মূল্যস্ফীতির কারণ, প্রভাব ও প্রতিকার

মূল্যস্ফীতির কারণ, প্রভাব ও প্রতিকার

ফারহানা ইয়াসমিন

অর্থনীতির একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা ক্রয়ের জন্য যদি পূর্বের তুলনায় অধিক অর্থ ব্যয় করতে হয় সেটিই হলো মূল্যস্ফীতি। ক্রেতার আয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে অপরিবর্তিত থাকলে তখন এটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)-এর প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এর চেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি ছিল ২০১০-১১ অর্থবছরে। ওই গড় অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি হয় ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ (সমকাল, ০৮ জুলাই ২০২৪)।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, আগস্টে দেশে খাদ্যমূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০১১ সালের অক্টোবরের পর এটি সর্বোচ্চ। গত নভেম্বরে দেশে খাদ্যমূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশে (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩)।

বাংলাদেশ যখন করোনা মহামারি মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল ঠিক তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো। মহামারির অর্থনৈতিক ক্ষতিকে আরও বেশি গভীর করে এই যুদ্ধ। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে—

চাহিদা বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি—২০২১-২২ অর্থবছরে দেখা যায় আমদানি ব্যয় ৭১.৪১ বিলিয়ন ডলার যা প্রায় পূর্বের অর্থবছরের তুলনায় ৪২.২৪ শতাংশের বেশি এবং রেকর্ড পরিমাণ।

এছাড়াও কোভিড পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিতে ভোক্তা ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং চাহিদা সরবরাহকে ছাড়িয়ে যায়, যার ফলে দাম বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির আবির্ভাব ঘটে অর্থনীতিতে। ২০২২ অর্থবছরের পরে আমদানিতে বিলাসজাত দ্রব্যের ওপর এবং বিদেশ ভ্রমণের ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করা হয়।

এই আমদানি কঠোর করার কারণে ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৩ হাজার ২৫০ মিলিয়ন ডলার থেকে নেমে ১৭ হাজার ১৫৫ ডলার হয় বাণিজ্য ঘাটতি।  

খরচ বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি—সারাবিশ্বে খাদ্য ও জ্বালানি দাম বৃদ্ধি দেখা যায় ২০২১-২০২২ অর্থবছর থেকে, বাংলাদেশেও এর প্রভাব দেখা যায়। ফলে আমদানি পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি এবং যদি কাঁচামাল বা উৎপাদন সম্পর্কিত পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায় তাহলে চূড়ান্ত পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে প্রভাব পড়ে।

যদিও পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও বাংলাদেশে দাম কমার কোনো লক্ষণ ছিল না। এছাড়া সরবরাহ ব্যাঘাতজনিত সমস্যা, উচ্চ মজুরি, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, আমদানি নিষেধাজ্ঞা, ক্রেতা দ্বারা খাদ্য মজুত এসব সমস্যার কারণে খরচ বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতির সম্মুখীন হয় বাংলাদেশ।

মুদ্রার অবমূল্যায়ন—যখন অর্থনীতিতে বাণিজ্য ঘাটতি খুব চড়া হয়ে থাকে তখন আমদানি নিরুৎসাহিত এবং রপ্তানি উৎসাহিত করার লক্ষ্যে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা হয়, কারণ মুদ্রার অবমূল্যায়নে রপ্তানি তুলনামূলক সস্তা হয় এবং আমদানিতে দাম বৃদ্ধি পায়। চলতি হিসাবে ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে, বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণ এবং বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে টাকার অবমূল্যায়ন করা হয় যা প্রায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পায় ২০২৩ অর্থবছরে।

যদিও আইএমএফ-এর মতে এই অবমূল্যায়নের প্রভাব পড়ে আমদানি পণ্যের উপর তথা দেশীয় উৎপাদকের উপর, ফলে দেশীয় উৎপাদক এই বর্ধিত দাম ক্রেতার উপর চাপিয়ে দেন।

এফএও-এর তথ্যে দেখা যায় বাংলাদেশ খাদ্য আমদানিতে ৩য় এবং ২০২১ সালে খাদ্য আমদানি করে প্রায় ১২ মিলিয়ন টন। মুদ্রার অবমূল্যায়ন রপ্তানিবান্ধব দেশের জন্য সহায়ক হয়ে থাকে, তাই বিশ্বের অন্যান্য দেশে দাম কমার ধারা দেখা মিললেও বাংলাদেশ আমদানি নির্ভর দেশ হওয়ায় মুদ্রার অবমূল্যায়নে এই ধারা কমার বিপরীতে বেড়েই চলছে।    

এছাড়া বিশ্ব ব্যাংকের মতে, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে শিল্প-সেবাখাত, রপ্তানি চালানসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন ঘটে। একই সাথে সাউথ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলো মূল্যস্ফীতিতে উন্নতির দিকে থাকলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সুখবর নেই ২০২৫ অর্থবছরে।

এপ্রিলে অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ এবং মে তে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ সব মিলিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো ও খাদ্যশস্য ফলন ও সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। অন্যদিকে সিপিডির তথ্যমতে, পূর্বাঞ্চলের বন্যায় প্রায় ১৪,৪২১.৪৬ কোটি টাকার সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে যা প্রায় ১.৮১ শতাংশ জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫ অর্থবছরের।

উল্লেখিত কারণগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে বলে তাদের অভিমত। সাথে রয়েছে মজুতদারদের দ্বারা পণ্যের কৃত্রিম সংকট করে দাম বাড়ানো অধিক মুনাফার লক্ষ্যে। 

মূল্যস্ফীতির প্রভাব—যদিও মনে করা হয় মৃদু মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য মঙ্গল কিন্তু অধিক হারে মূল্যস্ফীতি ঋণাত্মক প্রভাব সৃষ্টি করে থাকে। অধিক মূল্যস্ফীতির সাথে প্রকৃত মজুরির একটি বিরোধ রয়েছে। এই বিরোধ যদি দীর্ঘদিন চলতে থাকে তবে স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর এর প্রভাব পড়ে বেশি, তখন মজুরি বৃদ্ধির দাবি উঠতে পারে এবং শিল্প-কারখানায় অসন্তোষ দেখা দিতে পারে।

এছাড়া বিনিয়োগ এবং উৎপাদনে প্রভাব পড়ে কাজ হারানোর শঙ্কা থাকে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির প্রভাব সবার জন্য সমান নয়। এর সাথে উচ্চবিত্তরা খাপ খাইয়ে নিতে পারেন যেখানে নিম্নআয়ের মানুষ প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে অপারগ হয়ে পড়ে।

অনেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করতে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে অথবা সঞ্চয় ভেঙে চলছে আবার অনেকে মৌলিক চাহিদা মেটাতে অপারগ হয়ে জীবনযাত্রার ব্যয় কমাচ্ছেন ফলে অপুষ্টিতে ভুগছেন নিম্নআয়ের ভোক্তা। 

অন্যদিকে প্রয়োজনের তুলনায় কম পুষ্টি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ঝুঁকি বাড়ায়। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি সামাজিকভাবে জীবনযাপনের মান কমিয়ে সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে থাকে। 

দীর্ঘকালীন মূল্যস্ফীতি একটি অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি করে। তাই এটি নিরসনে কার্যকরী ভূমিকা প্রয়োজন। যেহেতু বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ এবং একই সাথে কৃষিপ্রধান ও কৃষিনির্ভর দেশ। তাই খাদ্য নিরাপত্তা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মানবসৃষ্ট এবং প্রকৃতিসৃষ্ট দুর্যোগগুলো আগাম মোকাবিলার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকা জরুরি।

বাজার ব্যবস্থাপনাকে মনিটরিং করার ব্যাপারে হতে হবে আরও কৌশলী। পণ্য আমদানিতে দেরি হলে সেই সুযোগ দাম বাড়িয়ে মুনাফা অর্জন যাতে না করা যায় সেইজন্য আমদানি যেন সময়মতো হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি। পণ্য সরবরাহ এবং চাহিদার মাঝে যাতে খুব একটা অসামঞ্জস্য এবং দীর্ঘ সময় ব্যয় না হয়।

সবশেষে টাকার অবমূল্যায়ন কমাতে যথাযথ ও শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। ডলার সংকট কাটিয়ে ওঠার পথ বের করতে হবে নিখুঁতভাবে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে মূল্যস্ফীতির আঘাত প্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা অধিক বলেই এটি নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে বেশি।

ফারহানা ইয়াসমিন ।। প্রভাষক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *