অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠনে নজরুল যেভাবে প্রাসঙ্গিক

অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠনে নজরুল যেভাবে প্রাসঙ্গিক

নজরুল চাইতেন দেশের তরুণ সমাজ সাম্প্রদায়িকতা ভুলে পরস্পরকে মানুষ হিসেবে বিচার করুক। সামাজিক বিপর্যয়ে, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে, নিত্যদিনের চলাফেরায় তরুণরা নতুন এক সমাজ নির্মাণ করুক যেখানে ধর্মের ভেদাভেদ থাকবে না।

বিদ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, মানবতার কবি এবং গণমানুষের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। পরাধীন ব্রিটিশ ভারতবর্ষে তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং যে সময়ে তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন সে সময়ে বাংলা তথা পুরো ভারতবর্ষ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বিক্ষুব্ধ।

বিশ্ব প্রেক্ষাপটে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, রুশ বিপ্লবের সময়। এইসব বিপ্লব, শোষণ ও শাসনের নিপীড়ন তখন কবি কাজী নজরুল ইসলামকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। মানুষে মানুষে বিভেদ, ধর্মে ধর্মে বিভেদ, জাতিতে জাতিতে বিভেদ দেখে কবি একদিকে যেমন প্রেমের বাণী বহন করেছেন তার লেখনীতে, তেমনি তিনি স্পষ্ট করেছেন অন্যায়, অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান।

আচরণবাদী ধর্ম মূলত ধর্মের বহিরাঙ্গ। যাতে থাকে কেবল প্রদর্শনের ভাবনা ও প্রচলিত আনুষ্ঠানিক ধর্মচর্চা। নজরুল আনুষ্ঠানিক ধর্মচর্চাকে ধর্মের গৌণ ব্যাপার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আর তাই তার বিদ্রোহ কেবল অন্যায় শাসন, ব্রিটিশ রাজত্বের বিরুদ্ধে বন্দি হয়ে থাকেনি। ধর্মধ্বজাধারী মোল্লা, পুরোহিতকে তিনি প্রবল পরাক্রমে কবিতার মধ্য দিয়ে আক্রমণ করেছন।

আর সেই চেতনা থেকে নজরুল অনুবাদ করেছেন ওমর খৈয়াম এর রুবাই। পারসিক কবির এই রুবাইগুলোর মধ্যে নজরুল প্রচলিত সমাজ ও ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। দীর্ঘদিনের চর্চিত ধর্মব্যবস্থার মধ্যে জীর্ণ সামাজিক নিয়মকে ভাঙতে চেয়েছেন তিনি। প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসী যদি অপরাধী হয় তাকে আর কোনোভাবে সৎ বলা যায় না। ইপিকিউরিয়ান ও চার্বাক দর্শনের এক মেলবন্ধনের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় নজরুল অনূদিত রুবাইগুলোর মধ্যে।

প্রচলিত ধর্ম না মেনে এবং নির্যাতিতকে ন্যায় দান ও গরিবকে তার অধিকার দিলে মানুষ স্বর্গ পেতে পারে এই ছিল নজরুলের মত। তাই খৈয়ামের রুবাইয়ে নজরুল বলেন—দরিদ্রেরে যদি তুমি প্রাপ্য তাহার অংশ দাও,/ প্রাণে কারুর না দাও ব্যথা, মন্দ কারুর নাহি চাও/ তখন তুমি শাস্ত্র মেনে না-ই চললে তায় বা কি!/ আমি তোমায় স্বর্গ দিব, আপতত শারাব নাও।

নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে নজরুল বর্তমান নারীবাদীদের থেকেও অগ্রগামী ছিলেন। কথায় কথায় নারী চরিত্রকে কলঙ্কিত করার বিপরীতে তিনি পুরুষকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। নারী যদি চরিত্রহীন হয় আর তার সন্তানকে জারজ বলে আখ্যা দেওয়া হয় তবে চরিত্রহীন পুরুষের সন্তানকেও জারজ বলতে হবে। নজরুলের এই বিদ্রোহ পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে প্রবল কষাঘাত। এই আঘাত আমরা আজও করতে পারি না। ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় নজরুল বলেছেন—অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ-পুত্র হয়,/ অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়!

নজরুল চাইতেন দেশের তরুণ সমাজ সাম্প্রদায়িকতা ভুলে পরস্পরকে মানুষ হিসেবে বিচার করুক। সামাজিক বিপর্যয়ে, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে, নিত্যদিনের চলাফেরায় তরুণরা নতুন এক সমাজ নির্মাণ করুক যেখানে ধর্মের ভেদাভেদ থাকবে না।

ধর্মের বাহ্যিক চিহ্ন নিয়ে নজরুলের ছিল প্রবল আপত্তি। এইসব চিহ্ন মানুষকে মানুষ হিসেবে আলাদা করে দেয়। মানুষে মানুষে আছে চিরন্তন আত্মীয়তা। ধর্মের বাহ্যিক চিহ্নগুলো এই আত্মীয়তাকে ভুলিয়ে দেয়।

কাজী নজরুল ইসলাম প্রকৃত অর্থেই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি। তিনি কবিতায় যেমন হিন্দু মিথ ব্যবহার করেছেন তেমনি ব্যবহার করেছেন ইসলামিক মিথ, গ্রিক মিথ। একই কবিতায় শিবের প্রসঙ্গ আছে নটরাজ হিসেবে আবার ইসরাফিলের প্রসঙ্গ রয়েছে এমনকি অর্ফিয়ুসের প্রসঙ্গও বাদ যায়নি। ‘আমি/ ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,/ আমি/ পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড।’

গানের ক্ষেত্রে নজরুল গজল লিখেছেন। হামদ, নাত লিখেছেন আবার শ্যামাসংগীত লিখেছেন এমনকি কৃষ্ণকে নিয়েও লিখেছেন জনপ্রিয় সব গান। শুধু সাহিত্যের উঁচু তলার লোকরাই নন বরং আপামর জনসাধারণ নজরুলের গানে মুগ্ধ হয়েছেন। শুধু গানে কেন নজরুল প্রবন্ধে, উপন্যাসে, কবিতায় ও ব্যক্তিজীবনে সব ধর্ম ও দর্শনের সারসত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন। নিজের সন্তানদের নাম রাখার ক্ষেত্রেও নজরুল অসাম্প্রদায়িক চিন্তা মাথায় রেখে নাম রেখেছিলেন। তার প্রথম সন্তানের নাম কাজী কৃষ্ণ মোহাম্মদ, দ্বিতীয় সন্তান কাজী অরিন্দম খালেদ, তারপর কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ।

অসাম্প্রদায়িক কথাটি এসেছে সাম্প্রদায়িক কথাটির বিপরীত অর্থে। অর্থাৎ যিনি জাতি, ধর্ম ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে কাউকে ছোট করা, হীন করা বা তার বিরুদ্ধাচরণ করা বা ক্ষতি করা ইত্যাদি থেকে নিজেকে বিরত রাখেন তিনিই অসাম্প্রদায়িক। আপন ধর্ম, জাতি, ভাষা ও বিশ্বাসকে যিনি একমাত্র সত্য এবং শ্রেষ্ঠ মনে করেন তিনিও এক অর্থে সাম্প্রদায়িক। অসাম্প্রদায়িক মানে, বিশেষ কোনো দল বা ধর্ম-সম্প্রদায় সম্পর্কে নিরপেক্ষ, সর্বজনীন।

১৯২৭ সালে অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ-কে লেখা চিঠিতে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা লক্ষ করা যায়—‘হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের অশ্রদ্ধা দূর করতে না পারলে যে এ পোড়া দেশের কিচ্ছু হবে না, এ আমিও জানি। এবং আমিও জানি যে, একমাত্র-সাহিত্যের ভিতর দিয়েই এ অশ্রদ্ধা দূর হতে পারে।’

অসাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকেই কাব্যে হিন্দুয়ানি মুসলমানি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। যেমন—‘ঘরে ঘরে তার লেগেছে কাজিয়া,/ রথ টেনে আন, আনরে ত্যজিয়া,/ পূজা দেরে তোরা, দে কোরবান।/ শত্রুর গোরে গালাগালি কর, আবার হিন্দু-মুসলমান।/ বাজাও শঙ্খ, দাও আজান।’

সাম্যবাদী কবিতায় নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনার চরম প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। এটি কেবল অসাম্প্রদায়িক চেতনাই নয় বরং প্রচলিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও বটে। চণ্ডীদাসের সেই বিখ্যাত উক্তি—‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ সে কথাই যেন নজরুল নতুন করে আমাদের শোনালেন।

‘গাহি সাম্যের গান

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,

যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্‌লিম-ক্রীশ্চান।’

নজরুল চাইতেন দেশের তরুণ সমাজ সাম্প্রদায়িকতা ভুলে পরস্পরকে মানুষ হিসেবে বিচার করুক। সামাজিক বিপর্যয়ে, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে, নিত্যদিনের চলাফেরায় তরুণরা নতুন এক সমাজ নির্মাণ করুক যেখানে ধর্মের ভেদাভেদ থাকবে না। মানবিক বিপর্যয়ে প্রচলিত ধর্মের নিয়ম কানুনকে উপেক্ষা করে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে। এই ছিল নজরুলের প্রত্যাশা।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আমরা মানুষকে উদ্ধার করতে গেলে তার ধর্ম পরিচয় আগে জানতে চাই না। কোনো মানুষ বিপদাপন্ন এই ভেবেই তাকে প্রথম উদ্ধার করা হয়ে থাকে। নজরুল সেই কথাই বলে গেছেন বহুবছর আগে।

সেই প্রত্যাশার ধ্বনি আমরা মাঝে মাঝে আমাদের তরুণ সমাজের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতে দেখি আবার সংকট শেষ হলে সেই প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যায়। আমাদের এই বোধ দীর্ঘস্থায়ী না হলে সমাজ ও রাষ্ট্রের সংকট কখনই মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। বাংলা অঞ্চলে দুটি সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানকে একত্রিত করতে না পারলে আমাদের সংকটকে উত্তরণ করা যাবে না ভেবেই হয়তো নজরুল বলেছিলেন—

‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম

হিন্দু-মুসলমান

মুসলিম তার নয়নমণি,

হিন্দু তাহার প্রাণ।’

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আমরা মানুষকে উদ্ধার করতে গেলে তার ধর্ম পরিচয় আগে জানতে চাই না। কোনো মানুষ বিপদাপন্ন এই ভেবেই তাকে প্রথম উদ্ধার করা হয়ে থাকে। নজরুল সেই কথাই বলে গেছেন বহুবছর আগে। এই বোধ জন্ম না নিলে আমরা তাকে মানুষ বলি কীভাবে!

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম’-ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন!

কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।’

প্রাদেশিক কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতিকে গুরুত্ব দিয়ে এই গানটি পরিবেশিত হয়েছিল। কেবল ধর্মের সমন্বয় নয় বরং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনে নজরুল প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। মানুষের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে অস্বীকার করলে মানব সভ্যতার মানবিক ইতিহাসকে অস্বীকার করা হয়। তাই সব মানুষের মিলিত শক্তিতে বিশ্বাস করেছিলেন তিনি।

নজরুলের চিন্তা ও লেখনী সমসাময়িক হলেও যেহেতু সেসব ছিল প্রচলিত সমাজ কাঠামো বিরোধী তাই তা চিরকালীন মর্যাদা পেয়েছে। ব্যক্তিজীবনে তিনি যেমন নিজ ঘরে ধর্মের সহাবস্থান প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তেমনি তার সাহিত্য জীবনেও তেমনটি আমরা দেখতে পাই। এই সম্প্রদায়গত মেলবন্ধন ছিল কালের দাবি। নজরুল সেই দাবিকে এড়িয়ে যাননি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে থাকা বিষবাষ্পকে তিনি ধ্বংস করে নতুন এক পৃথিবীর সন্ধান করেছেন।

আজকের বাংলাদেশে আমরাও তেমনি রূপান্তর জীর্ণতাকে দূরে ঠেলে নতুন এক রাষ্ট্র ও সমাজের স্বপ্ন দেখছি। আমাদের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রের উপাদান হবে নজরুল দর্শনে উদ্ভাসিত প্রেম, সৌহার্দ্য ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ। ধ্বংসের মধ্য দিয়েই নতুন সৃষ্টির গান গাইবো আমরা। তাই নজরুলের ভাষায় বলতে হয়-

‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর?-প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন!

আসছে নবীন-জীবন-হারা অ-সুন্দরে করতে ছেদন!’

সঞ্জয় সরকার ।। সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *