তালপাকা গরমের মাস ভাদ্র শেষ হয়েছে আট দিন আগে। কিন্তু শেষ হয়নি গরমের দাপট। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতির বিরূপ আচরণই জানিয়ে দিচ্ছে ঋতুচক্র বর্ষপঞ্জিতে আটকা পড়েছে। তাই তো আশ্বিনেও তপ্ত রোদ আর অসহ্য তাপমাত্রায় বাড়ছে হাঁসফাঁস। মৃদু তাপপ্রবাহ বাড়তে থাকায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন।
তালপাকা গরমের মাস ভাদ্র শেষ হয়েছে আট দিন আগে। কিন্তু শেষ হয়নি গরমের দাপট। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতির বিরূপ আচরণই জানিয়ে দিচ্ছে ঋতুচক্র বর্ষপঞ্জিতে আটকা পড়েছে। তাই তো আশ্বিনেও তপ্ত রোদ আর অসহ্য তাপমাত্রায় বাড়ছে হাঁসফাঁস। মৃদু তাপপ্রবাহ বাড়তে থাকায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো উত্তরের বিভাগীয় জেলা রংপুরও পুড়ছে প্রখর রোদে। সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে বেড়েছে লোডশেডিং। অসহনীয় গরম আর তাপপ্রবাহে বিমর্ষ প্রাণ-প্রকৃতি। গত দুই সপ্তাহ ধরে এ অবস্থা বিরাজ করছে।
সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সারা দেশের মধ্যে রংপুরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এমন গরমে মানুষসহ হাঁসফাঁস করছে পশু-পাখিও। প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না অনেকেই। সবমিলিয়ে রংপুর মহানগরীসহ জেলার সর্বত্র গরমে বেড়েছে অস্বস্তির মাত্রা।
এদিকে আবহাওয়ার বিরূপ আচরণে রংপুরে বেড়ে চলেছে হিটস্ট্রোক, জ্বর, সর্দি, কাশি ও ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। বিশেষ করে এসব রোগে শিশু ও বয়স্করা আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। এ অবস্থায় চিকিৎসকরা তাপপ্রবাহে প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে নিম্নআয়ের মানুষরা পড়েছেন বিপাকে। সংসার চালাতে বাধ্য হয়েই কাজে যাচ্ছেন তারা। অনেকেই আবার গরম সইতে না পেরে অসুস্থও হয়ে পড়ছেন।
বিভাগের সর্ববৃহৎ চিকিৎসাকেন্দ্র রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালসহ জেলার বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুই সপ্তাহে প্রায় তিন শতাধিক নারী-পুরুষ ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দিসহ মৌসুমী রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।
তা ছাড়া প্রতিদিনই কম-বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তীব্র গরমের কারণে নিম্নআয়ের দিনমজুর, শ্রমিক, ক্ষেত মজুররা হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তিন দিন আগে রমেক হাসপাতালে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত একজনের মৃত্যু হয়েছে।
রমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে কথা হয় এক যুবকের সঙ্গে। প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত দেড় বছর বয়সী শিশু সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন তিনি। ওই যুবক বলেন, কয়েকদিন আগে আমার জ্বর হয়েছিল। এখন মোটামুটি সুস্থ। কিন্তু ছেলেটার জ্বর কমছে না। বাসায় প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছি। সুস্থ হয়ে না ওঠায় হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।
হাসপাতালে নবজাতক, শিশু ও কিশোর রোগ অভিজ্ঞ ডা. মো. মাহফুজার রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, প্রচণ্ড রোদের কারণে এমনটি হয়েছে। প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে জ্বর লক্ষ্য করা গেছে। তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে মানুষজন জ্বর, সর্দি, কাশিসহ নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এজন্য ডাবসহ তরল জাতীয় ফলমূল খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, গরমে অনেকেই হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তাই এ সময় সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। বেশি করে পানি পান, ঠান্ডা জাতীয় পানীয় বিশেষ করে লেবুর শরবত, ডাবের পানি বেশি করে পান করতে হবে।
এদিকে সোমবার দুপুরে চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখা গেছে প্রাণীগুলো শীতল পরশের জন্য ছটফট করছে। তবে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, গরমের কারণে চিড়িখানার প্রাণীদের বিশেষ যত্ন নেওয়া হচ্ছে। খাঁচাবন্দি পশু-পাখির শরীর ঠিক রাখতে ভিটামিন সি ও স্যালাইন খাওয়াচ্ছে। বাঘ এবং সিংহের খাঁচায় দেওয়া হয়েছে বৈদ্যুতিক ফ্যান।
নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ভ্যাপসা গরমে অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন কর্মজীবী মানুষজন। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। তাপপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা বেড়েছে ডাবসহ তরল জাতীয় খাবারের। চলতি পথে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে লেবু ও ফলের শরবত খেয়ে শরীর জুড়িয়ে নিচ্ছেন অনেকে। তরল খাবারের পাশাপাশি কদর বেড়েছে হাত পাখার।
অন্যান্য সময়ের চেয়ে এখন তাপপ্রবাহের কারণে রংপুর নগরীর সড়কগুলোতে মানুষের উপস্থিতি কমে গেছে। বড় বড় শপিংমল, বিপণিবিতান ও মার্কেটগুলো খোলা থাকলেও নেই ক্রেতাদের শোরগোল। অলস সময় পার করছেন ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন পরিবহনের চালক-শ্রমিক-দিনমজুরসহ কর্মজীবী মানুষরা গরম উপেক্ষা করে বের হলেও অনেকেই হাঁসফাঁস করছেন।
রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. মোস্তফা জামান চৌধুরী বলেন, গত কয়েকদিন ধরে তাপমাত্রা ৩৪-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করছে। আবহাওয়া স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হওয়াই ভালো। বিশেষ করে এই সময়ে শিশু-কিশোর ও বয়স্কদের আরও সতর্কভাবে চলাফেরা করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বেশি বেশি করে তরল জাতীয় শরবত, ডাবের পানি পান করা উচিত।
একদিকে বাইরে কড়া রোদের ঝলকানি, বাতাসে গরমের ঝাঁঝ—এমন আবহাওয়ার মধ্যে রংপুরে আবারও শুরু হয়েছে তীব্র লোডশেডিং। বিদ্যুৎ গ্রাহকদের অভিযোগ, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এক ঘণ্টা পর পর লোডশেডিং চলছে। সঙ্গে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকছে। এতে জনজীবনে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।
আবহাওয়া অফিস বলছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ৯ জেলা ও তিন বিভাগের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। ঢাকা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, ফেনী ও সিলেট জেলাসহ রংপুর, রাজশাহী এবং ময়মনসিংহ বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় তা কিছু কিছু জায়গা হতে প্রশমিত হতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ ও সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানিয়েছেন, সোমবার রংপুরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগের দিন রোববার তা ছিল ৩৮.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর গত কয়েকদিন ধরে রংপুর বিভাগে তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে ওঠানামা করছে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএমকে