ভারতের উত্তরাখণ্ডে অহিন্দু-রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা

ভারতের উত্তরাখণ্ডে অহিন্দু-রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা

‘‘গ্রামে অহিন্দু, রোহিঙ্গা মুসলিম ও ফেরিওয়ালাদের ব্যবসা করা বা ঘোরা নিষিদ্ধ।’’ ভারতের পার্বত্য রাজ্য উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপ্রয়াগ জেলায় কয়েকটি বোর্ড লাগানো হয়েছে; যেখানে এভাবেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট গ্রামে ফেরি বিক্রেতার পাশাপাশি অহিন্দু এবং রোহিঙ্গা মুসলিমদের ব্যবসা কিংবা ঘোরাফেরা করা নিষিদ্ধ।

‘‘গ্রামে অহিন্দু, রোহিঙ্গা মুসলিম ও ফেরিওয়ালাদের ব্যবসা করা বা ঘোরা নিষিদ্ধ।’’ ভারতের পার্বত্য রাজ্য উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপ্রয়াগ জেলায় কয়েকটি বোর্ড লাগানো হয়েছে; যেখানে এভাবেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট গ্রামে ফেরি বিক্রেতার পাশাপাশি অহিন্দু এবং রোহিঙ্গা মুসলিমদের ব্যবসা কিংবা ঘোরাফেরা করা নিষিদ্ধ।

সার্বজনীন জায়গায় লাগানো বোর্ডগুলোতে এই বার্তা ‘সতর্কতার’ জন্য লেখা হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছে। বোর্ডের এই লেখাকে ঘিরে বিতর্ক শুরু হলে মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিরা উত্তরাখণ্ড পুলিশের ডিজি অভিনব কুমারের সঙ্গে দেখা করে আপত্তি জানান। পুলিশ প্রশাসনের দাবি এই ‘সতর্ক বার্তা’ দেওয়া বোর্ডগুলোর বিষয়ে তারা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। একই সঙ্গে এই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপও নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন পুলিশের ওই কর্মকর্তা।

বোর্ডের বিষয়টি এমন এক সময়ে সামনে এসেছে যখন পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এক কিশোরীর শ্লীলতাহানির ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি রুদ্রপ্রয়াগের পার্শ্ববর্তী চামোলি জেলায় এক কিশোরীকে শ্লীলতাহানি করার অভিযোগ ওঠে। অভিযুক্ত একজন মুসলিম যুবক। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

বোর্ডে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও উত্তরাখণ্ডে এই সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতি সম্পর্কে কোনও সরকারি পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।

যে গ্রামগুলোতে এই জাতীয় বোর্ড লাগানো হয়েছে সেই তালিকায় ন্যালসুও রয়েছে। রুদ্রপ্রয়াগ জেলার উখীমঠ ব্লকের অন্তর্গত এই গ্রামের প্রধান হলেন প্রমোদ সিং। ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে গ্রাম প্রধান প্রমোদ সিংয়ের সঙ্গে কথা বলেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

তিনি বলেছেন, ‘‘আমার গ্রামে বোর্ডে যা লেখা ছিল তা বদলে দেওয়া হয়েছে। আগে বোর্ডে অহিন্দু ও রোহিঙ্গা মুসলিম লেখা ছিল। এখন তার পরিবর্তে ফেরিওয়ালাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ লেখা হয়েছে।’’

কিন্তু কেন এই বার্তা জিজ্ঞাসা করা হলে বিষয়টির ব্যাখ্যা করে প্রমোদ সিং বলেন, ‘‘আসলে গ্রামে আসা বেশিরভাগ ফেরিওয়ালাদের (পরিচয়ের) কোনো ভেরিফিকেশন (যাচাই) নেই। ভবিষ্যতে যাতে কোনও ঘটনা না ঘটে সেই জন্য এভাবে লেখা হয়েছিল।’’

তবে বোর্ডে অহিন্দু ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের মতো শব্দের ব্যবহার যে ঠিক নয় সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন এই গ্রাম প্রধান। তার দাবি, বোর্ড লাগানোর আগেই সে কথা তিনি জানিয়েছিলেন। যদিও কারা ওই বোর্ড লাগিয়েছেন সে বিষয়ে জানেন না বলে দাবি করেছেন তিনি।

প্রমোদ সিংয়ের কথায়, যারা এই বোর্ড লাগিয়েছেন, তাদের আমরা আগেই জানিয়েছিলাম যে এটা লেখা ঠিক নয়। তবে ওই ব্যক্তিরা (যারা বোর্ড লাগিয়েছেন) কোন সংগঠনের সদস্য তা আমি জানি না।

বিবিসি আরও কয়েকটা গ্রামের প্রধানের সঙ্গে কথা বললেও তারা এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। রুদ্রপ্রয়াগের বাসিন্দা অশোক সেমওয়াল। তিনি ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সঙ্গে যুক্ত। তার দাবি, সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই বোর্ডগুলো লাগানো হয়েছে।

সেমওয়াল বলেন, কয়েকটা গ্রামের প্রধান এবং কিছু সংগঠনের তরফে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য এই বোর্ডগুলো লাগানো হয়েছে। বিষয়টার সূত্রপাত কেদার ঘাঁটি থেকে, তারপর সবাই একে অন্যদের দেখে এই বোর্ড লাগিয়েছে।

ফেরিওয়ালাদের প্রবেশ নিষেধ করার পেছনে তার যুক্তি বাজারেই যখন ব্যবসা করা যায়, তখন গ্রামে আসার কী প্রয়োজন? সেমওয়াল জানিয়েছেন, পুলিশের পক্ষ থেকে ওই বোর্ডের লেখায় সংশোধন করতে বলা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ ও কয়েকজনের পক্ষ থেকে বোর্ডের লেখায় সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে বোর্ডে কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে নিয়ে না লিখে বহিরাগত লেখা হোক। আমার গ্রামে যেমন এমন একটা বোর্ড রয়েছে। সেটা আমরা সংশোধন করে দেব।’’

রুদ্রপ্রয়াগের পার্শ্ববর্তী জেলা চামোলির নন্দনগর ঘাট এলাকায় সম্প্রতি আরিফ নামে এক মুসলিম যুবকের দোকানে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয় বলে অভিযোগ। ওই যুবকের বিরুদ্ধে স্থানীয় এক নাবালিকাকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ রয়েছে।

শ্লীলতাহানির ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আসার পরই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সদস্যরা স্থানীয় বাজারে মিছিল বের করে স্লোগান দিতে থাকেন। এরপর ওই অভিযুক্ত যুবকের সেলুনে ভাঙচুর চালানো হয়। সেই সময় আশপাশের অন্য মুসলিম ব্যবসায়ীদের দোকানকেও নিশানা করা হয়।

দু’দিন পর অভিযুক্ত ওই যুবককে উত্তরপ্রদেশের বিজনৌর জেলার সোফতপুর গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদিকে বাজারে ভাঙচুরের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। এলাকায় শান্তি বজায় রাখতে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতার ১৬৩ ধারা জারি করা হয়েছিল।

উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, বাজারে ভাঙচুরের ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কড়া আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরপর ওই এলাকায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতির ওপর কড়া নজরদারি রাখতে পুলিশ বাহিনীর সক্রিয়তাও বেড়েছে।

বোর্ডের বিষয় প্রকাশ্যে আসার পর এ নিয়ে আপত্তি জানানো হয়েছে। অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের (এআইএমআইএম) উত্তরাখণ্ড রাজ্য ইউনিটের সভাপতি ড. নইয়ার কাজমির নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল ডিজিপি অভিনব কুমারের সঙ্গে দেখা করেছেন।

রুদ্রপ্রয়াগে লাগানো বোর্ড এবং চামোলির নন্দনগর ঘাটের (বাজারে ভাঙচুরের) ঘটনার কথা ডিজিপিকে জানান তারা।

ড. নইয়ার কাজমি বলেন, এই নিয়ে আমরা উত্তরাখণ্ড পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল অভিনব কুমারের সঙ্গে দেখা করেছি। তাকে রুদ্রপ্রয়াগে এই ধরনের বোর্ড সম্পর্কে অবহিত করেছি এবং সেই ছবিও দেখিয়েছি। ডিজিপি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন, এই বিষয়ে তারা তদন্ত করবেন এবং যারা পরিবেশ নষ্ট করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দেরাদুন শহরের কাজী মাওলানা মোহাম্মদ আহমেদ কাসমির নেতৃত্বে মুসলিম সেবা সংগঠনের আরেকটি প্রতিনিধি দল ডিজিপি অভিনব কুমারের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি জমা দিয়েছে।

আহমেদ কাসমি বলেছেন, এই স্মারকলিপিতে গাড়োয়াল ও কুমায়ুনের পার্বত্য অঞ্চলে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে ক্রমবর্ধমান মামলার সংখ্যা সম্পর্কে বলা হয়েছে। মুসলিম সেবা সংগঠনের সভাপতি নঈম কুরেশি বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ দেশে সংবিধান প্রত্যেক ভারতীয়কে এই অধিকার দিয়েছে চাইলে কেউ গোটা ভারতের যে কোনও জায়গায় এসে বসবাস করতে পারেন।

তিনি বলেন, যে ধরনের বোর্ড লাগানো হয়েছে তা নিন্দনীয়। এই ঘটনা প্রমাণ করে প্রশাসন তার দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করতে পারছে না। নঈম কুরেশি বলেছেন, বোর্ডের বিষয়ের পাশাপাশি চামোলির ঘটনা সম্পর্কেও দুঃখপ্রকাশ করেছেন ডিজিপি অভিনব কুমার।

রুদ্রপ্রয়াগ জেলার পুলিশ বলছে, যে বোর্ডগুলো ঘিরে এই বিতর্ক সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। একইসঙ্গে জানানো হয়েছে এই মামলায় তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রুদ্রপ্রয়াগের ডেপুটি পুলিশ সুপার প্রবোধ কুমার ঘিলদিয়াল বলেন, আমরা এই বিষয়ে খবর পেয়েছি। সমস্ত গ্রাম প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকও করেছি। দিন দুয়েক আগে এই বিষয়টা আমাদের নজরে আসার পরই গ্রাম প্রধানদের সঙ্গে কথা বলি।

তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের ঘটনা না ঘটে। তবে তিনি জানিয়েছেন শুধুমাত্র মাইখণ্ডা গ্রামেই এই জাতীয় বোর্ড রয়েছে বলে তার কাছে তথ্য আছে।

প্রবোধ কুমার বলছেন, এই মুহূর্তে আমাদের কাছে খুব বেশি তথ্য নেই। এই পর্যন্ত যে বোর্ডগুলো সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে ঘটনার পেছনে করা রয়েছেন, সে বিষয়ে পুলিশের কাছে এখন পর্যন্ত তথ্য নেই বলে দাবি করেছেন তিনি।

তিনি বলেন, আপাতত বোর্ডগুলো কারা লাগিয়েছে সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এই বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতোরও শুরু হয়েছে। ওই রাজ্যে কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ মুখপাত্র গরিমা দসৌনির সঙ্গে বিতর্কিত বোর্ডের বিষয়ে কথা বলেছিল বিবিসি। তার অভিযোগ উত্তরাখণ্ডে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার এই ঘটনার জন্য দায়ী।

গরিমা দাসাউনি বলছেন, রাজ্যে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ানোর জন্য এ জাতীয় কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। আমাদের গ্রামাঞ্চল, যেটা ঘৃণার হাত থেকে এতদিন রক্ষা পেয়ে এসেছিল সেখানেও এখন সুচিন্তিত কৌশলের মাধ্যমে তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এআইএমআইএম প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসিও বোর্ডের বিষয়ে নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন। বিবিসি বাংলা।

এসএস

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *