শেয়ারবাজার কারসাজিতে অভিযুক্ত সালমান এফ রহমানের অন্যতম সহযোগী হিসেবে পরিচিত পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী শাকিল হোসেন। অভিযোগ উঠেছে, শুল্কমুক্ত সুবিধার আড়ালে কাঁচামাল আমদানি ও শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন তিনি। একের পর এক ভুয়া এলসি খুলে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে লুটপাটেরও অনেক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
শেয়ারবাজার কারসাজিতে অভিযুক্ত সালমান এফ রহমানের অন্যতম সহযোগী হিসেবে পরিচিত পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী শাকিল হোসেন। অভিযোগ উঠেছে, শুল্কমুক্ত সুবিধার আড়ালে কাঁচামাল আমদানি ও শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন তিনি। একের পর এক ভুয়া এলসি খুলে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে লুটপাটেরও অনেক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একাধিক তদন্তে শাকিলের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। বেশ আগেই তার অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতিবাজ কাস্টমস কর্মকর্তাদের সহযোগিতা এবং আলোচিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের সহযোগী হওয়ায় এতদিন আড়ালে ছিল তার অপকর্ম। এখন সরকার পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে থলের বিড়াল বের হয়ে আসছে।
এনবিআরের গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, শাকিল হোসেন নামে ওই ব্যবসায়ীর মোট পাঁচটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- স্মার্ট লাইফ ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ, বাবর স্যু ইন্ডাস্ট্রিজ, শাকিল পিভিসি পলিমার অ্যান্ড রাবার, এ টু জেড ট্রেডিং হাউজ ও এম আলী ট্রেডিং।
এর মধ্যে এ টু জেড ট্রেডিং হাউজ ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেট থেকে ভ্যাট নিবন্ধন নিয়েছে। পুরান ঢাকার লালবাগের ঠিকানায় আমদানিকারক হিসেবে নিবন্ধন নেয় এটি।
স্মার্ট লাইফ ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ ‘নিশান বাড়ি, কলাতিয়া, কেরানীগঞ্জে’র ঠিকানায় ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেট থেকে আমদানি-রপ্তানি ও সরবরাহকারী হিসেবে নিবন্ধন নিয়েছে। একই ঠিকানায় একই কমিশনারেট থেকে বাবর স্যু ইন্ডাস্ট্রিজ, শাকিল পিভিসি পলিমার অ্যান্ড রাবারের নামে আমদানি ও সরবরাহকারী হিসেবে নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে।
কাস্টমস অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড যাচাই করে দেখা গেছে, স্মার্ট লাইফ ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুল্ক সুবিধায় প্রায় ১১ হাজার ৭৫৭ টন কাঁচামাল আমদানি করেছে। যার মূল্য দেখানো হয়েছে প্রায় ১৫৭ কোটি টাকা। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর (কাস্টমস ডিউটি, রেগুলেটরি ডিউটি, সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট) প্রায় ৩৩ কোটি টাকা। এছাড়া, অগ্রিম আয়কর (এআইটি) ও অগ্রিম কর (এটি) রয়েছে প্রায় ১৩ কোটি টাকা।
একইভাবে শাকিল হোসেনের আরেক প্রতিষ্ঠান শাকিল পিভিসি পলিমার অ্যান্ড রাবার ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার টন কাঁচামাল আমদানি করেছে। যার মূল্য প্রায় ৭০ কোটি টাকা। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় ১৫ কোটি টাকা। এছাড়া, এআইটি ও এটি রয়েছে প্রায় ছয় কোটি টাকা।
এ টু জেড ট্রেডিং হাউজ গত এক বছরে প্রায় সাড়ে চার হাজার টন কাঁচামাল আমদানি করেছে। যার মূল্য প্রায় সাড়ে ৫৯ কোটি টাকা। যাতে শুল্ককর প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা। এছাড়া, এআইটি ও এটি রয়েছে প্রায় ছয় কোটি টাকা।
বাবর স্যু ইন্ডাস্ট্রিজ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার টন কাঁচামাল আমদানি করেছে। যার মূল্য প্রায় ৪৯ কোটি টাকা। যাতে শুল্ককর প্রায় ১২ কোটি টাকা। এছাড়া, এআইটি ও এটি প্রায় চার কোটি টাকা।
এসব প্রতিষ্ঠানের নামে এসব বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকা ভ্যাট জমলেও তা ফাঁকি দিয়ে এসেছেন শাকিল। শুল্ক সুবিধায় বিভিন্ন প্রকার কেমিক্যাল, পলিমার, কালি, পিপি দানাসহ বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানি করেন শাকিল হোসেন। উৎপাদনকারী হিসেবে শুল্ক সুবিধায় আমদানি করা হলেও কোনো কাঁচামাল দিয়েই পণ্য উৎপাদন করা হয়নি। সব খোলা বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মাসে ভ্যাট অফিসে রিটার্ন দেওয়ার কথা। সেই কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদন করা হয়েছে কি না তা ভ্যাট কর্মকর্তাদের তদারকির কথা। কিন্তু খোলা বাজারে বিক্রি করলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং প্রতি মাসে কমিশনের টাকা নিয়ে চুপ থেকেছেন কিছু অসাধু ভ্যাট কর্মকর্তা। যদিও, সালমান এফ রহমানের নাম করে ভ্যাট অফিসারদের হুমকি দেওয়া হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। আর ভ্যাট রিটার্ন জমা না দেওয়া হলেও এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, কাস্টমসকে বেশি মূল্যে কাঁচামাল শুল্কায়নে বাধ্য করতেন শাকিল হোসেন। কোনো কর্মকর্তা বাধা দিলে সালমান এফ রহমানকে দিয়ে ফোন করানো হতো। এভাবে প্রচুর টাকা বিদেশে পাচার করতেন শাকিল।
প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, অন্তত ৪০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের প্রমাণ মিলেছে। বন্ড লাইসেন্সের বিপরীতে কাগুজে প্রতিষ্ঠান কেরানীগঞ্জের স্মার্ট লাইফ ফুটওয়ার ইন্ডাস্ট্রিজ, বাবর সু-ইন্ডাস্ট্রিজ, এম আলী ট্রেডিং, ঢাকার ইসলামবাগের শহীদবাগ শাকিল পিভিসি পলিমার অ্যান্ড রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ ও লালবাগের এটুজেড ট্রেডিং হাউজের নামে কোনো কাগজ যাচাই ছাড়াই পূর্বালী ব্যাংক, এবি ব্যাংক ও ডাচবাংলা ব্যাংকে এলসি খোলা হয়েছে। বিপরীতে নেওয়া ঋণ লুটপাট হয়েছে। ওই ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে এনবিআরের প্রাথমিক তদন্তে। ইতোমধ্যে এরূপ একটি অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এনবিআর ও দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, ঢাকার ইসলামবাগের শহীদবাগ শাকিল পিভিসি পলিমার অ্যান্ড রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ একটি জীর্ণ-শীর্ণ প্রতিষ্ঠান। গত ৫ আগস্টের পর প্রতিষ্ঠানটি আর খোলা হয়নি।
জানা গেছে, লালবাগের আজিমপুরের ৬/৯ শেখ শাহেব বাজার এলাকার মৃত জামাল উদ্দিনের ছেলে শাকিল হোসেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে অর্থবিত্তে তিনি ফুলে-ফেঁপে ওঠেন। সালমান এফ রহমানের সঙ্গে সম্পর্কের সুবাদে এবং তার ছত্রছায়ায় শাকিল গড়ে তুলেছেন বিশাল সাম্রাজ্য। আজিমপুরের ছাপরা মসজিদ এলাকায় একসময় ভাড়া বাসায় থাকলেও বর্তমানে ওই এলাকায় তিনি ১২ থেকে ১৫টি বাড়ির মালিক। এছাড়া, কানাডার বেগম পাড়ায়ও তার বাড়ি রয়েছে।
কেরানীগঞ্জে ৪৫ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন কলকারখানা। এসব কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আড়ালে সালমান এফ রহমানের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারে সহযোগিতা করেছেন তিনি। শাকিল নিজেও বিভিন্ন নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে কয়েকশ কোটি টাকা কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও দুবাই পাচার করেছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে শাকিল হোসেনের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন দেওয়া হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। খুদেবার্তা পাঠানো হলেও জবাব পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদনকারী হিসেবে শুল্ক সুবিধায় শত শত কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানি করেছে। সেই কাঁচামাল দিয়ে পণ্য তৈরি না করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এতে একদিকে রাষ্ট্রকে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে ‘ওভার ইনভয়েসিং’ করে বিদেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে।
শুধু রাজস্ব ফাঁকি আর অর্থপাচার নয়। শাকিল হোসেন তিনটি ব্যাংকের সহায়তায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বহু এলসি খুলেছেন এবং এর বিপরীতে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। এই সবগুলো বিষয়ে এখন খোঁজ খবর করবে এনবিআর- বলেন এনবিআর কর্মকর্তা।
আরএম/কেএ