শরীরে ৫০০ গুলি নি‌য়ে যন্ত্রণায় কাতরা‌চ্ছে লিটন

শরীরে ৫০০ গুলি নি‌য়ে যন্ত্রণায় কাতরা‌চ্ছে লিটন

স্বপ্ন ছিল শেষ বয়সে বাবা-মায়ের শেষ ভরসা হবে মো. লিটন। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে লিটন এখন পরিবারের বোঝা। গত ৪ আগস্ট ঠাকুরগাঁও শহরের কোর্টচত্বর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। সেই গুলিতে ঝাঝরা হয় লিট‌নের পু‌রো শরীর। 

স্বপ্ন ছিল শেষ বয়সে বাবা-মায়ের শেষ ভরসা হবে মো. লিটন। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে লিটন এখন পরিবারের বোঝা। গত ৪ আগস্ট ঠাকুরগাঁও শহরের কোর্টচত্বর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। সেই গুলিতে ঝাঝরা হয় লিট‌নের পু‌রো শরীর। 

চি‌কিৎসকরা বল‌ছেন, লিট‌নের শরী‌রে এখনও প্রায় পাঁচ‌শ গু‌লি র‌য়ে গে‌ছে। সেই গুলি বের করা সম্ভব না হওয়ায় এখনো হাঁটতে পারছেন না তিনি।

লিট‌নের বাড়ি ঠাকুরগাঁও পৌরশহ‌রের দ‌ক্ষিণ সালান্দর পাড়ার মিলন নগর মহল্লায়। বাবার নাম ইয়াকুব আলী। তিন ভাই‌য়ের মধ্যে লিটন সবার ছোট। তিনি ঠাকুরগাঁও সরকা‌রি ক‌লে‌জের অনার্স প্রথম বর্ষের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। বাবা ইয়াকুব আলী স্যানিটারি স্ল্যাব বি‌ক্রি করে সংসার চালান।

বর্তমা‌নে লিট‌নের চিকিৎসা, সুস্থ হওয়া ও তার কাজে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তার প‌রিবা‌রে। টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে না পেরে বাড়িতে যন্ত্রণা নিয়ে কাতরাচ্ছেন লিটন। অভাবের সংসারে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতে খণ্ডকা‌লীন চাক‌রি  করতেন এক‌টি ওষুধ ফার্মেসিতে। সে‌ চাক‌রিটাও এখন আর নেই।

শনিবার লিট‌নের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বিছনায় কাতরাচ্ছে লিটন। তার পাশে হতাশা আর চিন্তা নিয়ে বসে আছেন তার মা-বাবা। সন্তান সুস্থ হতে পারবে কি না, এ নিয়ে চিন্তিত তারা। মা লি‌লি বেগমের কপা‌লে চিন্তার ভাজ, আর চোখ বেয়ে ঝরছে অশ্রু।

সেদিনের রোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে লিটন বলেন, ছাত্রদের ডাকা সব কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছি। গত ৪ আগস্ট দুুপু‌রে শহ‌রের কোর্ট চত্বরের পূর্ব পা‌শের এক‌টি গলি‌তে শিক্ষার্থী‌দের এক‌টি অংশ অবস্থান ক‌রি। এ সময় পু‌লিশ আমাদের গু‌লি না করার প্রতিশ্রু‌তি দি‌য়ে সেখান থে‌কে চ‌লে যাওয়ার কথা ব‌লে। এ সময় চ‌লে যাওয়ার সময় পেছন দিক থে‌কে আমার মাথায় গু‌লি ক‌রে পু‌লিশ। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। এ‌তে কিছু সময় জ্ঞান হা‌রি‌য়ে ফে‌লি। প‌রে জ্ঞান ফেরার পর উ‌ঠে দাঁড়ালে পুলিশ আমার দিকে আবারও এ‌লোপাতা‌ড়ি ছররা গু‌লি কর‌তে থা‌কে। এ‌তে আমার পা থে‌কে মাথা পর্যন্ত সমস্ত শরী‌র গুলিবিদ্ধ হয়। এ সময় কোনো রকম হামাগু‌ড়ি দি‌য়ে পা‌শের এক‌টি বা‌ড়ি‌তে আ‌শ্রয় নেই। ওই বা‌ড়ির ‌লোকজন আমার রক্ত ঝরা মাথায় কাপড় দি‌য়ে বেঁধে দেন। বা‌ড়ির লোকজন‌কে হাসপাতা‌লে নেওয়ার জন্য বারবার আকুতি জানাচ্ছিলাম। তবে পু‌লি‌শের ভ‌য়ে কেউ আমাকে হাসপাতা‌লে নেয়নি। এক পর্যা‌য়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আমাকেসহ গুলিবিদ্ধ অন্যদের হাসপাতা‌লে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান বলে জানান লিটন। 

সেখানেও ভালো চিকিৎসা পাননি তিনি। প‌রে ওই‌দিন শহ‌রের এক‌টি ক্লি‌নি‌কে অস্ত্রপচার ক‌রে ১২‌টি গু‌লি বের করা হয়।তখন পু‌লিশ ও ছাত্রলী‌গের ভ‌য়ে ক্লি‌নিক ছাড়‌তে হয় তা‌কে। প‌রে ৬ তা‌রিখ পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। সেখানে তিন দিন চিকিৎসার পর রংপুর সেনাবা‌হিনী প‌রিচা‌লিত সিএমএইচ হাসপাতা‌লে দুই সপ্তাহ ভ‌র্তি থা‌কেন। ত‌বে সেখা‌নে অস্ত্রপচার ক‌রে শরীর থে‌কে এক‌টি গু‌লিও বের করা যায়‌নি। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে এখন বাড়িতেই অবস্থান করছেন।

লিট‌নের বাবা ইয়াকুব আলী ব‌লেন, টানাটানির সংসারে ধারদেনা করে ছে‌লের জন্য ওষুধ কিনতে হ‌চ্ছে। বড় স্বপ্ন ছিল ছেলেটা পড়ালেখা শেষ করে একদিন সংসারের হাল ধরবে। পরিবারের অভাব দূর হবে। কিন্তু আমাদের সাজানো স্বপ্ন এখন শেষ হয়ে গেল। সরকা‌রিভা‌বে এখনও কোনো সহ‌যো‌গিতা পাই‌নি।

পু‌রো শরীর জু‌ড়ে গু‌লির ব্যাথায় ছটপট কর‌তে থাকা লিটন ব‌লেন, গুলি লাগার পরে শরীরের প্রত্যেকটা জায়গা যেন অবশ হয়ে আছে। কোন কাজ কাম করতে পারি না। যা কিছু করতে হয় একজন মানুষের সহযোগিতায় করতে হয়। বে‌শিক্ষণ দাঁড়ি‌য়েও থাক‌তে পা‌রি না, ব‌সেও থাক‌তে পা‌রি না। আবার গরম লাগ‌লে ব্যাথার তীব্রতা বে‌ড়ে যায়। সারাক্ষণ বাতাস ও ঠান্ডা জায়গা‌তে থাক‌তে হয়। রা‌তে ঘুমাতে গে‌লে মাথায় বিদ্ধগু‌লির যন্ত্রণায় ঘুম হয় না। বা‌লিশও মাথায় দেওয়া যায় না। এখন সরকারের কাছে একটি চাওয়া আমার গুলি যেন বের করে দেওয়া হয়। পুনরায় আমি যেন স্বাভাবিকভাবে হাঁটা চলাফেরা করতে পারি।

লিট‌নের মা লি‌লি বেগম বলেন, আমা‌দের অভাবের সংসার, কোনো রকম ডাল ভাত খাই‌য়ে জীবন যায়। বিছানায় ব্যথায় কাতরাচ্ছে ছে‌লেটা। এখন ভালো চিকিৎসা করানোর মতো কোনো টাকা-পয়সা আমাদের হাতে নাই।

লিট‌নের বর্তমান চি‌কিৎসক ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতালের সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. শিহাব মাহমুদ শাহরিয়ার বলেন, খুব অসু‌বিধা না হলে এ সব গু‌লি বের কর‌তে অনুৎসাহিত ক‌রি। শরী‌রে এখনও প্রায় পাঁচ‌শ গু‌লি র‌য়ে গে‌ছে। মাথায় যে ১৫‌টি গু‌লি আ‌ছে, এর জন্য ১৫ বার তা‌র অস্ত্রপচার কর‌তে হ‌বে। এ‌তে রোগীর আরও জ‌টিল অবস্থা তৈ‌রি হ‌বে। এছাড়া গু‌লি গু‌লো খুবই ছোট, কে‌টে স‌ঙ্গে স‌ঙ্গে বের করা যা‌বে এমন‌টিও না।প্রতি‌টি গু‌লি খুঁজে বের করা খুব ক্রিটিক্যাল এবং রোগী ও ডাক্তা‌রের জ‌ন্যও কষ্টকর। ত‌বে কোনো গু‌লির কারণে শ‌রী‌রে ইনফেকশন বা পুঁজ বের হলে তখন সেটা আমরা বের করে চি‌কিৎসা দেওয়া হয়। ত‌বে এত বিপুল সংখ্যক গু‌লি বের করা এ‌কেবা‌রে সম্ভব না।

ঠাকুরগাঁওয়ে বৈষম্য বিরোধী আ‌ন্দোল‌নে হতাহতদের চি‌কিৎসার জন্য গ‌ঠিত মেডিকেল উইং‌য়ের দা‌য়িত্বরত সদস্য রা‌কিব ইসলাম ব‌লেন, উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে লিট‌নের শরীরের গু‌লিগুলো য‌দি বের করা যায় তাহলে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে সে। তবে এই চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অর্থ যা জোগাড় করা সম্ভব নয় তার দরিদ্র পরিবারের প‌ক্ষে। এ জন্য সরকা‌রের পাশাপা‌শি সমাজের বিত্তবানদের কাছে তার পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানান এ সমন্বয়ক।

আরিফ হাসান/আরকে

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *