‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের ওপরে একটি শিশিরবিন্দু’— কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঙক্তিগুলো জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই মিলে যায়। সমস্যার সমাধান আমাদের খুব কাছে থাকলেও আমরা তা খুঁজে দেখি না। এই যেমন, অসুস্থতা জীবনের অংশ। সুস্থ হতে ওষুধের ওপরই ভরসা রাখেন বেশিরভাগ মানুষ। অথচ রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থা প্রকৃতিতেই করা আছে। কী, জটিল লাগছে বিষয়টি? চলুন একটু সবিস্তরে আলোচনা করা যাক-
বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য অপরিহার্য। কেননা খাবার থেকেই মানুষ শক্তি পায়। এই খাদ্যেই লুকিয়ে রয়েছে রোগমুক্তির মন্ত্র। প্রাকৃতিক খাবারগুলো মানবদেহকে নানা রোগ থেকে রক্ষা করে। দেয় রোগহীন সুস্থ জীবনের আশ্বাস। অর্থাৎ, খাবারই ওষুধ আর ওষুধই খাবার। খাবারকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের এই ধারণা কিন্তু নতুন কিছু নয়, বরং বেশ পুরনো।
আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস বলেছিলেন, ‘খাবার হোক ওষুধ’। যদিও কালের পরিক্রমায় এই উদ্ধৃতির উৎসের সত্যতা নিয়ে কথা ওঠে। তবে এ বিষয়ে এখনও মানুষ একমত যে সুস্থ থাকতে স্বাস্থ্যকর প্রাকৃতিক খাবারের বিকল্প নেই। সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে এবং রোগ প্রতিরোধের জন্য ভালো খাদ্য এবং পুষ্টিকর একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অতিজরুরি।
পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ওষুধ হলো খাদ্য। আপনি যা খাচ্ছেন তা ওষুধের বাক্সে থাকা যেকোনো ওষুধের চেয়ে শক্তিশালী হতে পারে। একজন ব্যক্তি যখন ওষুধ হিসেবে খাদ্য গ্রহণ করেন তখন খাবারগুলো অসুস্থতা এবং অবস্থার মূল ভারসাম্যহীনতা খুঁজে বেড়ায়। কীভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে সেই অসুস্থতা দূর করা যায় তার উপায় খুঁজে বের করে।
প্রকৃতির বিভিন্ন উৎস থেকে আমরা খাদ্য পেয়ে থাকি। এই প্রকৃতি আমাদের প্রতিনিয়ত প্রচুর ফল, শস্য, শাকসবজি, মাছ, মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্য সরবরাহ করছে। এগুলো সবই প্রাকৃতিক উপাদান ও পুষ্টি দিয়ে গঠিত। এসব খাবার কেবল পেটের খিদাই মেটায় না, স্বাস্থ্য সুবিধাও প্রদান করে। এই যেমন টমেটোতে রয়েছে লাইকোপিন নামক কার্যকরী খাদ্য উপাদান। এটি প্রদাহজনিত রোগ থেকে শরীরকে রক্ষা করে। সামুদ্রিক মাছ ও তিসি বীজে রয়েছে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। যা হৃদরোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে এবং বিপজ্জনক কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।
আবার হলুদের রয়েছে ইনফ্লামেটরি গুণ। এটি পাকস্থলীর সুরক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ প্রদাহ রোধে অ্যান্টিবায়োটিকের মতো কাজ করে। এতে থাকা কারকিউমিন হৃদরোগ, আলঝাইমার্স, এমনকী মরণব্যাধী ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। গোলমরিচে থাকা পাইপেরিন একটি বায়ো-অ্যাক্টিভ উপাদান যা ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে।
না। যেই খাবার আপনি খাচ্ছেন তা কতটা প্রাকৃতিক উপায়ে বেড়ে উঠেছে এবং কীভাবে খাচ্ছেন তার ওপর নির্ভর করবে এর উপকারিতা। পুষ্টিবিদদের মতে প্রাকৃতিক খাদ্য দিয়ে তৈরি কোনো খাবার খাওয়ার চেয়ে সেই খাবারটি সরাসরি খেলে বেশি উপকার মেলে। বিশেষ করে ফল। যেমন- আপেলের জ্যাম, জেলি বা জুস খাওয়ার চেয়ে আস্ত আপেল শরীরের জন্য বেশি উপকারি।
রান্নায় বেশি পরিমাণ ভেষজ (হার্ব) ও মশলা রাখার চেষ্টা করুন। গবেষণা অনুযায়ী, আদা বমি বমি ভাব দূর করে, অরিগ্যানো ব্যাকটেরিয়া নিষ্ক্রিয় করতে পারে। হলুদ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে। তাই উপকারি মশলাগুলো আপনার খাবার পাতে রাখতে চেষ্টা করুন।
মূল কথা খাদ্যতালিকায় রাখুন ফাংশনাল ফুড। যেসব খাবারে বায়ো-অ্যাকটিভ উপাদান আছে, সেসব খাদ্যকে ফাংশনাল ফুড বলা যায়। এসব খাবার আমাদের শরীরের বিভিন্ন কার্যকারিতা বাড়াতে এবং কিছু রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পরিচিত কিছু ফাংশনাল ফুড হলো- হলুদ, আদা, কালোজিরা, গাজর, কাজুবাদাম, মধু, গোলমরিচ, দারুচিনি, ইত্যাদি।
এসবের পাশাপাশি রোজ পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। কেননা শরীর হাইড্রেট থাকলে অনেক রোগ থেকেই দূরে থাকা যায়। এটি শরীর থেকে টক্সিন বের করে দিতেও সাহায্য করে।
খাদ্য ওষুধের মতো তখনই কাজ করে যখন সঠিক উপাদান ও সঠিক পরিমাণ খাওয়া হবে। ভেজালের এ যুগে প্রাকৃতিক খাদ্য পাওয়াই মুশকিল। তার মধ্যে কোন উপাদানটি কতটুকু খেতে হবে তা জানেন না বেশিরভাগ মানুষ। এক্ষেত্রে একটি সহজ সমাধান হলো ফর্মুলেটেড ফাংশনাল ফুড। বিভিন্ন ফাংশনাল ফুডের পুষ্টিগুণ যখন স্বীকৃত উপায়ে ফর্মুলেটেড করে ক্যাপসুল, ট্যাবলেট কিংবা তরল সিরাপের আকারে রূপান্তরিত করা হয় তখন একে ফর্মুলেটেড ফাংশনাল ফুড বলে। এই প্রক্রিয়ার যেকোনো শারীরিক সমস্যার জন্য ঠিক যতটুকু পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন, ততটুকুই ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম হিসেবে অর্গানিক ফর্মুলেটেড ফুড বাজারজাত করছে অর্গানিক নিউট্রিশন লিমিটেড। কারকুমা ব্র্যান্ড নামে বাজারজাত করা তাদের বিভিন্ন পণ্যে ব্যবহার করা হয় অর্গানিক সব উপাদান। ইউএসডিএ অর্গানিক সার্টিফাইড এসব পণ্যের তালিকায় আছে টারমারিক ইমিউন বুস্টার, সুপারফুড, হেলদি গাট, জয়েন্ট কেয়ার ইত্যাদি। এই ফর্মুলেটেড ফাংশনাল ফুডগুলো দেহের ইমিউন সিস্টেমের কার্যকারিতা বৃদ্ধি, নারীদের পিরিয়ডের সমস্যা সমাধান, অন্ত্রের কার্যক্রমকে স্বাভাবিক রাখা, অস্থিসন্ধির কার্যক্রমকে স্বাভাবিক রাখা ইত্যাদি কাজ করে থাকে।
এই প্রশ্নটির উত্তর হলো- না। অনেকে বলে থাকেন, খাবারই যদি ওষুধ হয় তাহলে আলাদা করে আর ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন নেই। এই ধারণা ভুল। সঠিক প্রাকৃতিক খাদ্য আপনাকে বিভিন্ন রোগ থেকে দূরে রাখবে। কিন্তু এরপরও যদি কোনো রোগে আক্রান্ত হন তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং সঠিক ওষুধ গ্রহণ করুন। খাবার বা ফর্মুলেটেড ফুড হলো রোগ নিবারণের পূর্বপ্রস্তুতি ও পরবর্তী করণীয়। অন্যদিকে ওষুধ হলো রোগ নিরাময়ের মাধ্যম।