চাঁদপুর ঘাটে নেই সরাসরি ইলিশ রপ্তানিকারক, বিদেশ যাচ্ছে হাত ঘুরে

চাঁদপুর ঘাটে নেই সরাসরি ইলিশ রপ্তানিকারক, বিদেশ যাচ্ছে হাত ঘুরে

চাঁদপুর জেলা সুস্বাদু ইলিশ মাছের জন্য বিখ্যাত। তাই এ জেলাকে ‘ইলিশের বাড়ি’ বলা হয়। মেঘনাপাড়ের জনগোষ্ঠীর কাছে একটি বড় গর্বের জায়গা দখল করে আছে দেশের জাতীয় মাছটি। দেশবিদেশের মানুষের কাছে ইলিশের জন্যই বেশি পরিচিতি লাভ করেছে চাঁদপুর জেলা। আর এর স্মৃতিসরূপ জেলার বাসস্ট্যান্ড এবং স্টেডিয়ামের সামনে সড়কের মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে ইলিশ চত্বর নামে ভাস্কর্য।

চাঁদপুর জেলা সুস্বাদু ইলিশ মাছের জন্য বিখ্যাত। তাই এ জেলাকে ‘ইলিশের বাড়ি’ বলা হয়। মেঘনাপাড়ের জনগোষ্ঠীর কাছে একটি বড় গর্বের জায়গা দখল করে আছে দেশের জাতীয় মাছটি। দেশবিদেশের মানুষের কাছে ইলিশের জন্যই বেশি পরিচিতি লাভ করেছে চাঁদপুর জেলা। আর এর স্মৃতিসরূপ জেলার বাসস্ট্যান্ড এবং স্টেডিয়ামের সামনে সড়কের মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে ইলিশ চত্বর নামে ভাস্কর্য।

জেলা শহরের বড় স্টেশন এলাকায় দেশের বৃহত্তম ইলিশ ঘাট অবস্থিত। এ ঘাটে বিভিন্ন স্থান থেকে মাছ আসে। তারপর সেই মাছ পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন জেলায়। একসময় চাঁদপুর থেকে বিদেশেও সরাসরি ইলিশ রপ্তানি হতো। ইলিশ খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন চাঁদপুরবাসী। কিন্তু বর্তমানে চাঁদপুরের ইলিশের বাজারে আর কোনো রপ্তানিকারক নেই বলে জানিয়েছেন জেলার ইলিশ ব্যবসায়ীরা।

এদিকে ব্যবসায়ীদের দাবি, ঘাটে ইলিশ সরবরাহ কম এবং ভারতে রপ্তানি শুরু হওয়ায় পর দাম আরও বেড়েছে। আকাশ ছোঁয়া দামে অনেক ক্রেতার কাছেই ইলিশের স্বাদ নেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতি লিমিটেড সূত্রে জানা গেছে, একসময় চাঁদপুরে ৫-৬ জনের ইলিশের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ছিল। তবে ১৪-১৫ বছর আগে তৎকালীন সরকার ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করে। এরপর থেকে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো আর তাদের লাইসেন্স নবায়ন করেনি। ওই সময় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন মালেক খন্দকার, আনোয়ার গাজী, দেলোয়ার হোসেন খান, সেকান্দর আলী ও মিজানুর রহমান ভূঁইয়া কালু। চাঁদপুরে দিনের পর দিন ইলিশ সরবরাহ কমে যাওয়া, রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো লাইসেন্স নবায়ন না করা এবং নতুন করে কেউ লাইসেন্স না নেওয়ায় জেলায় এখন আর কোনো ইলিশ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানই নেই।

তবে আনোয়ার হোসেন গাজী, দেলোয়ার হোসেন খানসহ কয়েকজন ব্যবসায়ী দেশের অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে ইলিশ বিক্রি করছেন। এসব রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আবার ভারতে ইলিশ পাঠাচ্ছে। সরাসরি না হয়ে এভাবেই এখন হাত বদলে চাঁদপুরের ইলিশ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে চাঁদপুর থেকে যে-সব থেকে ইলিশ ভারতে দেওয়া হতো, সেগুলোও জেলার বাইরের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাঠানো হতো বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

ভারতে ইলিশ রপ্তানি হবে সরকারের এমব ঘোষণার পর জেলা থেকে প্রায় ২০০ মণ ইলিশ বিদেশে পাঠানো হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার পদ্মা-মেঘনার ইলিশসহ বঙ্গোপসাগর, দক্ষিণাঞ্চলের ভোলা, বরিশাল, নোয়াখালী, সন্দীপ ও বরগুনা থেকে চাঁদপুর মাছ ঘাটে ট্রাকে ও ট্রলারে ইলিশ মাছ আসে। এদিকে ঢাকা, শরিয়তপুর, কুমিল্লা, বগুড়া, যশোর, শেরপুর, জামালপুর, দিনাজপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিরাজগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলসহ দেশে বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ী ও সাধারণ ক্রেতারা পাইকারি ও খুচরা দরে সেখান থেকে ইলিশ কেনেন।

চাঁদপুর থেকে ট্রেনে করে ইলিশ পরিবহন বন্ধ হয়ে আছে প্রায় এক দশক ধরে। এর ফলে সড়ক পথে ইলিশ পরিবহনে বেশি খরচ বহন করতে হচ্ছে আড়ত ব্যবসায়ীদের। চাঁদপুর থেকে একসময় দেশের সিলেট ও ময়মনসিংহসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে ট্রেনে ইলিশ পৌঁছানো হতো। ২০১৩ সাল থেকে ইঞ্জিন সংকট এবং ওয়াগনের কারণে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। এখন বিকল্প হিসেবে ট্রাক ও ট্রলিতে ইলিশ পরিবহন করতে গিয়ে খরচ বেশি গুনছেন ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ে চাঁদপুরের স্টেশন মাস্টার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

চাঁদপুর জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলায় মাছের চাহিদা ছিল ৬৮ হাজার ৪৬৬ টন। সেবার উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার টন। একই অর্থবছরে শুধু ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে ৩৪ হাজার ৩২৬ টন।

চাঁদপুর মাছ ঘাটে ইলিশ ক্রেতা আবু সফিয়ান বলেন, আমি কুমিল্লা থেকে এখানে এসেছি ইলিশ কিনতে এসেছি। কিন্তু কুমিল্লার চেয়েও এখানে মাছের দাম অনেক বেশি। তাই খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে।

আরেক ক্রেতা আব্দুর রহিম বলেন, এখানে মাছের দাম অনেক চড়া। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ইলিশ কেনার সামর্থ্য নেই। তাই খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে।

চাঁদপুর মাছ ঘাটে আসা জেলে শুক্কুর আলী, সিরাজ মিয়া বলেন, পদ্মা-মেঘনার নদীতে আগের মতো ইলিশ পাই না। যে পরিমাণ মাছ পাই তা দিয়ে তেল ও নৌকার খরচ চলে না। গতবারের মতো এবার নদীতে মাছ নেই।

শরীয়তপুর থেকে আসা চাঁদপুর মাছ ঘাটে পাইকারি ইলিশ ক্রেতা জামাল বলেন, আমরা সব সময় শরীয়তপুর থেকে চাঁদপুর এসে পাইকারিতে ইলিশ কিনে আমাদের স্থানীয় বাজারে বিক্রি করি। গত বছর এ ঘাটে অনেক মাছ আসতো, দাম কম ছিল। আমাদের স্থানীয় বাজারে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয়ে যেতো। তবে এবার এখানে মাছ খুবই কম, দামও চড়া। ঘাটে মাছ কম থাকায় এখন দুই-তিন দিন পর পর এখানে মাছ কিনতে আসি।

চাঁদপুর মাছ ঘাটের ইলিশ ব্যবসায়ী নবীর হোসন বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় চাঁদপুর ঘাটে ইলিশ কম আসছে। তাছাড়া ভারতে ইলিশ রপ্তানির কারণে মাছের দাম বেশি। প্রতি কেজিতে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দাম বেড়েছে। তবে ঘাটে যদি আগের মতো ইলিশ আমদানি হতো তাহলে ভারতে ইলিশ রপ্তানিতে মাছের দামে প্রভাব পড়তো না।

ইলিশ আড়তদার নূরে আলম বলেন, আমরা সরাসরি ইলিশ বিদেশে রপ্তানি করি না। এখানে কিছু বড় বড় কোম্পানি এসে ইলিশ কিনে নিয়ে যায়। তারা ভারতে ইলিশ রপ্তানি করে। এ কারণে মাছের দাম বেড়েছে। প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।

আরেক আড়তদার আবুল কালাম বলেন, এক সময় ট্রেনে করে চাঁদপুর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইলিশ সরবরাহ করা হতো। কিন্তু এখন সেই সুবিধা বন্ধ আছে। যদি সেটি আবার চালু করা হয় তাহলে ব্যবসায়ীদের অনেক ভালো হতো। গাড়ি ভাড়াতে খরচ কমে ইলিশের দামও কম রাখা সম্ভব হতো।

ইলিশ ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান ভূইয়া কালু বলেন, এক সময় আমাদের মধ্যে অনেকের বিদেশে ইলিশ রপ্তানির জন্য লাইসেন্স ছিল। ওয়ান ইলেভেনের সময় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। তখন থেকে আর কেউ লাইসেন্স নবায়ন করেনি। এখন হঠাৎ করে সরকার ভারতে ইলিশ রপ্তানি শুরু করেছে। তাই এখন কিছু ব্যবসায়ী অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাইরে ইলিশ পাঠাচ্ছে। এছাড়া এখানে আর আগের মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ ইলিশ আমদানি হয় না। তাই লাইসেন্স নবায়ন করেও লাভ হবে না। এ জন্য কেউ লাইসেন্স নবায়নও করায় না। আর লাইসেন্স করতে অনেক দিকে টাকা খরচ করতে হয়। আমারও ইলিশ রপ্তানিকারক লাইসেন্স ছিল। মাছ কম সরবরাহ হাওয়ায় আমি লাইসেন্সটি নবায়ন করিনি।

ইলিশের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রয় করেন জানিয়ে চাঁদপুর মাছ ঘাটের আনোয়ার হোসেন গাজী বলেন, চাঁদপুরে তুলনামূলক কম মাছ থাকায় ইলিশের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে মাত্র ১০ টন ইলিশ বিক্রি করেছি। তবে আমাদের এখানে মাছের আমদামি খুবই কম।

চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক শবে বরাত সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, নদী ও সাগরে ইলিশ নেই। বর্তমান আবহাওয়া মাছের উপযোগী না। কারণ আগে চৈত্র -বৈশাখ মাসে জড়, তুফান হতো। এখন এর উল্টোটা হচ্ছে। বর্ষার শেষের দিকে জড়, তুফান হচ্ছে। ইলিশ প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদন হয়। প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে তারা চলাফেরা করে। ইলিশের মূল মৌসুম হলো আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস। এ সময়ে মাছ না থাকলে মাছের দাম তো বাড়বেই। এখানে প্রতিদিনের চাহিদা ৪-৫ হাজার মণ। সেই তুলনায় বর্তমানে চাঁদপুর মাছ ঘাটে একেবারেই কম আসছে।

ট্রেনে ইলিশ পরিবহন সর্ম্পকে তিনি বলেন, চাঁদপুর থেকে ট্রেনে ইলিশ সরবরাহটা আবার শুরু হলে আমাদের অনেক উপকার হবে। এ বিষয়টিতে আমি রেল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

চাঁদপুরে ইলিশের বাজারে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সর্ম্পকে শবে বরাত সরকার বলেন, একসময় চাঁদপুর থেকে সরাসরি বিদেশে ইলিশ রপ্তানি হতো। এখন এখানে ইলিশের রপ্তানিকারকরা নেই। আগে কয়েকজনের ইলিশের রপ্তানির লাইসেন্স ছিল। আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগে তৎকালীন সরকার ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করে। এরপর থেকে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো আর তাদের লাইসেন্স নবায়ন করেনি। চাহিদা অনুযায়ী ঘাটে মাছ না আসায় কেউ আর লাইসেন্স নবায়ন করে না। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আবার ভারতে ইলিশ রপ্তানি শুরু করেছে। সেই কিছু ব্যবসায়ী দেশের অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে ইলিশ বিক্রি করছেন। তাদের মাধ্যমে প্রায় ২০০ মণ ইলিশ চাঁদপুর থেকে রপ্তানি হয়েছে। আগের মতো ইলিশ সরবরাহ হলে হয়ত চাঁদপুরে আবারও ব্যবসায়ীদের মধ্যে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান তৈরি হবে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, চাঁদপুরে থেকে বিদেশে ইলিশ বিক্রির জন্য সরাসরি রপ্তানিকারক কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তবে ব্যবসায়ীরা চাঁদপুর থেকে সারা দেশে অনলাইন ও অফলাইনে ইলিশ বিক্রি করেন।

ইলিশ গবেষক ও মৎস্য বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ আনিছুর রহমান বলেন, ইলিশ দলবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করে। নদীতে নির্ধারিত এলাকায় দেখা না গেলেও অন্য স্থানে ইলিশের দেখা মেলে। তবে চাঁদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে পদ্মা-মেঘনা নদী ডুবো, অতিরিক্ত বালু উত্তোলন, দূষণসহ নানা কারণে জেলেরা ইলিশ পাচ্ছেন না। বছরের নির্ধারিত সময়ে বৃষ্টি না হওয়ায় কারণেও ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না।

এফআরএস

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *