মিতু হত্যা : যে যুক্তিতে এখনই জামিন চান বাবুল আক্তার 

মিতু হত্যা : যে যুক্তিতে এখনই জামিন চান বাবুল আক্তার 

দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় জামিন আবেদন করেছেন সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার।

দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় জামিন আবেদন করেছেন সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তার।

বুধবার (১৪ আগস্ট) চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে এ আবেদন করা হয়।

১৮ পৃষ্ঠার জামিন আবেদন দীর্ঘ এক ঘণ্টা ২০ মিনিট শুনানি হয়েছে। এতে জামিনের পক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরেন বাবুল আক্তারের আইনজীবীরা। পাশাপাশি জামিনের বিরোধিতা করে পাল্টা যুক্তি তুলে ধরেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আগামী ১৮ আগস্ট এ বিষয়ে আদেশ প্রদানের তারিখ ধার্য করেছেন আদালত।

বাবুল আক্তারের আইনজীবীরা জানান, ফৌজদারি কার্যবিধি ৩৩৯ এর সি ধারায় বলা আছে, বিচারাধীন মামলা যদি ৩৬০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে না পারে, সেক্ষেত্রে আসামিকে জামিন দিতে হবে। মামলাটির এর বেশি সময় ধরে বিচারাধীন আছে। এ বিবেচনায় আসামি জামিন পেতে পারেন। আবার মামলাটিতে ৯৭ জনের মধ্যে মাত্র ৫২ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আরও অনেকের সাক্ষ্যগ্রহণ বাকি আছে। মামলাটি কখন নিষ্পত্তি হয় সেটি বলা যায় না। বিচারকার্য শেষে বাবুল আক্তার তো নির্দোষ প্রমাণিত হতে পারেন, সেক্ষেত্রে উনি যে জেল কাটছেন এটি অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচিত।

অ্যাডভোকেট মামুনুল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আদালতে আমরা একটা বিষয় উল্লেখ করেছি। এ মামলার প্রত্যেক ধার্য তারিখে পিবিআইয়ের চার থেকে সাত জন লোক আদালতে আসেন। তারা সাক্ষীদের নজরদারিতে রাখতেন, যাতে তারা রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন। এছাড়া আলোতে সাক্ষ্য দেওয়ার আগে তাদের গোপন স্থানে আটকে রেখে ট্রেনিং করাতেন। হত্যাকাণ্ডের পর তৎক্ষণাৎ বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তোলেননি শ্বশুর বাড়ির লোকজন। পাঁচ বছর পরে এসে তারা নতুন বক্তব্য উপস্থাপন করছেন।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করেছে বর্তমানে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেককে জামিন দেওয়া হচ্ছে, এটিকে যাতে সেভাবে বিবেচনা করা না হয়। তখন আমরা করতে বলেছি এটা রাজনীতির নয়, এর থেকেও বেশি কিছু। পিবিআইয়ের সাবেক প্রধান বনজ কুমার মজুমদার তার জুনিয়র সহকর্মী বাবুল আক্তারের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিলেন। এটি বুঝার জন্য একটি উদাহরণ দিই। ইউটিউবার ইলিয়াস হোসেন ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন আমেরিকা থেকে। ওইসময় বাবুল আক্তার কারাগারে ছিলেন। বনজ কুমার ওই মামলায় বাবুল আক্তারকে আসামি করেছেন। একই সঙ্গে বাবুল আক্তারের ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধ বাবাকেও আসামি করা হয়েছে। এছাড়া বাবুল আক্তারের প্রতি বনজ কুমারের বিদ্বেষমূলক আচরণ আগেও মিডিয়ায় আসছে বিভিন্নভাবে।

বাবুলের আইনজীবীরা জানান, বাবুল আক্তারের মামলায় মোটরসাইকেল যে সরবরাহ করছে তাকে সাক্ষী বা আসামিও করা হয়নি। গুলি করার সময় ভিডিওতে দেখা গেছে, পেছন দিয়ে কালো মাইক্রোবাস যেতে। ওই গাড়িটি জব্দ করা হয়নি। গাড়িচালক বা  মালিককে কাউকে আসামি বা সাক্ষী করা হয়নি। ওই সময় মিডিয়াতে ওই গাড়িচালককে আটক বলে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু তাকে আটক বা সাক্ষী হিসেবে দেখানো হয়নি। যদিও তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছিলেন। এখন মাইক্রোবাসে কারা কারা ছিল বা সেটি আদৌ ব্যাকআপ টিম কি-না সেটি জানা যায়নি।

আবার পিবিআই যে বিকাশে লেনদেনের কথা বলা হয়েছে। অথচ বিকাশ কোম্পানিই চিঠি দিয়ে বলেছে ওই নম্বরগুলো অ্যাকাউন্ট হিসেবে নিবন্ধিত না। আবার বিকাশ ট্রানজেকশনে যারা জড়িত, তাদের আসামি না করে সাক্ষী করা হয়েছে। কিলিংয়ের ক্ষেত্রে অস্ত্র সরবরাহকারী যদি আসামি হয়, অর্থ সরবরাহকারীও তো আসামি। গায়ত্রী নামে এক নারীর সঙ্গে বাবুল আক্তারের প্রেমের সম্পর্ক ছিল এবং এটি জানাজানি হওয়ায় স্ত্রীকে খুন করেছে বাবুল এ রকম একটা বিষয় প্রতিবেদন উল্লেখ করেছে পিবিআই। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের আরও এক বছর আগে এই গায়ত্রী বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়। তার হাতের লেখা পিবিআই সংগ্রহ করছে। এক্ষেত্রে তালিবান নামে যে বইটি বাবুল ডাক্তারকে উপহার দেওয়া হয়েছে সেখানে গায়ত্রী স্বাক্ষর আছে। আবার গায়ত্রীর স্বাক্ষর একটি ব্যাংকের কক্সবাজারের  শাখায় সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়নি, যে তালিবান বইয়ের স্বাক্ষর আদৌও গায়ত্রীর কি না। প্রকৃতপক্ষে তালিবান বইয়ে গায়ত্রীর নাম ভুল লিখা আছে। প্রেম নিবেদন করে যে বই উপহার দিয়েছেন, সেখানে কী গায়ত্রী নিজের নাম ভুল লিখেছেন।

অ্যাডভোকেট মামুনুল হক চৌধুরী বলেন, সবমিলিয়ে আমরা বলছি বাবুল আক্তার ষড়যন্ত্রের শিকার। পেশাগত জীবনে রিয়াজ উদ্দিন বাজারে স্বর্ণের চোরাচালান আটক নিয়ে তার সঙ্গে বনজ কুমারের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। জঙ্গি দমনে তার একটা উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। এ কারণে ষড়যন্ত্র করে তাকে এ মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট দুলাল দেবনাথ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসামি পক্ষ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের একটা সুযোগ নিতে চাচ্ছে। আজ (বুধবার) তারা বিশেষ জামিন আবেদন করেছেন। আমরা এর বিরোধিতা করেছি। আদালত এখনো আদেশ দেয়নি। আগামী রোববার (১৮ আগস্ট) আসামি পক্ষকে আইনি কিছু কাগজ জমা দিতে বলেছেন। ওইদিন আদেশের দিন ধার্য করেছেন আদালত।

জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরের নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ওই সময় এ ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়। ঘটনার সময় মিতুর স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। ঘটনার পর চট্টগ্রামে ফিরে তৎকালীন পুলিশ সুপার ও মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতপরিচয়দের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।

তবে মামলাটিতে স্ত্রী হত্যাকাণ্ডে স্বামী বাবুল আক্তারেরই সম্পৃক্ততা পায় পিবিআই। ২০২১ সালের ১২ মে আগের মামলাটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। একই দিন বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানায় দ্বিতীয় মামলাটি দায়ের করেন মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন। ওইদিনই মামলাটিতে বাবুল আক্তারকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করে পিবিআই। সেই থেকে কারাগারে রয়েছেন বাবুল।

এদিকে, প্রথম মামলায় পিবিআইয়ের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর নারাজির আবেদন করেন বাবুলের আইনজীবী। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ৩ নভেম্বর নারাজি ও পিবিআইয়ের প্রতিবেদন খারিজ করে মামলাটি অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। এরপর দুটি মামলাই তদন্ত করতে থাকে পিবিআই। তবে পরবর্তী সময়ে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি মিতুর বাবার দায়ের করা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এরপর একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রথম মামলাটি অধিকতর তদন্ত শেষে বাবুলসহ ৭ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়।

গত বছরের ১৩ মার্চ আলোচিত মামলাটিতে বাবুল আক্তারসহ সাত আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। 

এমআর/এসকেডি

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *