দেশে ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। গত আগস্টের চেয়ে চলতি সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগস্টের শেষ দিক থেকে ক্রমেই হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের চাপ বাড়তে থাকে। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। প্রতিদিনই শত শত মানুষ ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৩ জনে।
দেশে ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। গত আগস্টের চেয়ে চলতি সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগস্টের শেষ দিক থেকে ক্রমেই হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের চাপ বাড়তে থাকে। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। প্রতিদিনই শত শত মানুষ ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৩ জনে।
বর্ষা মৌসুম শেষ হলে ডেঙ্গু সংক্রমণ ভয়ংকর রূপ নিতে পারে- এমন আগাম সতর্কবার্তা আগেই জানিয়েছিলেন কীটতত্ত্ববিদরা। এরপরও স্বাভাবিক কার্যক্রমের বাইরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্থানীয় সরকার ও সিটি কর্পোরেশন। যদিও ডেঙ্গুর এ পরিস্থিতির জন্য নিজেদের কোনো অবহেলা নেই বলে দাবি করেছে সিটি কর্পোরেশন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেপ্টেম্বরের দিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কার কথা তারা আগেই বলেছিলেন। সে অনুযায়ী মশা নিধন, মাঠ পর্যায়ের সার্ভিলেন্স ও আক্রান্ত এলাকা ধরে প্রতিরোধমূলক বিশেষ ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত জুলাইয়ে শুরু হয় ডেঙ্গুর মৌসুম। সে মাসে আক্রান্ত হয় দুই হাজার ৬৬৯ জন। আর মারা যান ১২ জন। এরপর আগস্টে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ২৭ জনের। আর আক্রান্ত হয় ছয় হাজার ৫২১ জন। এ বছরের প্রায় সাড়ে নয় মাসে ১৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভর্তি রোগী ছাড়িয়েছে ২৪ হাজার ৯০০ জন।
জানা গেছে, দেশে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যাপকভাবে শুরু হয় ২০০০ সালে। ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দুই লাখ ৪৪ হাজার ২৪৬ জন এ রোগে আক্রান্ত হন। এ সময় মারা যান ৮৫৩ জন। দেশের ইতিহাসে গত বছর ডেঙ্গুর সবচেয়ে ভয়াবহ সময় দেখেছে বাংলাদেশ। সোয়া তিন লাখ মানুষ হাসপাতালে ভর্তির পাশাপাশি এক হাজার ৭০৫ মানুষের প্রাণহানি ঘটে ২০২৩ সালে।
ডেঙ্গু রোগীর ৪৪ শতাংশই ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, এ বছর ডেঙ্গু সংক্রমণের বিস্তার শুরু থেকেই স্থানীয় পর্যায়ে বেশি থাকলেও ক্রমে সে চিত্র বদলেছে। এ বছর মোট ভর্তি রোগীর ৪৪ শতাংশ ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের। এছাড়া, ঢাকার বাইরে সর্বোচ্চ চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে।
শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত এ বছর ডেঙ্গু নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ২২ হাজার ২৬৫ জন। এর মধ্যে প্রায় ৪৪ শতাংশ ঢাকার দুই সিটিতে। আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে (মহানগরীর বাইরে) দুই হাজার ৪৭৩ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে পাঁচ হাজার ৫৪৩ জন এবং উত্তর সিটিতে চার হাজার ২৫২ জন। ঢাকার পর সবচেয়ে বেশি পাঁচ হাজার ২৩৯ জন চট্টগ্রামে এবং বরিশালে দুই হাজার ৯২ জন।
শুধু সংক্রমণ নয়, মৃত্যুও বেশি হচ্ছে ঢাকায়। গত ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মারা যাওয়া ১২৪ জনের ৭১ জনই ঢাকার দক্ষিণ সিটির এবং ১৫ জন উত্তর সিটির বাসিন্দা।
আগাম সতর্কতাকে গুরুত্ব না দেওয়ায় এই পরিস্থিতি : ড. কবিরুল
এমন পরিস্থিতি হওয়ার পেছনে আগাম সতর্কতাকে গুরুত্ব না দেওয়ার বিষয়টিকে দুষছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে যদি বিশেষ ব্যবস্থা না নেওয়া হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা চাকরি বাঁচানো ছাড়া কোনো তৎপরতা দেখাচ্ছে না। দুই মাস আগে থেকে আমরা বলে এসেছি যে, সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে। কিন্তু কেউই পাত্তা দিলো না। তারা স্বাভাবিক কার্যক্রম ছাড়া পিকের সময়েও (সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠার) কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। হেলাফেলা করায় প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রায় প্রতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু পর্যালোচনা করার জন্য একটি টিম গঠন করা হয়ে থাকে। ডেঙ্গুর প্রতিটি মৃত্যু পর্যালোচনা করে কীভাবে এ হার কমানো যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই এ পর্যালোচনা করা মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু মৃত্যু পর্যালোচনার রিপোর্ট গবেষক বা নীতি নির্ধারণের হাতে কতটা পৌঁছায় তা আমার জানা নেই। অথচ এ তথ্য ও উপাত্ত ভবিষ্যতে ডেঙ্গু রোগের মৃত্যুহার কমানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারত।
কবিরুল বাশার বলেন, এখন দরকার হটস্পট ম্যানেজমেন্ট, সংক্রমণ ছড়ায়নি এমন জায়গায় মশার লার্ভা যাতে না হয় সে ব্যবস্থা নেওয়া এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। এটি নিশ্চিত করা গেলে রোগী কমে আসবে। এখন ডেঙ্গু পুরো সেপ্টেম্বর তো বটেই সারা দেশে অক্টোবরেও ভোগাবে।
ঢাকার হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ
ডেঙ্গু রোগীর ঢেউ সামাল দিতে গিয়ে প্রতি বছর বেগ পেতে হয় মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর সকাল পর্যন্ত এক হাজার ৯১৯ জন রোগী ভর্তি হয়েছে হাসপাতালটিতে। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ৯৮ জন। যাদের অধিকাংশই রাজধানীর মান্ডা, মানিকনগর, বাসাবো, গোলাপবাগ, দক্ষিণ মুগদা ও মিরপুরের বাসিন্দা। দুই মাস আগেও এ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের অধিকাংশ ছিল এসব এলাকার।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ডেঙ্গু নিয়ে তিন দিন ধরে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা আবুল হাসান (৩৮)। জ্বর, প্রচণ্ড বমি ও পাতলা পায়খানা রয়েছেন তিনি। শুরুতে স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ওষুধ এনে খেলেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ৪টায় হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি।
মাওলানা আবুল হাসান বলেন, যাত্রাবাড়ী এলাকায় সবসময়ই ডেঙ্গু সংক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। এবারও যাত্রাবাড়ী-কোনাপাড়ায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি। কিন্তু সে তুলনায় বাড়িওয়ালাদেরও তেমন তৎপরতা নেই, সরকারিভাবেও দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। অধিকাংশ নতুন বাসাবাড়ির ছাদে দিনের পর দিন পানি জমিয়ে রাখা হয়েছে। কেউ গিয়ে কোনোদিন স্প্রে বা কোনো ওষুধও ছিটায় না। যে কারণে আশঙ্কা করছি, এবারও ওই এলাকায় ভয়াবহ অবস্থা হবে।
শুধু মুগদা মেডিকেল নয়, একই চিত্র দেখা গেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালেও।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঁচ দিন ধরে ভর্তি আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানার কর্মী আজগর হোসেন। তিনি বলেন, প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হয়, যন্ত্রণা করে, উঠে বসতে পারি না। চোখে রক্ত জমেছিল, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় র্যাশ উঠেছে।
নিজেদের কোনো অবহেলা নেই বলে দাবি দক্ষিণ সিটির
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নিজেদের কোনো অবহেলা নেই বলে দাবি করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। প্রশাসক ড. মুহ. শের আলী বলেন, এডিস মশার লার্ভা বিনষ্ট এবং জীবন্ত ও উড়ন্ত মশা নিধনের মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নিয়মিতভাবে লার্ভিসাইডিং ও অ্যাডাল্টিসাইডিং করা হচ্ছে। এ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন এলাকায় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর যে তালিকা পাওয়া যায়, আমরা সেসব রোগীর ঠিকানা অনুযায়ী বিশেষ মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি।
তিনি বলেন, নিয়মিত ও বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে সফলভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব বলে আমরা আশাবাদী।
দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি। গত বছর আমাদের সিটিতে জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট হাজার রোগী ছিল, এ বছর যা ১৪০০। কিন্তু ঢাকার বাইরের সব রোগীকে আমাদের বলে চালিয়ে দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তারা সবসময়ই ভুল তথ্য দিয়ে আসছে। আমরা থেমে নেই। কীটতত্ত্ববিদদের মতামত আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করছি, একবিন্দু পরিমাণও ছাড় দিচ্ছি না।
গত বছরের তুলনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো : সচিব
গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এ বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো আছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এমএ আকমল হোসেন আজাদ। সম্প্রতি সচিবালয়ের এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য সচিব বলেন, বর্তমানে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভালো বলে মনে হচ্ছে। তবুও আমরা সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।
তিনি বলেন, আমরা এবার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছি। ঢাকার বেশিরভাগ হাসপাতালে আক্রান্তদের জন্য আলাদা ডেডিকেটেড কর্নার করা হয়েছে। সেখানে তাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের জনবলকে ডেঙ্গু ইস্যুতে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আশা করছি ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভালোভাবেই মোকাবিলা করতে পারব।
টিআই/কেএ