অনেক আলোচনা-সমালোচনা শেষে ভারতে ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্তের পর লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে ইলিশের দাম। দেশের বাজারে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে দাম। শুধু বাংলাদেশের বাজারেই নয়, ভারতের বাজারে ইলিশ কিনতেও হিমশিম খাচ্ছেন ক্রেতারা। ফলে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে বিপাকে।
অনেক আলোচনা-সমালোচনা শেষে ভারতে ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্তের পর লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে ইলিশের দাম। দেশের বাজারে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে দাম। শুধু বাংলাদেশের বাজারেই নয়, ভারতের বাজারে ইলিশ কিনতেও হিমশিম খাচ্ছেন ক্রেতারা। ফলে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে বিপাকে।
দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে ভারতের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে তিন হাজার টন ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্ত হয়। পরে তা কমিয়ে দুই হাজার ৪২০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মোট ৪৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে খুলনার ফুলতলার লোকজ ফ্যাশন ২০ টন এবং বাকি ৪৮টি প্রতিষ্ঠান ৫০ টন করে রপ্তানির বৈধতা পায়।
এর মধ্যে ঢাকার ১৫টি, যশোরের ১২টি, পাবনার সাতটি, বরিশালের চারটি, খুলনার চারটি, চট্টগ্রামের দুটি এবং সাতক্ষীরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কক্সবাজার, মৌলভীবাজার, নড়াইলের একটি করে প্রতিষ্ঠান আছে। বেনাপোল স্থলবন্দরের মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র জানিয়েছে, প্রতিদিনই ট্রাকে করে ইলিশ যাচ্ছে ভারতে।
ভারতে ইলিশ রপ্তানির প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাজারেও। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো জানায়, ১০ ডলার করে প্রতি কেজি মূল্যে তারা ইলিশ রপ্তানি করছে। তবে, স্থানীয় বাজার থেকে ১৮০০ থেকে ১৯৫০ টাকা কেজি দরে ইলিশ কিনতে হচ্ছে। অর্থাৎ বেশি দামে কিনে কম দামে রপ্তানি করা হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের পুরুলিয়া শহরের রঘুনাথপুরের বাসিন্দা পবিত্র হালদার জানান, পূজা ঘনিয়ে আসতেই হু হু করে দাম বেড়েছে ইলিশের। আমাদের এখানকার বাজারগুলোতে কেজি ওজনের ইলিশ ২১০০ থেকে ২২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছোট সাইজের ইলিশ পাওয়া যায় না দেখে কষ্ট করে হলেও অনেকে বড়টাই কিনছেন। তবে, দামে অসন্তোষ আছে সবার।
পাশের শহর ঝালদার বাসিন্দা ফুল্লোরা সরকার বলেন, দুই বাংলার কোথাও এত দামে হওয়া উচিত না। আসলে আমাদের এই বাংলার (কলকাতা) ইলিশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। শুধু যে দুর্গাপূজার সময় ইলিশ আসে তা কিন্তু না। সারা বছরই বাংলাদেশের ইলিশ পাওয়া যায় বাজারে। আমরা মনে করি ইলিশের বাজার মনিটরিং করছে না কোনো দেশেরই কর্তৃপক্ষ। যে জন্য দাম এতটা লাগাম ছাড়িয়েছে।
রপ্তানির অনুমতি পাওয়া বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে প্রায় সব প্রতিষ্ঠান অনাগ্রহ প্রকাশ করে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কথা বললেও ‘বেশি দামে ইলিশ কিনে কম দামে কেন বিক্রি করছেন’— এর সঠিক উত্তর দিতে পারেননি কেউ।
বরিশাল পোর্ট রোড থেকে মাছ কেনে পাবনার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সেভেন স্টার ফিস প্রসেসিং কোম্পানি লিমিটেড। সেখানকার ব্যবস্থাপক আব্দুল লতিফ বলেন, ‘জেলেদের জালে ইলিশ খুব কম ধরা পড়ছে। সরকার ৫০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন যে পরিমাণের ইলিশ আসছে তাতে ৫০ টন ইলিশ পাঠাতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।’ ইলিশ রপ্তানি করে এবার লোকসান হবে বলেও জানান তিনি।
আব্দুল লতিফ বলেন, স্থানীয় বাজার থেকে চড়া মূল্যে ইলিশ কিনতে হচ্ছে। অথচ রপ্তানি করছি প্রতি কেজি ১০ ডলারে। এ ছাড়া পশ্চিমবাংলায় আমাদের যারা প্রতিনিধি আছেন তারা জানিয়েছেন, ওখানকার ক্রেতাদের মধ্যেও অস্থিরতা বিরাজ করছে। পশ্চিমবাংলাতেও বেশি দামে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। এ জন্য ক্রেতা তেমন পাওয়া যাচ্ছে না।
কথা হয় বরিশালের আরও দুটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, কিছুটা লোকসান হলেও রপ্তানির লাইসেন্স টিকিয়ে রাখতে রপ্তানি অব্যাহত রেখেছেন তারা।
যদিও যশোরের একটি প্রতিষ্ঠান নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেছে, বেশি দামে স্থানীয় বাজার থেকে কিনে কম দামে রপ্তানি করার যে কথা বলা হচ্ছে তা আসলে মিথ্যা। সরকার নির্ধারিত রপ্তানিমূল্যের বাইরে যে টাকা হয় তা বিকল্প (হুন্ডি) পথে দেশে আসে। ওই ব্যবসায়ী জানান, এটি ওপেন সিক্রেট। লোকসান করে কোনো প্রতিষ্ঠান মাছ রপ্তানি করবে না। এমনকি আমিও না। হয়তো অনেকে স্বীকার করবেন না, আবার অনেকে করবেন।
তিনি বলেন, ‘রপ্তানি মূল্য সঠিক দেখিয়ে পাঠালে এত লাভ করা সম্ভব না। বাংলাদেশে থেকে যে মাছ ১৮০০ টাকায় কেনা হয় সেটির পেছনে আরও ১০০ টাকা খরচ হয় প্রক্রিয়াজাত করতে। ওই মাছ ভারতের বাজারে ২১০০ থেকে ২২০০ টাকায় বিক্রি হয়। বাংলাদেশ সরকার ১০ ডলার বেঁধে দিলেও বাকি টাকা ওই পথে ব্যবসায়ীরা আনেন। অথবা পশ্চিমবাংলায় তাদের যে প্রতিনিধি আছেন তার মাধ্যমে দেশে আনেন।’
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক অপূর্ব অধিকারী বলেন, ইলিশের বাজার নিয়ন্ত্রণ আমাদের একার পক্ষে সম্ভব না। এর কয়েক ধাপে স্টেকহোল্ডার আছে। ইলিশ তো ব্যয়বহুল পণ্য এবং রপ্তানি হচ্ছে। এ জন্য বিভিন্ন স্তরে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। আমরা আমাদের স্থান থেকে চেষ্টা করছি মূল্য প্রকাশ্যে আনার। অর্থাৎ আমরা বেশ কয়েকটি অভিযান চালিয়েছি। এ সময় আড়তদারদের চালান রশিদ দেওয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক এবং খুচরা বিক্রেতাদের মূল্যতালিকা প্রদর্শন করতে বলা হয়েছে। কেউ কেউ নির্দেশনা মানছেন, আবার অনেকেই মানছেন না বলে তথ্য পেয়েছি। আমরা পুনরায় অভিযান পরিচালনা করে যারা নির্দেশনা মানছেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
এই কর্মকর্তা বলেন, চালান রসিদ ও মূল্যতালিকা প্রকাশ্যে প্রদর্শিত হলে মূল্যের উল্লম্ফন কমে আসতে পারে।
এফআরএস/