মুন্সীগঞ্জে ৬০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে বিস্ময়কর ইটের পুল

মুন্সীগঞ্জে ৬০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে বিস্ময়কর ইটের পুল

মুন্সীগঞ্জে বিস্ময়কর স্থাপনার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘ইটের পুল’। সেতুটির নির্মাণকাল ও নির্মাতা সম্পর্কে সুপষ্টভাবে ধারণা না থাকায় স্থানীয়রা এটিকে ‘গায়েবি ব্রিজ’ও বলেন। স্থানীয়দের মতে, এক রাতের মধ্যেই অলৌকিকভাবে এই ব্রিজটি তৈরি হয়েছিল।

তবে ধারণা করা হয়, পুলটি নির্মিত হয়েছিল মোগল আমলে ১ হাজার ৭০০ শতকে রাজা বল্লাল সেনের সময়। এটি করতে শুধু ইট, চুন আর সুড়কি ব্যবহার হয়েছে। রড সিমেন্টের ব্যবহার ছাড়াই তিন খিলান বিশিষ্ট সেতুটি দাঁড়িয়ে আছে ৬০০ বছরের বেশি সময় ধরে।

টঙ্গিবাড়ী উপজেলা কমপ্লেক্স থেকে সাত কিলোমিটার দক্ষিণে ও মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে সাত কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে মূল সেতুটি অবস্থিত। ধনুকাকৃতির পুলঘাটার ইটের পুলটির দৈর্ঘ্য ৫২ দশমিক ৫০ মিটার এবং প্রস্থ ৬ মিটার। বিভিন্ন সময় সংস্কার করার ফলে সেতুটির আদিরূপ অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে সেতুটি রক্ষণাবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ।

এই পুলটি সদর উপজেলা ও টঙ্গীবাড়ি উপজেলার মধ্যে বন্ধন তৈরি করে রেখেছে। পুলটির পশ্চিম পাশে টঙ্গীবাড়ি উপজেলার আবদুল্লাহপুর আর পূর্ব প্রান্তে সদর উপজেলার পুলঘাটা গ্রাম।

অবহেলা-অযত্নে সেতুর নিচে এবং ওপরের আস্তর থেকে ইট উঠে যাওয়ায় পুলটি দিন দিন বিনষ্ট হচ্ছে। অমূল্য এই স্থাপত্যটি কয়েকবার সংস্কার করা হলেও সংরক্ষণের অভাবে এখন জৌলুসহীন, ধ্বংসের পথে। পুরাকৃর্তি অধিদফতরের একটি সাইনবোর্ড লাগিয়েই যেন দায়িত্ব সেরেছে কর্তৃপক্ষ।

পুরাতন হওয়ায় পুলটির দুইপাশের রেলিঙের কিছু ইট খুলে পড়েছে। স্থানীয়রা আবার সেসব স্থান থেকে আরও ইট খুলে নিয়ে যাচ্ছেন।

এ ছাড়া পুলটির মাঝে ফাটল দেখা দিয়েছে। ঝুঁকি নিয়েই সেতুটির ওপর দিয়ে প্রতিনিয়ত চলাচল করে অটোরিকশা, সাইকেল, মোটরসাইকেলসহ ছোটখাটো যানবাহন। অর্ধবৃত্তের মতো এই পুলটির নিচে পানি প্রবাহ ও নৌ চলাচলের জন্য তিনটি স্থান আছে।

দু’পাশের দুইটি ছোট আকারের হলেও মাঝেরটি বেশ বড়। সদর উপজেলার কমলাঘাট হতে টঙ্গিবাড়ী উপজেলার মধ্য দিয়ে দীঘিরপাড়-হাসাইল খালের ওপর এই পুলটি নির্মিত। এই খালটি পদ্মা থেকে ধলেশ্বরী নদীতে যুক্ত হয়েছে। এই খাল দিয়ে দীর্ঘকাল ধরে লঞ্চসহ বিভিন্ন নৌযান চলাচল করলেও সেতুটির কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে বর্তমানে এই ঐতিহ্যবাহী খালটি দখল ও দূষণে মৃতপ্রায়। লঞ্চতো দূরের কথা, নৌকাও ঠিকমতো চলতে পারে না। শুষ্ক মৌসুমে খালটি একবারেই শুকিয়ে যায়। তবে বর্ষা মৌসুমে খালে পনি থাকায় বেশ কিছু নৌকা চলতে দেখা যায়। তবে পুলটির দক্ষিণ প্রান্তে একাধিক স্থানে খালের মধ্যে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। দখল হয়ে যাচ্ছে খালটি।

সরেজমিনে দেখা যায়, সেতুর রেলিঙের বিভিন্ন জায়গায় ইট ভেঙে আছে। সেসব স্থান থেকে আরও ইট খুলে নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। এছাড়া সেতুটির নিচের অংশের চুন ও সুড়কির আস্তরণ উঠে গেছে। সেতুর পাশেই দেওয়াল ঘেঁষে ইট-বালুর ব্যবসা চলছে। সেতুর পূর্ব পাশের দক্ষিণ দিকে ১০ গজের মধ্যেই স্থানীয় কয়েকটি নির্মাণাধীন দোকানঘর। পুলটি ঘেঁষে পুলের দক্ষিণ পাশে দিয়ে খালের ওপর বালু ব্যবসায়ীরা তাদের ড্রেজারের পাইপ লাইন স্থাপন করে ব্যবসা করছেন। এতে ওই খালে নৌযান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।

প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসুরা সেতুটি দেখতে আসেন। ঈদ, পূজা ও পয়লা বৈশাখের মতো উৎসবের দিনে শত শত দর্শনার্থীর ভিড় জমে পুলটিতে। বিনোদন প্রত্যাশী মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে প্রতিদিন। বিদেশিরাও আসেন মাঝে মধ্যে। অথচ ঐতিহ্যের স্মারক এ সেতুটি সংস্কারের ও সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পুরাতন এ সেতুটি মীর কাদিম খালের ওপর নির্মিত। আর স্থানীয়রা দাবি করেন এটি সেন রাজা নির্মাণ করেছেন। কিন্তু স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য অনুসারে এটি সম্পূর্ণরূপে মোঘল আমলের এবং সেতুটি ১৭ শতাব্দীর আগের না বলেও মত দেন অনেকে। সেতুটিতে তিনটি খিলানের মধ্যে কেন্দ্রীয় খিলানটি ৪ দশমিক ২৫ মিটার প্রশস্ত এবং পাশের দু’টি খিলান ২ দশমিক ১৭ মিটার প্রশস্ত।

২০০৬ সালে সেতুটি সংরক্ষণের আওতায় নেয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। সেতুটির সংস্কার করে এর দুই পাশে দুটি সতর্কীকরণ নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হয়। ওই নোটিশে সেতুর দেওয়ালে কোনো কিছু লেখাসহ অবকাঠামোর ক্ষতিসাধন করা দণ্ডনীয় অপরাধের সতর্কবার্তা ছিল। কিন্তু সেতুর নিচ দিয়ে ট্রলারসহ নৌযান যাওয়ার সময় সেতুতে আঘাত লাগায় দুই পাশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

স্থাণীয়রা জানান, এই পুলটি মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতি বহন করছে। মুক্তিযোদ্ধারা এই পুলটি কেন্দ্র করে ক্যাম্প তৈরি করেছিলেন এবং পাকি বাহিনীদের প্রতিরোধে নানা পরিকল্পনা ছাড়াও ব্রিজের এপার-ওপার সম্মুখযুদ্ধও হয়েছিল। ব্রিজের পাশের টোকানী পালের বাড়িতে পাকি বাহিনী নির্মম গণহত্যাও চালিয়েছিল।

তমিজউদ্দিন মিয়া (৮০) নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, ‘সেতুটি কারা বানাইছে কেউ বলতে পারে না। তাই এটিকে গাইবি ব্রিজ কয়। সবাই কয় এটি ৫০০ বছরের পুরানো। পুলাপাইনে ইট উঠাইয়া নিয়া যাইতেছে। দূর-দূরান্ত থেকে এ ব্রিজটি মানুষ দেখতে আসে। পোলাপাইন সরকারি এই সম্পত্তি নষ্ট করে ফেলাইতেছে।’

স্থানীয় আলাউদ্দিন (৭০) বলেন, আমি জন্মের পর থেকে ব্রিজটি এমনই দেখতেছি। আমার বাব দাদারাও এমন দেখছে। কে কবে এই ব্রিজ বানিয়েছে কেউ বলতে পারে না । অনেকে কয় ব্রিজটি গাইবি উঠছে। কয়েক বছর আগে ব্রিজটি ইট, সুড়কি, তেঁতুলের পানি, রসুনের পানি দিয়ে ঠিক করছে। এখন আবার অনেক জায়গায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক হালিমা আফরোজ বলেন, আমাদের ঢাকা বিভাগের ১০২টি স্থাপনা আছে। এগুলো পর্যায়ক্রমে আমরা সংস্কার করে থাকি। তবে এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সংস্কার করা হয়। মীর কাদিম খালের ওপর নির্মিত ইটের পুলটিও পর্যায়ক্রমে পুনরায় আবার সংস্কার করা হবে।

ব.ম শামীম/এফআর/এএমকে

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *