ফেসবুক কমেন্টের জেরে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয় বুয়েট অধ্যাপককে

ফেসবুক কমেন্টের জেরে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয় বুয়েট অধ্যাপককে

২০১৫ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের একটি পোস্টে কমেন্টসকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েটের) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলমকে বুয়েট ছাত্রলীগের হাতে শারীরিকভাবে হেনস্তা ও লাঞ্ছনা, মামলায়, ডিপার্টমেন্টে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, কোয়ার্টারের বাসা ছাড়তে বাধ্য করার পাশাপাশি ২০২২ সালে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে বুয়েটের সাবেক উপ উপাচার্য সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বারের বিরুদ্ধে।

২০১৫ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের একটি পোস্টে কমেন্টসকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েটের) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলমকে বুয়েট ছাত্রলীগের হাতে শারীরিকভাবে হেনস্তা ও লাঞ্ছনা, মামলায়, ডিপার্টমেন্টে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, কোয়ার্টারের বাসা ছাড়তে বাধ্য করার পাশাপাশি ২০২২ সালে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে বুয়েটের সাবেক উপ উপাচার্য সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বারের বিরুদ্ধে।

তবে ৫ আগস্টের পর তৎকালীন বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রাসাদ মজুমদারের পরামর্শে চাকরি থেকে অব্যাহতির আবেদন তুলে নিলেও তা কার্যকর করেনি প্রশাসন। ফলে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে তিনি বুয়েট কর্তৃপক্ষের দ্বারা হেনস্তার শিকার হলেও কোনো প্রতিকার পাননি বলে অভিযোগ অধ্যাপক জাহাঙ্গীরের।

তবে অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই বলে দাবি করেছেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার। তিনি বলেন, আমি সে সময় প্রশাসনের কেউ ছিলাম না সেহেতু আমি তাকে বাসা ছাড়তে বলা বা চাকরিতে অব্যাহতি নিতে বলার কেউ না। আর আমি প্রশাসনের কেউ না হলে এইসব সিদ্ধান্ত কীভাবে দেবো? এগুলো একবারেই ভিত্তিহীন অভিযোগ।

কোনোরকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তাকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অব্যাহতি ও হামলা-মামলার শিকার হলেও ন্যূনতম প্রতিবাদ বা টু শব্দ করারও জো ছিল না বলে ঢাকা পোস্টকে জানান অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম। এছাড়া, ওইসময় তিনি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সাহস পাননি এবং বুয়েটের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সহায়তা পাননি বলেও অভিযোগ করেন এই অধ্যাপক।

গত ৯ আগস্ট অধ্যাপক জাহাঙ্গীর চাকরিতে অব্যাহতির আবেদন তুলে নিতে সাবেক উপাচার্য সত্য প্রাসাদ মজুমদারের কাছে আবেদন করেন। এরপর উপাচার্য পদত্যাগ করলে গত ২২ সেপ্টেম্বর নবনিযুক্ত উপাচার্যের কাছে পুনরায় আবেদন করেন। তবে তার বিষয়টি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পাস হওয়ার কথা থাকলেও এখনো পাস হয়নি। তার বিরুদ্ধে এখনো ২টি মামলা চলমান। এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে স্বপদে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াও শুরু করেনি।

লিখিত আবেদনে অধ্যাপক জাহাঙ্গীর কয়েকটি দাবি জানান। সেগুলো হলো- 

১. তার পদত্যাগপত্র এবং তার পরবর্তী তৎসংক্রান্ত সব অফিস অর্ডার বাতিল করা

২. তাকে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা

৩. বিগত ১০ বছরে তার প্রাপ্য সব ইনক্রিমেন্ট দেওয়া এবং বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করা

৪. একটা তদন্ত কমিটি করে বিগত ১০ বছরে এ সমস্ত অন্যায় এবং বৈষম্যমূলক আচরণের সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

ঘটনা সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল দীপু সরকার নামের একজন ‘বুয়েটে আড়ি পেতে শোনা’ নামে একট ফেসবুক গ্রুপে ‘কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর’ শিরোনামে একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সংবাদ শেয়ার করেন। সেখানে চন্দ্র নাথ নামের একজন প্রথমে ‘জয় বাংলা’ লিখে মন্তব্য করেন। এর নিচে জাহাঙ্গীর আলম রাত ১১টা ৪৬ মিনিটে ‘জয় মা কালী, জয় ইন্ডিয়া’ ও পরে সংশোধন করে ‘জয় ইন্ডিয়া, জয় মাসল পাওয়ার, জয় পলিটিকস’ লিখে মন্তব্য করেন।

ফেসবুকে অন্যরা এ কথার ব্যাখ্যা চাইলে জাহাঙ্গীর আলম বিভিন্ন সময়ে লেখেন, ‘জয় বাংলা শুধু একটি দলকেই উপস্থাপন করে’, ‘জয় বাংলাদেশ বলুন। এটা অরাজনৈতিক। জয় বাংলা দুটি দেশকে উপস্থাপন করে।’ সবশেষে একটি মন্তব্য করেন, ‘কারেক্টেড : জয় ইন্ডিয়া, জয় মাসল পাওয়ার, জয় নেসটি পলিটিকস, জয় ইনজাস্টিস (সংশোধিত: ভারত, পেশিশক্তি, কদর্য রাজনীতি ও অবিচারের জয়)’।

এ নিয়ে তৎকালীন বুয়েট ছাত্রলীগ সভাপতি শুভ্রজ্যোতি টিকাদার এবং সেক্রেটারি আবু সাঈদ কনক মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করলেও শিক্ষকের রুমে কথা-কাটাকাটি হয়েছে বলে স্বীকার করেছিলেন। এছাড়া, তার ওপর হামলার বিষয়টি অভিযুক্ত সিয়াম হোসেন ফেসবুক কমেন্টে অধ্যাপক জাহাঙ্গীরকে ‘মিষ্টি লেপ্টে দেওয়া’র কথা স্বীকার করেন।

এসময় এই শিক্ষকের পক্ষে বিবৃতি ও ১৩ থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দেয় তৎকালীন শিক্ষক সমিতি। পরে অপরাধীদের বিচারে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তখন তাদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তিও দেয় প্রশাসন। তবে এরপরই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ পুরো ক্যাম্পাসে শোডাউন দিয়ে প্রশাসনকে চাপে ফেললে তারা আর মামলার অগ্রগতি নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। পরে ছাত্রলীগ হাইকোর্টে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের ছাত্রত্ব বহাল রাখা হয়।

ঢাকা পোস্টকে অধ্যাপক জাহাঙ্গীর বলেন, ফেসবুকের একটি কমেন্টকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে ২০১৫ সালের ১২ এপ্রিল বুয়েটের তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে একদল ছাত্র আমাকে হেনস্তা করে, গায়ে হাত তোলে এবং অপমান করে। পরে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ড. আবদুল জব্বার খানের প্ররোচনায় সিয়াম হোসেন নামক বুয়েটের এক ছাত্র আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করে।

ঘটনার একমাস পরে অধ্যাপক আবদুল জব্বার খানের প্ররোচনায় এবং প্রত্যক্ষ মদদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. ফয়েজ উল্লাহ নামের এক ছাত্র আমার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে। আমার বিরুদ্ধে দুটি মামলাই এখনো চলমান আছে।

অধ্যাপক আবদুল জব্বার তাকে জোর করে ডিপার্টমেন্টের কনসাল্টেন্সি থেকে বাদ দেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিন্ডিকেটের সভায় আমাকে সাময়িকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সিদ্ধান্তের পর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ড. আবদুল জব্বার খানের অলিখিত নির্দেশে আমাকে ডিপার্টমেন্টের কনসাল্টেন্সি কাজ থেকেও বাদ দেওয়া হয়। যার কারণে, আমি আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হই।

তিনি বলেন, আমার ওপর হামলার প্রতিবাদে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করলে হামলাকারীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করলেও তারা হাইকোর্টে রিট করে বুয়েট প্রশাসনের দেওয়া বহিষ্কার স্থগিত করার মাধ্যমে ছাত্রত্ব ফিরে পেলেও আমার বিরুদ্ধে মামলার কোনো সুরাহা হয়নি। আমাকে দীর্ঘদিন ধরেই হেনস্তা করা হচ্ছে এবং সে মামলাগুলো এখনো রয়েছে। সেসব শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বুয়েটের কর্তৃপক্ষ কোনো আপিল করেনি এবং মামলা সঠিকভাবে পরিচালনার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। শুধু তাই নয়, বুয়েট কর্তৃপক্ষে ঘটনার তথ্যপ্রমাণ ও আলামত সরিয়ে ফেলা এবং ধ্বংস করার মতো হীন কাজ করেছে। পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টের রায়ে ছাত্রদের বহিষ্কার পুরোপুরি বাতিল হয়ে যায়।

একাডেমিক কার্যক্রমে ফিরে যেতে অসংখ্যবার আবেদন করেও কোনো ফল পাননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিগত ৯ বছরে কয়েকবার আমি বুয়েট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করি আমার একাডেমিক কার্যক্রম পুনরায় বহাল করার জন্য। কিন্তু, কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ২০২০ সালে বিষয়টি সিন্ডিকেটে তোলার সিদ্ধান্ত হলেও তৎকালীন উপ-উপাচার্য আবদুল জব্বার সেটাকে বাতিল করে দেন।

২০২০ সালে ড. আবদুল জব্বার খান প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর হলে বিভিন্ন লোক দিয়ে আমাকে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে এবং মামলার ভয় দেখিয়ে ক্যাম্পাসের বাসা ছেড়ে দিতে বলে। ফলে, আমি ক্যাম্পাসের বাইরে বাসা ভাড়া নিয়ে ক্যাম্পাসের বাসা ছেড়ে দিই। এরপরও, তৎকালীন প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর আমার ওপর চাকরি ছেড়ে দেওয়ার চাপ অব্যাহত রাখে। ভয়ভীতি এবং চাপের মুখে, আমি ২০২২ সালে চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করি।

অধ্যাপক জব্বারের পদে না থেকে কীভাবে হুমকি দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি ২০১৫ সালে কোন পদে ছিলেন না, কিন্তু ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করতেন, পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালে উপ উপাচার্য হওয়ার পর তার ন্যাক্কারজনক কার্যকলাপ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। অগণিত ছাত্রকে টর্চার এবং ২০১৯ শহীদ আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড সবই তার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদে হয়েছে। তিনি ছিলেন এসবের মাস্টারমাইন্ড। কিন্তু তিনি কখনো সামনে আসতেন না।

তিনি বলেন, আমার চাকরি ছাড়ার আবেদনের সঙ্গে সঙ্গে কোন অফিস অর্ডার ছাড়াই আমার বেতন বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের শেষের দিকে যখন সরকার পরিবর্তনের গুঞ্জন উঠে তখন হঠাৎ আমার আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে মর্মে অফিস অর্ডার করা হয় এবং আমাকে বুয়েটের দেনা-পাওনা পরিশোধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়, কিন্তু আমার পেনশনসহ অন্যান্য সুবিধাদি বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। জরিমানা এড়ানোর জন্য ২০ মার্চ ২০২৪ এর পত্র মোতাবেক আমার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদয় পাওনা জিপিএফ ফান্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে অবশিষ্ট পাওনা ‘গৃহ ঋণ তহবিল’ এ জমা দিয়ে দিই।

অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার কিরে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার বলেন, এসব অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। কাউকে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষমতা শুধু প্রশাসনের রয়েছে। আর আমি ২০১২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বুয়েটের কোনো প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিলাম না। এসময় আমি বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনে ছিলাম।

তবে অধ্যাপক জাহাঙ্গীরকে ফিরিয়ে নিতে সিন্ডিকেট কাজ করছে বলে জানিয়েছেন বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবু বোরহান মোহাম্মদ বদরুজ্জামান। তিনি বলেন, অধ্যাপক জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তার প্রতি যদি অন্যায় করা হয় আমরা অবশ্যই চাইবো তিনি যেন ন্যায়বিচার পান। উনি বিস্তারিত জানিয়ে আমাদের চিঠি দিয়েছেন সেটা এখন সিন্ডিকেটে রয়েছে। সিন্ডিকেটে এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী এখন ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অধ্যাপক আবদুল জব্বারের বিষয়ে তিনি বলেন, অধ্যাপক জাহাঙ্গীর তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছেন সেটা তদন্তসাপেক্ষ বিষয়। তদন্তের পরে সেটা বিস্তারিত জানা গেলে সে অনুযায়ী প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

কেএইচ/এসএম

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *