দুই বছরের পারুলকে কোলে নিয়ে ২০০৪ সালে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন বিবি রহিমা। তারপর দিনমজুর স্বামী মো. সেলিমের হাত ধরে গড়ে তোলেন স্বপ্নের সমন্বিত কৃষিখামার। ২০০৪ থেকে ২০২৪, শূন্য থেকে শিখরে পৌঁছেছিলেন এই নারী উদ্যোক্তা। ৪০ একর জমিতে ছিল ১০টা ঘের ও চারটা পুকুর। এ ছাড়াও ছিল ফাউমি মুরগি, হাঁস ও গরুর খামার। ছিল দেশি-বিদেশি ফলের গাছ। এক বানে ভেসে গেছে বিবি রহিমার ২০ বছরের স্বপ্ন। দেড় কোটি টাকার ক্ষতিতে পথে বসে গেছেন তিনি।
দুই বছরের পারুলকে কোলে নিয়ে ২০০৪ সালে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন বিবি রহিমা। তারপর দিনমজুর স্বামী মো. সেলিমের হাত ধরে গড়ে তোলেন স্বপ্নের সমন্বিত কৃষিখামার। ২০০৪ থেকে ২০২৪, শূন্য থেকে শিখরে পৌঁছেছিলেন এই নারী উদ্যোক্তা। ৪০ একর জমিতে ছিল ১০টা ঘের ও চারটা পুকুর। এ ছাড়াও ছিল ফাউমি মুরগি, হাঁস ও গরুর খামার। ছিল দেশি-বিদেশি ফলের গাছ। এক বানে ভেসে গেছে বিবি রহিমার ২০ বছরের স্বপ্ন। দেড় কোটি টাকার ক্ষতিতে পথে বসে গেছেন তিনি।
বিবি রহিমা নোয়াখালীর সদর উপজেলার কাদির হানিফ ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের দরবেশপুর গ্রামের বাসিন্দা। তার চার মেয়ে ও দুই ছেলে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চৌচালা টিনের ঘরে বাস করেন বিবি রহিমা। চারপাশে থই থই করছে বন্যার পানি। পানিতে ভাসছে বিবি রহিমার মাছের ঘের ও কৃষি খামার।
বিবি রহিমা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, যখন আমার প্রথম সন্তানের বয়স দুই বছর, তখন আমি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম উদ্যোক্তা হওয়ার। অল্প অল্প করে দিনমজুর স্বামীকে নিয়ে স্বপ্নের খামার গড়ে তুলেছি। নিজের জন্য বসতঘর নির্মাণ করি নাই। স্বপ্ন ছিল এবার খামারের মাছ বিক্রি করে বসতঘর নির্মাণ করব, কিন্তু এক বন্যায় আমার সব শেষ হয়ে গেছে। যে আশায় বুক বেঁধেছিলাম, আকস্মিক বন্যায় সেই স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে।
বিবি রহিমা বেগম আরও বলেন, আমার ৪০ একরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। ৬৬০টা হাঁস ভেসে গেছে এবং ৯৬০টা ফাউমি মুরগি মারা গেছে। এ ছাড়াও প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা মূল্যের একটি গর্ভবতী বিদেশি গাভি মারা গেছে। সব মিলিয়ে আমার সারা জীবনের সঞ্চয় এই খামার। মেয়ের গহনা ও জামাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসায় যুক্ত করেছিলাম। এখন সেখানেও সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। আল্লাহ আমারে এত বড় বিপদে ফেলেছে যা আমি ছাড়া কেউ জানে না। এখন হাঁটতে গিয়ে থমকে যাই। ঘুমের ভেতর লাফ দিয়ে উঠি। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। শোকে পাথর হয়ে গেছি।
বিবি রহিমার বড় মেয়ে পারুল বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার মা সফল নারী উদ্যোক্তা। সমাজের মানুষের নানা কথা শুনে তিনি বড় হয়েছেন। তার জন্য আমরা সম্মানিত হয়েছি। তিনি প্রতিবছর আয় থেকে নতুন করে খামারের পরিধি বাড়াতেন। আমরা ভাঙা ঘরে থাকি। এবার একটা নতুন ঘর করার কথা ছিল। বন্যায় আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। আমার মা এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
বিবি রহিমার আরেক মেয়ে বীথি আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার মা খেয়ে না খেয়ে উদ্যোক্তা হয়েছেন। আমরা মায়ের জন্য গর্বিত হয়েছি। আমাদের তিনি পড়ালেখা করিয়েছেন এবং ভালো জায়গায় বিয়ে দিয়েছেন। আজ আমার মা সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তিনি কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন তা আমাদের কাছে অজানা।
কাদিরহানিফ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিবি রহিমা সংগ্রামী সফল নারী। তিনি অনেকের কাছে অনুপ্রেরণা। তার মতো সফল ও সাহসী নারী নোয়াখালীতে নেই। তিনি এমন ধাক্কা খেয়েছেন যা বলার মতো না। তারপরও সরকার যদি তাকে ঘুরে দাঁড়াতে সহযোগিতা করে তাহলে তার অনেক উপকার হবে। বিভিন্ন স্থান থেকে তিনি ঋণ নিয়েছেন। তারা টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে।
সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মানস মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি নোয়াখালীর মানুষ আর দেখেনি। এই বন্যায় আমাদের মৎস্যখাত ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ১৫ হাজারের পুকুর তলিয়ে গেছে। এতে ১৮০ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। আমরা প্রাথমিকভাবেই এটা নিরূপণ করেছি, পরবর্তীতে আরও বাড়তে পারে। অনেক খামারি সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাদের অন্যতম হলেন, নারী উদ্যোক্তা বিবি রহিমা। নারীরা যে সফল হতে পারেন তিনি তার অনন্য উদাহরণ। তিনি প্রাণিসম্পদ এবং কৃষিতেও সফল হয়েছেন। তার ক্ষয়ক্ষতির তথ্য আমরা ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছি।
সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার আখিনূর জাহান নীলা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিবি রহিমার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি আমরা জেনেছি। আমি মৎস্য, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ দপ্তরে আলাদাভাবে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি জানাতে বলেছি। আশাকরি সরকারি সহায়তা পেলে তিনি ঘুরে দাঁড়াবেন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন পোস্টকে বলেন, বন্যায় নোয়াখালীর আটটি উপজেলা ও সাতটি পৌরসভায় ৮৫ হাজার ৩৭৯টি খামারের মাছ ভেসে গেছে। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫৭৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পানি নেমে যাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত খামার ও কৃষকদের সহযোগিতা করার জন্য বরাদ্দ চেয়ে অধিদপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেলে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বন্যায় নোয়াখালীর ৯ উপজেলার আটটি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা সরকারি সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। নোয়াখালী জেলায় প্রায় হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমাদের দ্বিতীয়বার বন্যা হওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে আমাদের পরিকল্পনা আছে।
এএমকে