আসাদুজ্জামান খান ও তার পরিবারের ৩২০ কোটি টাকা দুর্নীতির প্রমাণ

আসাদুজ্জামান খান ও তার পরিবারের ৩২০ কোটি টাকা দুর্নীতির প্রমাণ

ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে বিগত আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রীরা কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। দেশ থেকে পাচার করেছেন হাজার কোটি টাকা। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে একে একে সেইসব দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসেছে।

ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে বিগত আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রীরা কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। দেশ থেকে পাচার করেছেন হাজার কোটি টাকা। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে একে একে সেইসব দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসেছে।

আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও তার পরিবারের নামে শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাশাপাশি সংস্থাটির অনুসন্ধানে আরও ২০০ কোটি টাকার বেশি মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটির অনুসন্ধান টিম। সব মিলিয়ে আপাতত ৩০০ কোটি টাকার বেশি দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে।

আর ওই দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে আসাদুজ্জামান কামাল, তার স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান, তার ছেলে শাফি মোদাচ্ছের খান, মেয়ে সোফিয়া তাসনিম খান ও সহকারী একান্ত সচিব মনির হোসেনকে আসামি করে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। চলতি সপ্তাহের যে কোনো দিনই কমিশনের অনুমোদনক্রমে মামলা করার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুদকের অনুসন্ধানে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অকাট্য প্রমাণ মিলেছে। নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে নামে-বেনামে ১০০ কোটি টাকার বেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ব্যাংকের নগদ অর্থ, ঢাকা ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে। অনুসন্ধানে তাদের ব্যাংক হিসাবেই শত কোটি টাকার বেশি অর্থের সন্ধান মিলেছে। এছাড়া তার এপিএস মনিরের বিরুদ্ধে প্রায় ২০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ মিলেছে।

তিনি আরও বলেন, দুদক টিম ওই পাঁচ জনের বিরুদ্ধে অন্তত ২০০ কোটি টাকার মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে। আপাতত এসব কারণেই মামলা সুপারিশ করা হয়েছে। তবে আমাদের বিশ্বাস তদন্তে তাদের এর চেয়ে বহুগুন সম্পদ ও মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের তথ্য পাওয়া যাবে। এছাড়া সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের অন্যান্য ৫ সহযোগীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে। এ যাত্রায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা না হলেও খুব শিগগিরই মামলা সুপারিশ কমিশনে দাখিল করা হবে বলে জানা গেছে।

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও তার পরিবারসহ ওই ৫ জনের বাইরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, ডিআইজি মোল্যা নজরুল ইসলাম, মন্ত্রীর সাবেক পিএস অতিরিক্ত সচিব হারুন অর রশিদ বিশ্বাস, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপুর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অনুসন্ধান চলমান আছে। ইতোমধ্যে তার নামে থাকা ব্যাংক হিসাব ও আয়কর নথিসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিস থেকে বস্তায় বস্তায় কোটি কোটি টাকা আদায় করা অভিযোগ ছিল। যার মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কামাল-হারুন সিন্ডিকেট।

ইতোমধ্যে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যাতে দেশত্যাগ করতে না পারেন সে কারণে আদালতের অনুমতিক্রমে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তার স্ত্রী, দুই সন্তান এবং মন্ত্রীর পিএস, এপিএসসহ ওই ১০ ব্যক্তিকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। দুদকের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলমের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই আদেশ দেয় আদালত। আদালতে দেওয়া আবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অকল্পনীয় অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তারা দেশ ছেড়ে বিদেশে পালাতে পারেন মর্মে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তাদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন।

কামাল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই ঘুষ হিসেবে বস্তা বস্তা টাকা নিতেন। পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিস থেকে এই টাকা আদায় করা হতো। এ জন্য তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন।

এই সিন্ডিকেটের অন্য সদস্য ছিলেন যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন, জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন। টাকা আদায় বা উত্তোলনে মূল ভূমিকা পালন করতেন ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাস। হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই কামাল-হারুন সিন্ডিকেট। একপর্যায়ে হারুন অর রশীদ অবসরে গেলেও এই মন্ত্রণালয়ের সব ঘুষ, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। ঝুঁকি এড়াতে টাকাগুলো পাঠানো হয়েছে দেশের বাইরে।

অভিযোগ রয়েছে জেলায় পুলিশ সুপার নিয়োগে সর্বনিম্ন ৮০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত নিতো এই চক্র। এই সিন্ডিকেটের আশীর্বাদ ছাড়া পুলিশের কেউ কোনো জেলায় বা গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন পেতেন না। জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে পদায়নের ক্ষেত্রে ১ থেকে ৩ কোটি টাকা নিতো  এই সিন্ডিকেট।

২০২২ সালের ৩০ জুন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান ডিআইজি মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম। পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে মোল্ল্যা নজরুলকে গাজীপুরের কমিশনার হিসেবে পদায়ন করা হয়। এর মাস খানেক আগে হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের কাছে ৫ কোটি টাকার একটি চেক দেন মোল্ল্যা নজরুল। পরবর্তী সময়ে গাজীপুরের কমিশনার হিসেবে নিয়োগের পর হোটেল ওয়েস্টিনে হারুন অর রশীদের কাছে নগদ ২ কোটি টাকা দেন তিনি। এসময় পূর্বের চেকটি ফেরত নিয়ে মোল্ল্যা নজরুল ৩ কোটি টাকার একটি চেক দেন। পরে বাকি টাকাও দেওয়া হয়। এসব টাকা বস্তায় ভরে পৌঁছে দেওয়া হতো আসাদুজ্জামান খান কামালের ফার্মগেটের বাসায়।

সূত্র জানায়, এনজিওর ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট বা ‘এনওসি’দিতে গিয়ে প্রতি সংস্থা থেকে ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা দিতে হতো আসাদুজ্জামান খান সিন্ডিকেটকে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে রাজধানীর উত্তরা এলাকার একটি উন্নয়ন সংস্থার এনওসি নিতে গেলে বিপত্তি শুরু হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এর আগে পুলিশের বিশেষ শাখা, জেলা প্রশাসক, এনএসআই ইতিবাচক প্রতিবেদন দাখিল করে। তারপরও অদৃশ্য কারণে ফাইলটি মাসের পর মাস আটকে রাখা হয় মন্ত্রণালয়ে। বাধ্য হয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে মন্ত্রীকে ৮৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। ফার্মগেট এলাকায় কামালের বাসার সামনে টাকার ব্যাগটি দেওয়া হয় তার পরিবারের এক সদস্যের কাছে।

ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সে কোনো সার্কুলার হলেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে একটি তালিকা পাঠানো হতো। সে মোতাবেক তাদের নিয়োগ দিতে ফায়ার সার্ভিসকে বাধ্য করতেন সাবেক এই মন্ত্রী। ২০২৩ সালে ২ অক্টোবর ৫৩৫ জনকে জনকে নিয়োগ দেয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এর মধ্যে ছিলেন ৪৩৬ পুরুষ ফায়ার ফাইটার, ১৫ জন নারী ফায়ার ফাইটার ও ৮৪ জন গাড়িচালক। নিয়োগ কার্যক্রমের শুরুতেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে ২৫০ জনের একটি তালিকা পাঠানো হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে। সাবেক এই মন্ত্রীর নির্দেশে সেই তালিকা মোতাবেক নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় ফায়ার সার্ভিস। নিয়োগের জন্য জনপ্রতি ৮-১২ লাখ টাকা নিতো কামাল-হারুন সিন্ডিকেট।

আরএম/এসএম

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *