চাঁদপুরে লাখ মানুষ পানিবন্দি

চাঁদপুরে লাখ মানুষ পানিবন্দি

চাঁদপুরের ৬ উপজেলায় গত কয়েকদিনের বৃষ্টি ও উজানের পানি নেমে বন্যা পরিস্থিতির এখনও অপরিবর্তিত। উল্টো বানের পানিতে চাঁদপুর সদর, হাইমচর, কচুয়া, হাজীগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ এবং শাহরাস্তি উপজেলার লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

চাঁদপুরের ৬ উপজেলায় গত কয়েকদিনের বৃষ্টি ও উজানের পানি নেমে বন্যা পরিস্থিতির এখনও অপরিবর্তিত। উল্টো বানের পানিতে চাঁদপুর সদর, হাইমচর, কচুয়া, হাজীগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ এবং শাহরাস্তি উপজেলার লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

বুধবার (২৮ আগস্ট ) রাতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েকদিনের বৃষ্টি এবং উজানের পানি নেমে চাঁদপুর সদর উপজেলার বাগাদী, বালিয়া, চান্দ্রা, লক্ষ্মীপুর, রাজরাজেশ্ব ইউনিয়ন, হাইমচর উপজেলার আলগী উত্তর, দক্ষিণ এবং চর ভৈরবী ইউনিয়ন, হাজীগঞ্জ উপজেলার গন্তব্যপুর উত্তর -দক্ষিণ, ৬ নম্বর বড়কুল ইউনিয়ন, শাহরাস্তি পৌরসভার বেশ কয়েকটি এলাকা, উপজেলার রায়শ্রী উত্তর ইউনিয়ন, রায়শ্রী দক্ষিণ ইউনিয়ন, সুচিপাড়া উত্তর ইউনিয়ন, সুচিপাড়া দক্ষিণ ইউনিয়ন, চিতোষী পূর্ব ইউনিয়ন, চিতোষী পশ্চিম ইউনিয়ন, কচুয়া উপজেলার আশ্রাফপুর ইউনিয়ন, ফরিদগঞ্জ পৌর ও উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে আর বৃষ্টি না হলে দুই-এক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)।

চাঁদপুর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলার পৌরসভা এবং ইউনিয়নের মধ্যে ৬৪টি স্থানে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে ও প্লাবিত হয়েছে। এতে ৭ হাজার ২৩টি পরিবার পানিবন্দি এবং ১ লাখ ২১ হাজার ২৮৬ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জেলার ৪৪০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৭ হাজার ৬৭৫ জন মানুষ এবং ৯৪০টি পশু, হাঁস-মুরগি আশ্রয় নিয়েছে।

জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, ১০ থেকে ১২ দিনের ভারী বৃষ্টিতে চাঁদপুর জেলার ৬২টি ইউনিয়নের ১০ হাজার ৮০১টি পুকুর-দিঘি ও ৫৫টি ঘের থেকে ১৬ কোটি ৭ লাখ ৯০ হাজার টাকার বিভিন্ন চাষ করা মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে। সেখানে ৬ হাজার ৫০০ পুকুর-দিঘি ও ৫০টি ঘেরের ১৪ কোটি ৯৭ হাজার টাকার মাছ ভেসে গেছে। হাজীগঞ্জের ৩৭৪টি পুকুর-দিঘি, ফরিদগঞ্জে ১ হাজার ২৫০টি, চাঁদপুর সদরের ৪৫০টি, মতলব দক্ষিণের ১২০টি, কচুয়ার ৭২টি, হাইমচরের ৩২টি ও মতলব উত্তরের তিনটি পুকুর-দিঘির মাছ ভেসে গেছে। এখনও এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা থাকায় বিপাকে পড়েছেন মৎস্য খামারি ও চাষিরা।

চাঁদপুর জেলায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, ৩২ হাজার হেক্টর জমির আংশিক এবং ১৮ হাজার ৭৫৩ হেক্টর জমির ধানের চারা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। এতে সাড়ে ৪৫ হাজার কৃষকের প্রায় ৭৯ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

ফরিদগঞ্জ উপজেলার রূপসা উত্তর ইউনিয়নের বদরপুর এলাকার আলমগীর পাটোয়ারী বলেন, আমি দুই লাখ টাকার মাছ চাষ করেছি। বৃষ্টির পানিতে এসব মাছ শেষ হয়ে গেছে।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শাহরাস্তি উপজেলার দীর্ঘি পাড় এলাকার পার্থ সারতি চক্রবর্তী বলেন, গত কয়েকদিনের বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে ভেসে আমার দুটি পুকুরের প্রায় ৭ লাখ টাকার মাছ চলে গেছে। বাড়িতেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গবাদি পশু রাখার মতো জায়গা নেই। আমাদের এলাকার চারদিকে পানি থইথই করছে।

ফরিদগঞ্জ উপজেলার মানিকরাজ গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, টানা বৃষ্টির কারণে আমাদের সব ফসলই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে রোপা আমন আবাদ পুরোপুরি ব্যাহত হবে।

একই এলাকার আখ চাষি অহিদুর রহমান বলেন, জলাবদ্ধতায় আখের মধ্যে পচন লাগে। বিক্রি করলেও দাম পাওয়া যাবে না। আমরা এবার আখে পুরোপুরি লোকসান দিতে হবে।

হাইমচর উপজেলার উত্তর আলগী ইউনিয়নের মহজমপুর গ্রামের পান চাষি আবু তাহের জানান, তিনি এ বছর ৪০ শতাংশ জমিতে প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ করে পানের বরজ করেছেন। গত এক সপ্তাহের টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে দুইটি পানের বরজ। এখন শ্রমিক নিয়ে পানি নিষ্কাশন করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। পানের বোরজের ভবিষ্যৎ কি হবে তাও বলতে পারছি না।

আলগী দক্ষিণ ইউনিয়নের পান ব্যপারী কাদের গাজী বলেন, পান নির্দিষ্ট সময়ে বড় হলে চাষিরা তা বিক্রি করেন। কিন্তু দুর্যোগ মুহূর্তে এখন কিছুই করার নেই। বরজ থেকে কর্তন করে কোনোরকম বিক্রির জন্য বিড়া সাজানো হচ্ছে। নইলে জমিতেই পচবে এসব পান। পান বড় হলে প্রতি বিড়া বিক্রি হতো ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। সাইজে ছোট হওয়ায় এখন প্রতি বিড়া ৩০ থেকে ৫০ টাকায় পাইকারি বিক্রি হচ্ছে।

চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাখাওয়াত জামিল সৈকত বলেন, এ উপজেলার চারটি ইউনিয়নের টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে কয়েকটি এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ২ হাজার পরিবারের ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি আছেন। তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।

হাইমচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে সালমা নাজনীন তৃষা বলেন, অতিবৃষ্টির কারণে উপজেলার তিন ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এলাকাগুলো নদীর পাশের চরে। তবে জোয়ারে এমনটা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে ১ হাজার মানুষ পানিবন্দি আছেন। তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।

হাজীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাপস শীল বলেন, অতিবৃষ্টির কারণে উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তবে আর বৃষ্টি না হলে দুই-এক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে ৩৭ হাজার মানুষ পানিবন্দি আছেন। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।

ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৌলি মণ্ডল বলেন, উপজেলার প্রায় সব ইউনিয়নে অতিবৃষ্টির কারণে লোকজন পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। আগের তুলনায় পানি কমতে শুরু করেছে। আশা করি দুই-এক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

শাহরাস্তি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইয়াসির আরাফাত বলেন, কুমিল্লার লাকসামের ডাকাতিয়া নদী থেকে বন্যার পানি ঢুকে চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এ পর্যন্ত ১ হাজার ২০০’র বেশি পরিবার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। বর্তমানে বন্যার পানি আবর্তিত আছে। আশা করি দুই-এক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, জেলার বিভিন্ন পুকুর, দিঘি ও ঘের প্লাবিত হয়ে ১৬ কোটি ৭ লাখ ৯০ হাজার টাকার চাষ করা বিভিন্ন ধরনের মাছ ও মাছের পোনা ভেসে গেছে।

চাঁদপুর আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক শাহ মো. শোয়েব বলেন, ১ আগস্ট থেকে ২৮ আগস্ট পর্যন্ত চাঁদপুর জেলায় সর্বমোট ৭১৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. হেদায়েত উল্ল্যাহ বলেন, চাঁদপুরে আটটি উপজেলার ৬৪টি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সব প্রস্তুতি আছে। বনবাসীদের জন্য ৬৪টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। বিশেষ করে জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য চার লাখ ১০ হাজার টন চাল ও চার লাখ ৭০ হাজার নগদ টাকা মজুদ আছে।

চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বশির আহমেদ বলেন, টানা বৃষ্টির কারণে জেলার কয়েকটি উপজেলার লোকজন পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। অনেক পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। এখানে আগের তুলনায় পানি কমতে দেখা গেছে। চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধ নজরদারিতে রাখা হয়েছে। মেঘনার পানির বর্তমান লেভেল হচ্ছে ১ দশমিক ১৭ মিলিমিটার। আশা করি আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।

আনোয়ারুল হক/এফআরএস

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *