শিশু সুয়াইবার চোখ এখনও তার মাকে খোঁজে

শিশু সুয়াইবার চোখ এখনও তার মাকে খোঁজে

একটা বুলেট কেড়ে নিলো সব স্বপ্ন। জন্মের পর শিশুদের প্রথম আশ্রয়স্থল মায়ের কোল। সেই কোলেই ঠাঁই হলো না ছোট্ট সুয়াইবার। মুখের কথা ফোটার আগেই চলে গেলেন মা। মা বলে একটিবারের জন্যও ডাকতে পারলো না। সে তো জানেই না মাকে যে সে হারিয়ে ফেলেছে। এমন ভাগ্যই বরণ করতে হলো জন্মের দুই মাস বয়সে। পৃথিবীর নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হতে হলো সুয়াইবার মা সুমাইয়ার।

দুই বছর আগে বিয়ে হয় সুমাইয়ার। কাঁচপুরের একটি ভাড়া বাসায় স্বামী জাহিদ হোসেনকে নিয়ে সুখেই কাটছিল তাদের সংসার। জাহিদ পেশায় পোষাক শ্রমিক। ঘটনার দুই মাস আগে এই দম্পতির ঘরে আসে ফুটফুটে মেয়ে সন্তান সুয়াইবা।

মেয়ে আর নাতনিকে যত্নে রাখতে নিজের কাছে এনে রেখে ছিলেন সুমাইয়ার মা আসমা বেগম।

ঘটনার দিন ২০ জুলাই, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জ সেদিন উত্তাল। কিছুক্ষণ পর পর অনেক নিচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল যৌথ বাহিনীর হেলিকপ্টার। সেই হেলিকপ্টার দেখতেই আগ্রহ নিয়ে বারান্দায় এসে ছিলেন সুমাইয়া।  ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে সুমাইয়াদের (মায়ের বাসা) বাসার অবস্থান। সেই মুহূর্তে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যৌথ বাহিনীর সংঘর্ষ চলছিল। চারদিকে মুহুর্মুহু গুলি ছুড়ছিল যৌথ বাহিনী। হঠাৎ মাথার বাঁ পাশে আঘাত করে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে ঘাতক বুলেট দেয়ালে গিয়ে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে সুমাইয়া লুটিয়ে পড়ে বারান্দার মেঝেতে। হতবিহ্বল হয়ে পড়ে সুমাইয়ার মা আসমা বেগম।

সেদিনের স্মৃতি মনে পড়লে এখনও আঁতকে উঠেন তিনি। তার মেয়ের শেষ স্মৃতিটুকু নিয়ে সেই ভাড়া বাসাতেই এখনও বসবাস করেন সুমাইয়ার মা আসমা বেগম। সেই বারান্দায় এখনও দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। বুলেটে ফুটো হওয়া সেই এসএস পাইপের দিকে তাকিয়ে থাকেন এক দৃষ্টে। এখনও ফুটো হওয়া সেই এসএস পাইপ আর দেয়াল সাক্ষী দেয় সেদিনের ভয়াবহতার। সেই ঘাতক বুলেটটি কাগজে মুড়িয়ে তারা এখনও সংরক্ষণ করে রেখেছেন।

সেই রক্তাক্ত বিকেলের কথা জানতে চাইলে আসমা বেগম বলেন, ‘অনেক নিচ দিয়া হেলিকপ্টার চক্কর মারতাছিল। এ সময় আমি বারান্দায় খাড়াইয়া এইগুলো দেখতেছিলাম। সবাই দেখতাছে, আমিও হেলিকপ্টার দেখমু বইলা আমার মাইয়াডাও বারান্দায় আইসা দাঁড়াইলো হেলিকপ্টার দেখতে। আমাগো বারান্দার কাছ দিয়ে হেলিকাল্টার উইড়া গেলো। রাস্তায় পুলিশের গোলাগুলি চলতাছে। আমার আড়াই মাসের নাতনিডারে শোয়াইয়া আমার লগে আইসা খাড়াইলো আমার মাইয়া (সুমাইয়া)। খাড়ানোর এক-দুই মিনিটের মধ্যেই মাইয়াডা পইরা যাইতাছে দেইখা আমি ধরলাম। লগে লগে আমার হাতেই লুটাইয়া পড়ল। আমি অবাক অইয়া গেলাম। মাইয়ার কপালেত্তে রক্ত বাইর অইয়া আমার হাত ভাইস্যা গেলোগা। আমি চিল্লান দিলাম। পোলারা আইয়া আমার মাইয়ারে ডাক দিল। আমার মাইয়া আর কথা কোইলো না। আমাগো চিৎকারে পাশের মানুষ আইলো। সবাইরে কোইলাম, টেকা লাগলে আমি দিমু। আমার নাতনির লাইগা আমার মাইয়ারে বাঁচান লাগবো। হাসপাতালে লইয়া যাও। সবাই হাসপাতালে নিল। কিন্তু আমার মাইয়ারে আর জীবিত পাইলাম না।’ এসব কথা বলতে গেয়ে আসমা বেগমের চোখ ভিজে আসে পানিতে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষচলাকালে তিনি ও তার মেয়ে সুমাইয়া আকতার নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী নতুন মহল্লার দোয়েল চত্বরে ভাড়া বাসার ৬ষ্ঠ তলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে। ঘাতক বুলেট বারান্দার রেলিংয়ের এসএস পাইপ ভেদ করে (ফুটো করে) সুমাইয়ার মাথার বাম পাশ দিয়ে দেওয়ালে লাগে।

সুমাইয়া আকতারের জন্ম বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের আলিমাবাদ চরনন্দপুর এলাকায়। তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে সুমাইয়া আকতার তৃতীয়। সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ালেখা করার সময় তার বাবা সেলিম মাতুবর মারা যান। অসহায় মা তখন তাদের ভাই-বোনদেরকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে পাড়ি জমান। সেখানে একটি কার্টন ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে সন্তানদের নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা শুরু করেন আসমা বেগম। সুমাইয়া বড় হলে কাঁচপুরে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি শুরু করেন। সেখানে জাহিদ হোসেন নামে তার এক সহকর্মীর সঙ্গে প্রেমের সুবাদে গত দুই বছর পূর্বে তাদের বিয়ে হয়। এরই মধ্যে ১২ মে এক মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন সুমাইয়া। জন্মের পর থেকেই তার মেয়ে সুয়াইবা অসুস্থ থাকায় মায়ের বাসায় উঠেন তারা।

সুমাইয়ার বড় বোন জান্নাত কান্নাজড়িত কণ্ঠে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বোন অনেক শান্ত-স্বভাবের ছিল। কখনো কারও সঙ্গে ঝগড়া করত না। এমনকি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কখনো কথাও বলেনি। সেই বোন আজ গুলির আঘাতে প্রাণ দিল।

এএমকে

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *