেক্টর জমি, যা সেন্টমার্টিন দ্বীপের চেয়ে ছয় গুণ বড়। এই জমিগুলোয় যদি স্বাভাবিকভাবে চাষাবাদ চলমান থাকতো তবে অর্থনীতিতে অবশ্যই ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি বজায় থাকতো।

এ সংকট থেকে উত্তরণের পথ বেশি জটিল। বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো সামাল দিতে সক্ষম। জলবায়ু বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে হয়তো এই সমস্যা কিছুটা লাঘব হতো। বর্তমানে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো মোকাবিলা করার জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তার মাত্র ১২ ভাগের এক ভাগ অর্থই দেশটি আন্তর্জাতিক তহবিলসমূহ থেকে সংগ্রহ করে থাকে।

এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর দিকে চেয়ে থেকে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা খুব একটা সমীচীন হবে না। তার চেয়ে বরং নিজ প্রযুক্তি, অভিজ্ঞান সহনশীলতা, জলবায়ু অভিবাসন ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রবাসে শ্রমিক প্রেরণ ও তাদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থাসহ আরও কিছু অভ্যন্তরীণ নীতিমালা শক্তিশালীকরণ ও তার বাস্তবায়নই হতে পারে উত্তরণের কার্যকর পথ।

ড. এ কে এম মাহমুদুল হক ।। অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *