আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বত্র পরিবর্তনের হাওয়া লাগলেও সার্বজনীন পেনশন কর্মসূচিতে কোনো হস্তক্ষেপ হয়নি। এ কর্মসূচির কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে চলছে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে স্কিমে অংশগ্রহণের হার আগের তুলনায় কিছুটা কম বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বত্র পরিবর্তনের হাওয়া লাগলেও সার্বজনীন পেনশন কর্মসূচিতে কোনো হস্তক্ষেপ হয়নি। এ কর্মসূচির কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে চলছে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে স্কিমে অংশগ্রহণের হার আগের তুলনায় কিছুটা কম বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সরকারের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন স্কিম ‘প্রত্যয়’ চালু করা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। আগস্ট মাসে ওই স্কিম বাতিল করা হলে ওই সংকট কেটে যায়। প্রত্যয় স্কিমের সঙ্গে অন্য চার স্কিম প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতার কোনো সম্পর্ক নেই।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে পেনশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। সেখানে যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী পেনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে প্রচারণামূলক উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় অনেকটাই ‘টেনশনমুক্ত’ সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি।
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী— কর্মসূচির চার স্কিমে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তির সংখ্যা তিন লাখ ৭২ হাজার ১৬৮ জন। যাদের জমা দেওয়া অর্থের পরিমাণ ১২৫ কোটি ৬৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। এ অর্থ থেকে এখন পর্যন্ত ১২৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে। গত সপ্তাহেও বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে আট কোটি টাকা। অর্থাৎ এ সংক্রান্ত সার্বিক কার্যক্রম স্বাভাবিক নিয়মে চলছে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা ঢাকা পোস্টকে বলেন, জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ হচ্ছে আইন দ্বারা সৃষ্ট সরাসরি সরকারি প্রতিষ্ঠান। আর পেনশন তহবিলের টাকা উত্তোলন বা খরচ করার এখতিয়ার পেনশন কর্তৃপক্ষের নেই। তারা কেবল পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন। এমনকি জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য ব্যয়ও সরাসরি ট্রেজারি ফান্ড থেকে দেওয়া হয়। যারা টাকা বিনিয়োগ করছেন তাদের টাকা উত্তোলন বা ব্যয় করার সুযোগ আমাদের নেই।
তিনি বলেন, আমরা কেবল পেনশন তহবিলের টাকা বিনিয়োগ করতে পারব। যার লভ্যাংশ সরাসরি তহবিলে যোগ হতে থাকবে। আমার মতে, এটা সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ। সরকার পরিচালনার দায়িত্ব কারা পালন করছে তার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। আর এটা কোনো এনজিও বা বীমা প্রতিষ্ঠান নয়। এটা সরাসরি সরকারি প্রকল্প।
‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে ইতোমধ্যে আমাদের বৈঠক হয়েছে। তিনি আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যদিও প্রচারণামূলক কিছু কর্মসূচি আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। তবে, আমরা নিজেরা থেমে নেই। আগামীতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টের সময় রেডিও ধারাবিবরণীতে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ অংশ নিচ্ছে। প্রচারণার অংশ হিসেবে ওই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’
জনমনে নানা আশঙ্কার বিষয়ে জানতে চাইলে গোলাম মোস্তফা বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চারটি স্কিমে মানুষের অংশগ্রহণে ধীরগতি দেখা গেছে। তবে, আমাদের কার্যক্রম থেমে নেই।
জমা হওয়া অর্থের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সম্প্রতি স্কিমে জমা হওয়া অর্থ থেকে আট কোটি টাকা ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে। সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত ১২৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ হয়েছে। সর্বশেষ ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চারটি স্কিমে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তির সংখ্যা তিন লাখ ৭২ হাজার ১৬৮ জন। যাদের মাধ্যমে সর্বজনীন স্কিম ফান্ডে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ১২৫ কোটি ৬৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনো সরকারের জনকল্যাণমুখী কোনো প্রকল্প বা উদ্যোগ কখনও বন্ধ হয় না, এটাই স্বাভাবিক। পেনশনে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক ছিল প্রত্যয় স্কিম নিয়ে। প্রত্যয় বাতিল হওয়া মানে যে পুরো পেনশন স্কিম ঝুঁকিতে পড়েছে, বিষয়টি তা নয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ৪০৩টি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ কর্মচারী কর্মরত। তাদের জন্য ওই প্রত্যয় স্কিম ছিল না। ২০২৫ সালের জুলাই থেকে নতুন করে যারা যোগদান করবেন কেবল তাদের ক্ষেত্রেই ওই স্কিম প্রযোজ্য ছিল। এখন সেই প্রত্যয় স্কিম বাতিল করা হয়েছে।
প্রত্যয় স্কিম বাতিলে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে দাবি করেন এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি মিলিয়ে বাংলাদেশে কর্মরত আছেন ১৮ লাখ মানুষ। অন্যদিকে দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। অর্থাৎ অত্যন্ত ছোট একটি অংশ সরকারি পেনশনের সঙ্গে জড়িত। আমাদের মূল লক্ষ্য কিন্তু তারা নয় কিংবা কখনও ছিলও না।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে যে চারটি স্কিম চালু আছে, সেটা চালিয়ে নেওয়াই আমাদের প্রধান ফোকাস। সেই কারণে প্রত্যয় বাতিল হলেও আমরা উদ্বিগ্ন নই। মূলত সর্বজনীন পেনশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল যারা পেনশন সুবিধার বাইরে রয়েছেন, তাদের পেনশনের মতো সামাজিক সুবিধার আওতায় আনা। সবাইকে যদি একই ছাতার মধ্যে আনা সম্ভব হতো তাহলে সরকারের কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যেত।
প্রবাস স্কিম, প্রগতি স্কিম, সুরক্ষা স্কিম ও সমতা স্কিম— এ চার স্কিম নিয়ে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করে সরকার। এর মধ্যে প্রবাসীদের জন্য প্রবাস স্কিম, বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য প্রগতি স্কিম, অনানুষ্ঠানিক খাত অর্থাৎ স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য সুরক্ষা স্কিম আর নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য রয়েছে সমতা স্কিম।
কর্মসূচি চালুর প্রথম দিন থেকেই আগ্রহীদের সাড়া মিলেছে। ক্রমাগত যা ঊর্ধ্বমুখী। পেনশন বিধিমালা বলছে, সর্বজনীন পেনশন প্রথায় যার যত টাকা জমা, মেয়াদ শেষে তার তত বেশি পেনশন। অন্যদিকে, স্বল্প আয়ের মানুষদেরও বিমুখ করবে না এ উদ্যোগ। যারা মাসিক ৫০০ টাকা জমাবেন, তাদের জন্য শুরু থেকেই থাকবে সরকারের আরও ৫০০ টাকার ভর্তুকি। সবমিলিয়ে, সবার জন্যই থাকছে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে বাড়তি কয়েকগুণ মুনাফা পাওয়ার সুযোগ। আর পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াত পাওয়ার যোগ্য হবেন এবং মাসিক পেনশনবাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়করমুক্ত হিসেবে রাখার ঘোষণা দিয়েছে এনবিআর।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনে সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় জাতীয় সংসদ কর্তৃক ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩’ পাস করা হয়। ওই বছরের ১৭ আগস্ট সকালে পেনশন কর্মসূচির উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উদ্বোধনের পর জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট- WWW.UPENSION.GOV.BD চালু করা হয় এবং চারটি স্কিমে অংশগ্রহণের জন্য অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম চালু করা হয়। এরপর মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ও ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা জমা দেওয়া শুরু হয়।
আরএম/এমজে