যশোরের কেশবপুর উপজেলায় সম্প্রতি ভারি বর্ষণে নদে পলি জমে ও অবৈধ বাঁধের কারণে জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
যশোরের কেশবপুর উপজেলায় সম্প্রতি ভারি বর্ষণে নদে পলি জমে ও অবৈধ বাঁধের কারণে জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কেশবপুর উপজেলার একটি পৌরসভার প্রায় সব কয়টি ওয়ার্ড এবং ১১টি ইউনিয়নের মোট ১০৪টি গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। প্রায় এক মাস যাবৎ এ অঞ্চলের মানুষেরা পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
জানা গেছে, কেশবপুর উপজেলার প্রাথমিক মাধ্যমিক এবং বিভিন্ন কলেজসহ প্রায় ৭০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বহুতল ভবনগুলো এখন আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। অপরদিকে প্রতিদিনই বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সংস্থার পক্ষ থেকে বন্যাকবলিতদের মধ্যে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ কার্যক্রমও অব্যহত রয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) সকাল থেকে কেশবপুর পৌরসভার আলতাপোল, মধ্যকুল, হাবাসপোল, বালিয়াডাঙ্গা, বাজিতপুরসহ বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড এবং উপজেলার ব্যাসডাঙ্গা, সুজাপুর, আলতাপোল ২৩ মাইল, মাগুরাডাঙ্গা, বুড়ো বাঁকাবর্শীসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ জনবসতি এলাকা হরিহর নদ ও বিভিন্ন খালের উপচে পড়া পানিতে প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে এ সব এলাকার বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি। কারও ঘরের মধ্যে পানি আবার কারও বাড়ির চতুর্দিকে পানি থৈ থৈ করছে। শুধু তাই নয় তলিয়ে গেছে এ অঞ্চলের মানুষদের উপার্জনের উৎস বিভিন্ন ফসলি জমি এবং মাছের ঘের। ফলে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বন্যাকবলিত এসব এলাকার মানুষেরা।
কেশবপুর পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা প্রণব চক্রবর্তী বলেন, প্রায় এক মাস আমাদের বাড়িতে পানি উঠে গেছে। পানি কখনো কমে আবার কখনো বাড়ে। ঘরের মধ্যে পানি উঠে গেছে, সাপ-পোকামাকড়ের ভয়ে পরিবার নিয়ে যশোর-চুকনগর মহসড়কের পাশে টং ঘর বসবাস করছি।
একই কথা জানান মধ্যকূল এলাকার বাসিন্দা তারক নাথ, দেবু ঘোষ, সুনিতা রাণী। তারা বলেন, আমাদের বাড়ি ঘরে কিচ্ছু নেই। যাদের মাটির ঘর ছিল তাদের ঘর ভেঙে গেছে। এভাবে কতদিন ঝুঁকি নিয়ে পানিবন্দি অবস্থায় থাকা যায়। এজন্য আমাদের এলাকার অর্ধশতাধিক বাসিন্দা আমরা যশোর- চুকনগর মহাসড়কের পাশে ছোট ঘর বেঁধে আজ প্রায় এক মাস বসবাস করছি।
বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির কথা জানান মাগুরাডাঙ্গা, বুড়ো বাঁকাবর্শীসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষেরা। মাগুরাডাঙা গ্রামের সৈয়দ হাসান আলী বলেন, আমার দুই বিঘা মাছের ঘেরে লক্ষাধিক টাকার মাছ ছিল। আর ঘেরের পাড় দিয়ে সিম ক্ষেত ছিল। বন্যার পানিতে ঘেরের সব মাছ ভেসে, ঘেরের পাড় পানিতে তলিয়ে থাকায় পাড়ের ওপর সিমগাছ সব মরে নষ্ট হয়ে গেছে। সবমিলিয়ে আমার প্রায় তিন লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
একই কথা জানান, বাকাবর্শী গ্রামের পলাশ মজুমদার। তিনি বলেন, আমার চার বিঘা নিয়ে বড় মাছের ঘের। যখন ভারি বৃষ্টিপাত হলো, ঘের তলিয়ে যাবার শঙ্কায় ঘেরের পাড়ে নেট দিয়ে মাছ আটকানোর চেষ্টা করি, কিন্তু পানির স্রোতে সব ভেসে গেছে। এখন কোনোরকম খাবার দিয়ে মাছ এক জায়গায় করার চেষ্টা করছি।
কেশবপুর পৌরসভাসহ গোটা জলাবদ্ধ এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোরের অন্যতম ছাত্র প্রতিনিধি জেসিনা মূর্শীদ প্রাপ্তি বলেন, কেশবপুরে জলাবদ্ধতার খবর পেয়ে আমরা গোটা উপজেলা পরিদর্শন করি। এসব এলাকার বিভিন্ন সুইচ গেটগুলোতে পানি নিষ্কাশনের পাম্পগুলো অকেজো অবস্থায় ছিল। একই সঙ্গে কেশবপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী ও খালগুলোতে পলি জমে থাকা এবং অবৈধ বাঁধ থাকার থাকার কারণে ঠিকভাবে পানি নিষ্কাশন হচ্ছিল না। এমতবস্থায় আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং পল্লী বিদুতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে নদী পুনরায় খনন এবং সুইচ গেটগুলোর অকেজো পাম্পগুলো চালু করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা যৌথ উদ্যােগে শিক্ষার্থীরা এবং এসকল দপ্তরের কর্মকর্তারা পানি নিষ্কাশনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। পানি ধীরে ধীরে নামছে তবে বৃষ্টি হলে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কেশবপুর সিনিয়র উপজেলা মৎস অফিসার সজিব সাহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কেশবপুরে বন্যায় প্রায় ৫ হাজার ২৫০ হেক্টর মৎস্য ঘের ভেসে গেছে। এ সব ঘেরে সাদা মাছের পাশাপাশি চিংড়ি মাছও ছিল। সব মিলিয়ে আমরা একটা হিসাব করেছি আনুমানিক ২ হাজার ১৫ মেট্রিক টন মতো সাদা মাছ এবং ৮ থেকে ১০ মেট্রিক টন চিংড়ি ভেসে যেতে পারে এবং আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬০ কোটি টাকার অধিক।’
পনি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কেশবপুরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো সুইচগেটে সেচ পাম্প ছিল না। সেখানকর ব্যক্তি মালিকানায় সেচ পাম্প ছিল।’
তিনি বলেন, কেশবপুরে জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য বুড়িভদ্রা নদী এবং আপার ভদ্রা নদীতে পুনরায় খনন কাজ চলছে। এ সব নদীতে খনন কাজের ফলে নিকটবর্তী খাল দিয়ে আস্তে আস্তে ওপরের পানি নেমে আসছে। এ ব্যাপারে আমাদের কার্যক্রম চলমান রেখেছি।
বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও জানতে কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেনকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এ্যান্টনি দাস অপু/আরকে