অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত; নেই নতুন ট্রেন, সেবাবঞ্চিত উত্তরের মানুষ

অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত; নেই নতুন ট্রেন, সেবাবঞ্চিত উত্তরের মানুষ

৪০ হাজার কোটি টাকার মেগা এই প্রকল্পের আংশিক চালু হলেও দক্ষিণের আট জেলার মানুষের রেল সুবিধার স্বার্থে দেওয়া হয়নি কোনো নতুন ট্রেন। ঢাকা থেকে যমুনা সেতু দিয়ে যাতায়াত করা খুলনা ও বেনাপোলগামী দুটি আন্তঃনগর ট্রেনের রুট পরিবর্তন করে পদ্মা সেতু হয়ে এই রুটে চালানো হচ্ছে। অপরদিকে, গোয়ালন্দঘাট অঞ্চলের দুটি ট্রেনের রুট পরিবর্তন করেও এই রুটে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এতে দক্ষিণ অঞ্চলের কিছু এলাকা ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগে নতুন ট্রেন পেলেও উত্তর অঞ্চলের যাত্রীরা ঢাকা-খুলনা রুটের দুটি ট্রেন হারিয়ে ফেলেছেন। একইসঙ্গে ট্রেনের বিলুপ্তি ঘটেছে রাজবাড়ী-গোয়ালন্দঘাট রুটেও…

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় তিন কোটি মানুষ উপকৃত হয়েছেন। দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তব রূপ মিলেছে এই সেতুর মাধ্যমে। অথচ উত্তর-পশ্চিমের কিছু জেলার মানুষ পদ্মা সেতুর সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সেক্ষেত্রে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে কিছুটা হলেও আশার আলো হিসেবে দেখা দেয় পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আংশিক রুটের উদ্বোধনের পর।

গত বছরের নভেম্বর থেকে ঢাকা-ভাঙ্গা রুট চালু হলে চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী ও ফরিদপুর অঞ্চলে রেল-যোগাযোগের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়। এতে রাজবাড়ী-পোড়াদহ রুটে রেলপথ ব্যবহার করে সড়ক পথের তুলনায় প্রায় অর্ধেক সময়ে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন এখানকার লাখ লাখ মানুষ।

এই মুহূর্তে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে রাজবাড়ী-পোড়াদহ রুটে চলাচল করছে মোট চারটি ট্রেন। তবে, ৪০ হাজার কোটি টাকার মেগা এই প্রকল্পের আংশিক চালু হলেও দক্ষিণের আট জেলার মানুষের রেল সুবিধার স্বার্থে দেওয়া হয়নি কোনো নতুন ট্রেন। ঢাকা থেকে যমুনা সেতু দিয়ে যাতায়াত করা খুলনা ও বেনাপোলগামী দুটি আন্তঃনগর ট্রেনের রুট পরিবর্তন করে পদ্মা সেতু হয়ে এই রুটে চালানো হচ্ছে। অপরদিকে, গোয়ালন্দঘাট অঞ্চলের দুটি ট্রেনের রুট পরিবর্তন করেও এই রুটে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এতে দক্ষিণ অঞ্চলের কিছু এলাকা ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগে নতুন ট্রেন পেলেও উত্তর অঞ্চলের যাত্রীরা ঢাকা-খুলনা রুটের দুটি ট্রেন হারিয়ে ফেলেছেন। একইসঙ্গে ট্রেনের বিলুপ্তি ঘটেছে রাজবাড়ী-গোয়ালন্দঘাট রুটেও।

শুধু তা-ই নয়, ভাঙ্গা-যশোর পর্যন্ত নতুন লাইন চালু করা হলে বিদ্যমান রুটে চলা দুটি আন্তঃনগর ট্রেন সরিয়ে নেওয়ারও পরিকল্পনা করছে পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে উত্তরের পর দক্ষিণের যাত্রীবহুল ফরিদপুর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ জেলাও ঢাকাগামী দুটি ট্রেন হারাবে।

এদিকে, রেলওয়ের শুরুলগ্ন থেকে কোচ ও ইঞ্জিন সংকটের দোহাই দিয়ে আসছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে নতুন লাইনে চালানো যাচ্ছে না নতুন ট্রেন। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের অংশ হিসেবে ঢাকা-যশোরের মধ্যে নতুন ১৭০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। পুরোপুরি শেষ হলে আগামী নভেম্বর থেকে বাণিজ্যিকভাবে এই রুটে শুরু হবে ট্রেন চলাচল।

কিন্তু নতুন এই লাইনে অন্য রুটে চলা ট্রেন এনে চালানোর পরিকল্পনা রেলের। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসেন জানান, রাজবাড়ী-পোড়াদহ রুটে চলাচল করে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ও বেনাপোল এক্সপ্রেস। এই ট্রেন দুটিকে বর্তমান রুট থেকে সরিয়ে ভাঙ্গা-কাশিয়ানি-রুপদিয়া রুট দিয়ে চালানো হবে। তিনি বলেন, ‘যাত্রীরা অবশ্যই শর্ট রুট চান। দুটি ট্রেনকেই ভাঙ্গা-কাশিয়ানি-রুপদিয়া রুটে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এতে ট্রেন দুটি দিয়ে অল্প সময়ে ঢাকার সঙ্গে খুলনা-যশোর অঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপন করা যাবে।’

এমন ব্যবস্থাপনায় ট্রেন চালিয়ে যেমন কিছু অঞ্চলে রেল সংযোগের বিলুপ্তি ঘটছে, অপরদিকে পুরোনো ট্রেনগুলোকে নতুন রুটে চালিয়ে সামগ্রিক আয় বাড়াতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। সবমিলিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, জোড়াতালি দিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের এই অদূরদর্শী সিদ্ধান্তে লাভ হবে না প্রতিষ্ঠানটি। একইসঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলের যাত্রীদের রেলসেবা থেকে বঞ্চিত করার বিষয়টিও থাকছে।

স্থানীয়দের অবরোধ ও মানববন্ধন

এদিকে, গত ৩ অক্টোবর পাবনার ঈশ্বরদীতে আন্তঃনগর চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেনকে খুলনা-যমুনা সেতু-ঢাকা রুটে চালু রাখা এবং বাতিল করা সুন্দরবন ও বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনকে পুনরায় যমুনা সেতু-ঢাকা রুটে চালুর দাবিতে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ ও স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি পালন করা হয়।

এসব কর্মসূচিতে অংশ নেন বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার শত শত মানুষ। তারা বলেন, ঢাকা যাওয়ার মাত্র তিনটি আন্তঃনগর ট্রেন ছিল। কিন্তু গত বছর তিনটি ট্রেনের মধ্যে ঢাকামুখী সুন্দরবন ও বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেন ঈশ্বরদী স্টেশন থেকে প্রত্যাহার এবং রুট পরিবর্তন করে অন্য রুটে চালানো হচ্ছে। ফলে এই অঞ্চলের শত শত যাত্রী ঢাকায় যাওয়ার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনায় পড়েছেন। এই অবস্থায় আবারও ঢাকাগামী চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঈশ্বরদী স্টেশনে যাত্রাবিরতি বাতিল করে অন্য রুটে চালানোর পরিকল্পনা করছে রেল কর্তৃপক্ষ।

তারা বলেন, রেল কর্তৃপক্ষ যদি আবারও এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে তাহলে আরও দুর্ভোগে পড়বেন ঈশ্বরদী, কুষ্টিয়া, ভেড়ামারা, চাটমোহর, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলসহ গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনের হাজারও মানুষ।

বিশেষজ্ঞের অভিমত 

এ বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান বলেন, নতুন ট্রেন না দেওয়ার পরিবর্তে রুট চেঞ্জ করে অন্য এলাকায় চলাচল করা ট্রেন সরিয়ে আনাটা অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত হবে রেলের। তার কথায়, ‘আমরা যেখানে নতুন রেলপথ তৈরি করলাম, সেক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই একটা মহাপরিকল্পনা থাকতে হবে। এটা অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে চালানোর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা উত্তরবঙ্গ রুট থেকে ট্রেন সরিয়ে দক্ষিণবঙ্গে দিলাম। এতে পুরাতন পথের যাত্রী ছিল, তারা ব্যাপকভাবে ট্রেনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।’

হাদিউজ্জামান বলেন, ‘যেখানে আমরা প্রত্যেকটি নতুন প্রকল্পে নতুন ট্রেন দেওয়ার কথা বলছি, সেখানে ট্রেন চালাতে গিয়ে অন্য রুটের সেবা বঞ্চিত করে দিচ্ছি। আমি মনে করি, আমাদের পরিকল্পনার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে প্রাপ্ত উন্নয়নের পরও অন্য রুটের যাত্রীদের কাছ থেকে ট্রেন সরিয়ে নেওয়া রেলের অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত।’

‘নতুন পথে নতুন ট্রেন চালাতে হবে। আমরা হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি, অথচ লোকোমোটিভ সংগ্রহ করতে পারছি না, নতুন কোচ কিনতে পারছি না। এত বড় একটি প্রকল্পের যে উদ্দেশ্য, তা যথাযথ নয়। আংশিকভাবে আমরা তা পূরণ করছি।’

বাংলাদেশ রেলওয়ের অপারেশন বিভাগের মহাপরিচালক এ এম সালাহ উদ্দীন বলেন, ‘আমরা ঢাকা ও খুলনা রুটে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছি। আর রাজবাড়ী-পোড়াদহ রুটে দুটি ট্রেনের মধ্যে একটি ট্রেন রাখার পরিকল্পনা রয়েছে; যাতে জনগণের অসুবিধা না হয়। তবে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও নেওয়া হয়নি। যখন নতুন রুটের সব কাজ সম্পন্ন হবে তখন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

‘তবে আলোচনায় আছে, একটি ট্রেন অন্তত রাজবাড়ী-পোড়াদহ রুটে চলাচল করবে। জনগণ যেহেতু এই রুটে বহুদিন ধরে চলাচল করছে, সমস্যায় ফেলে তাদের আমরা হতাশ করতে চাই না। সব নতুন রুটেই আমাদের ট্রেন বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে। যেহেতু ঢাকা-খুলনার রানিং টাইম কমে যাবে, সেহেতু বেশি বেশি ট্রেন চালানো আরও সহজ হবে।’

নতুন ট্রেন চালানোর কোচ কোথায়?

পদ্মা রেলওয়ে সেতু চালুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে রেলওয়ের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত হয়েছে। ফলস্বরূপ, দক্ষিণাঞ্চলে নতুন ট্রেন সরবরাহ করার পাশাপাশি পুরাতন ও বেশি বয়সী কোচগুলো প্রতিস্থাপন করার জন্য নতুন ব্রডগেজ প্যাসেঞ্জার কোচ প্রয়োজন হবে। তাই তো এক হাজার ২০৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকায় ২০০টি ব্রডগেজ যাত্রী বহনকারী কোচ (প্যাসেঞ্জার ক্যারেজ) কেনার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান আরআইটিইএস লিমিটেডের চুক্তি সই হয়েছে গত মে মাসে।

কোচগুলো কবে নাগাদ দেশে আসবে— সে বিষয়ে কোচ কেনার প্রকল্প পরিচালক মো. জয়দুল ইসলাম বলেন, ‘এটি তিন বছরের চুক্তি, সবেমাত্র সম্পন্ন হলো। কোচ আমদানি পুরো একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমরা সেই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এগোচ্ছি। তবে, তারাও চেষ্টা করছে যত দ্রুত সম্ভব কোচ পাঠানোর। চুক্তি হওয়ার পর ১৮ থেকে ২০ মাসের একটি সময় থাকে। সেই অনুযায়ী তারা কাজ করছে।’

‘তবে, দেশের পট পরিবর্তন হলেও কোচ আসা নিয়ে কোনো শঙ্কা বা কোচগুলো পেতে কোনো ধরনের বিলম্বের আশঙ্কা করছি না আমরা। আশা করা যাচ্ছে, আগামী ১৮ মাসের মধ্যেই কোচগুলো আসতে শুরু করবে। ওরা ইতোমধ্যে ডিজাইন, ড্রয়িংয়ের কাজ শেষ করেছে। এরপর বিভিন্ন যাচাই-বাছাইয়ের কাজ রয়েছে, সেগুলোও সম্পন্ন হচ্ছে।’

এক নজরে পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্প

২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হয়। দ্বিতল এই সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। নিচ দিয়ে ট্রেন চলাচলের পথ। পদ্মার দুই পারে যোগাযোগ স্থাপন করতে নেওয়া হয় আলাদা প্রকল্প, যা ‘পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্প’ নামে পরিচিত।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে সরকার পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি অনুমোদন করে। শুরুতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। বর্তমানে এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকায়। চীনের অর্থায়নে দেশটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রেলপথ নির্মাণের কাজটি করছে।

প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হচ্ছে। এখন ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলা এবং মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা নতুন করে রেল যোগাযোগের আওতায় এসেছে। পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হলে নড়াইল জেলাও যুক্ত হবে।

এমএআর/

 

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *