অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে বহির্বিশ্বের সম্পর্ক যেমন হওয়া উচিত

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে বহির্বিশ্বের সম্পর্ক যেমন হওয়া উচিত

ভূরাজনৈতিক নতুন সমীকরণ

৫ আগস্ট ২০২৪, ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শেখ হাসিনার পদত্যাগ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ এবং ভূরাজনৈতিক পটভূমিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত করে অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বের পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভারসাম্য নীতির পররাষ্ট্রনীতিকে অনুসরণের কথা উল্লেখ করেছে। সম্প্রতি বহির্বিশ্বের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে সুষম ভারসাম্য আনার বার্তা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।

মিয়ানমার, চীন ও ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ককে পুনঃসংজ্ঞায়িত করা, বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর সাথে ভারসাম্য বজায় রাখা, অর্থনৈতিক সুষম বিনিয়োগ এবং অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক গতিশীলতা পরিচালনা করার কথা বলেন। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যেই সব প্রধান দেশের সাথে ন্যায়সঙ্গত ও গঠনমূলক সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে।

বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় ভারত, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সাথে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক বৈদেশিক সংযোগকে প্রাধান্য দেবে।

ধারণা করা হচ্ছে, সদ্য ক্ষমতায় আসা সরকারের বৈশ্বিক নীতিতে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার ভিত্তিতে বৈদেশিক নীতিকে অগ্রাধিকার দেবে যেখানে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সুরক্ষিত হবে। বহির্বিশ্ব নীতিতে প্রধান দুইটি অনুমিত ধারণা নিয়ে আলোচনা চলছে প্রথমত, ভূরাজনৈতিক নতুন সমীকরণ এবং দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক বিনিয়োগ ব্যবস্থা।

ভূরাজনৈতিক নতুন সমীকরণ

ভৌগলিকভাবে, বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের তীরে কৌশলগত অবস্থানের কারণে ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে সংযোগকেন্দ্র হিসেবে বিশেষ সুবিধা পায়, যা সমুদ্রতীর ভূবেষ্টিত প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুসম্পর্ক গঠনের সুযোগ করে দেয়।

অন্যদিকে বাংলাদেশ দুটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক খেলোয়াড় ভারত এবং মিয়ানমারের সাথে সীমান্ত সংযোগ রয়েছে এবং চীনের মতো অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তির নাগালের মধ্যেও রয়েছে। গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদল, ভারতের প্রতি জনসাধারণের আক্ষেপ এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভারতে আশ্রয় গ্রহণকে কেন্দ্র করে ভারতের সাথে সম্পর্কের ফাটলের আভাস ওঠে। কিন্তু ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশের চীন ও ভারতের সাথে সুষম সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি। ব্যবসা-বাণিজ্য সংযোগের মাধ্যমে ভারত থেকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানি, সীমানা সংযোগ এবং জলের ভাগাভাগির কারণে ভারত বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত অংশীদার।

তাই, সরকার পতন সত্ত্বেও, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিশ্চিত করতে ঢাকাকে নয়াদিল্লির সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শ্রীলঙ্কার অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, শ্রীলঙ্কা তাদের নিরাপত্তা সহযোগিতা, অর্থনৈতিক সহায়তা এবং তামিল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উদ্বেগের সমাধানসহ বিভিন্ন ফ্রন্টে ভারতের সাথে সম্পৃক্ততা অব্যাহত রেখেছিল।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ তার বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার চীনের সাথে সহযোগিতাকে স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি আরও জোরদার করবে। মেগা প্রকল্প নির্মাণে অর্থনৈতিক সহায়তার পাশাপাশি চীনের প্রযুক্তিগত সহায়তা বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

২০০২ সালের সামরিক চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশেরই শক্তিশালী প্রতিরক্ষা সহযোগিতা তৈরি হয় এবং ২০২৪ সালে এই চুক্তিকে আরও জোরদার করা হয়। মিয়ানমার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনকালীন সময়ে যাতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে কোনো গোলযোগ পরিবেশ তৈরি করে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানকে যেন আর প্রশ্নবিদ্ধ ও দীর্ঘায়িত না করে তা নজরে রাখা আবশ্যিক।

নিঃসন্দেহে, ক্রমশ বর্ধিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবিক ও নিরাপত্তা সহায়তা প্রদান ও রোহিঙ্গা সঙ্কটের একটি স্থায়ী সমাধান আনা বাংলাদেশ সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জের। সংকটের মূল কারণগুলো মাথায় রেখে একটি সমাধান কমিটি গঠন করে আরও ব্যাপক এবং দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতির মাধ্যমে টেকসই সমাধান প্রয়োজন।

আমেরিকা, ফ্রান্স ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের পুনঃবিন্যাস প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে তার অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে ও কূটনীতিতে সফট পাওয়ার ব্যবহার করে পশ্চিমা বিশ্বকে সাথে সামগ্রিক সুসম্পর্ক তৈরি করতে পারে।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, কৌশলগত অংশীদারিত্বর (সন্ত্রাস দমন, সামুদ্রিক নিরাপত্তা, পরিবেশগত নিরাপত্তা) পাশাপাশি জনসংযোগ (পড়াশুনা, সংস্কৃতি, ডায়াস্পোরা বিনিময়) বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ পশ্চিমের দেশগুলোর সাথে আরও শক্তিশালী ও পারস্পরিক কল্যাণকর সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। দেশে দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের ভূমিকাকে আরও জোরদার করতে কৌশলগত ভূমিকা রাখতে পারে।

ভূরাজনীতি থেকে ভূঅর্থনীতিতে দৃষ্টিপাত

বৈশ্বিক গতিশীলতা ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভূরাজনীতির পাশাপাশি ভূঅর্থনীতির দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে।

বাংলাদেশকে তার সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার এবং এই অঞ্চলে একটি সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী জাতিতে পরিণত করার জন্য ভূ-অর্থনীতিতে মনোযোগ আবশ্যিক। গণআন্দোলনের পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি স্থবিরতা এনেছে।

অর্থনীতিকে গতিশীল করতে দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা জরুরি যাতে সরবরাহ চেইন আর প্রভাবিত না হয়। অনেক পশ্চিমা দেশের জন্য শুধু পোশাক প্রস্ততকারক এবং বিদেশে শ্রমিক প্রেরক হিসেবেই নয়, জ্বালানি আমদানিকারক হিসেবেও বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্লেয়ার।

অন্যদিকে, চীন, রাশিয়া, ভারত ও জাপানসহ বৃহৎ দেশগুলোর বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নে বড় বিনিয়োগ রয়েছে। বর্তমানে সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার ও বিশ্বায়নের সঠিক ব্যবহার ব্যতীত রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ক্রমশ বর্ধমান রাখা কঠিন।

ভেনেজুয়েলা বিশাল তেলের রিজার্ভ থাকা সত্ত্বেও কিন্তু তাদের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছিল। তাই সরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যথাযথ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন ও আরও দক্ষ করে তুলতে হবে। অর্থনৈতিক সংকট কীভাবে মোকাবিলা করবে সব ধরনের অনিশ্চয়তা দূর করতে সুশীল সমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থনৈতিক কমিটিতে সাবেক সাংসদ, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সব দলের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে কিছু স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে যেমন সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, রাজস্ব একত্রীকরণ, প্রাথমিক ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, পাবলিক সেক্টর এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগের (SOEs) ব্যবস্থাপনা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, জ্বালানি ও ইউটিলিটি, বাণিজ্য ও শিল্প এবং বিশেষায়িত আইন।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেওয়া অর্থনৈতিক সংস্কারের নীতি অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এড়িয়ে বহির্বিশ্বের সাথে বাণিজ্য সুসম্পর্ক বজায় রাখতে অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতিতে জোর দেবে।

অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ও পরিবর্তন সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকার আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক আন্তঃসরকারি সংস্থাগুলোর সাথে বিদ্যমান চুক্তি/চুক্তিগুলো বহাল রেখে পররাষ্ট্রনীতিতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে। উদাহরণস্বরূপ, শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ান আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (SAARC) এবং ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশন (IORA) এর মতো আঞ্চলিক ফোরামে অংশগ্রহণ অব্যাহত রেখেছে।

অন্তর্বর্তী সরকার সক্রিয়ভাবে বিদেশি সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সাথে সরকারের ম্যান্ডেট, লক্ষ্য এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করবে। এটি বিশ্বাস এবং বোঝাপড়া তৈরি করতে সহায়তা করে।

সদ্য জাতিসংঘ ও এর প্রধান অঙ্গ সংস্থাগুলো বাংলাদেশের এই ক্রান্তিকালীন সময়ে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে। বৈশ্বিক শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ভূমিকা জাতিসংঘের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব প্রকাশ করে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার জাতিসংঘ এবং আইএনজিও সংস্থানগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহার করে একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে।

বহুমুখী অস্থিরতায় অন্তর্বর্তী সরকারের বহির্বিশ্বের সাথে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্ক কিছুটা ক্ষুণ্ন হলেও তা সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে বলে আশা করা যায়। ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রয়োজনীয় সুষম অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ কূটনীতি এবং যোগাযোগের প্রয়োজন।

প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এবং তার মন্ত্রিসভার দেওয়া গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা, প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা, সুষম অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের উপর জোরদার অবস্থান বহির্বিশ্বের দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। 

অদিতি চক্রবর্তী ।। প্রভাষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *