‘আমার জাদু এতদিন কই ছিলোরে? কত কষ্টইনা পাইছে রে। জাদুরে ঠিকমতো খাইতে দিছে নাকি রে? জাদু আমার বুকে আইছে আমি কত খুশি হইছি৷ আল্লাহ আমার কথা শুনছেন। আমার জাদু আমার কলিজায় ফিরে আইছে।’
‘আমার জাদু এতদিন কই ছিলোরে? কত কষ্টইনা পাইছে রে। জাদুরে ঠিকমতো খাইতে দিছে নাকি রে? জাদু আমার বুকে আইছে আমি কত খুশি হইছি৷ আল্লাহ আমার কথা শুনছেন। আমার জাদু আমার কলিজায় ফিরে আইছে।’
মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) দিবাগত রাতে এভাবেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে বিলাপ করে ছেলে ইয়াসিনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার আয়েশা বেগম।
মো. ইয়াসিন দুবাই বিমানবন্দর থেকে নিখোঁজের আট দিন পর বাড়িতে ফিরেছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে অংশগ্রহণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশের ছাত্রদের পক্ষে লেখালেখি করায় তাকে ইমিগ্রেশনে আটক করা হয়।
এ বিষয়ে দেশের জনপ্রিয় গণমাধ্যম ঢাকা পোস্ট ‘দুবাই বিমানবন্দর থেকে ‘নিখোঁজ’ নোয়াখালীর ইয়াসিন’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রচার করে।
ইয়াসিন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার জাহাজমারা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের উত্তর জাহাজমারা গ্রামের বাবুল মাঝিগো বাড়ির মো. বাবুল মাঝির ছেলে। তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে আলাইন শহরে থাকতেন। ২০২৩ সালের ১৬ আগস্ট তিনি আবুধাবি পাড়ি জমান।
জানা যায়, বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে ইয়াসিন ও তার ভাই জাহাঙ্গীর আবুধাবিতে মিছিল করেছিলেন। সে সময় ইয়াসিন পালিয়ে থাকলেও জাহাঙ্গীরসহ ৫৭ জনকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় এবং ৪৬ দিন কারাবন্দি হয়ে থাকতে হয়।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুরোধে তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে সব প্রবাসীদের ক্ষমা করে দেন আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। কিন্তু গত ২১ অক্টোবর দুবাই বিমানবন্দর থেকে নিখোঁজ হন ইয়াসিন। তিনি টিকিট কেটেও ফিরতে পারেননি।
ইয়াসিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আন্দোলনে আমি অংশগ্রহণ করায় তারা আমাকে দীর্ঘদিন ধরে খুঁজেছিল। আমি ভয়ে আলাইন শহর থেকে আবুধাবি শহরে চলি যাই। আমার ভাইয়ের কাগজপত্র চেক করার জন্য অনলাইনে যুক্ত হলে সে দেশের পুলিশ আমার আইডি পায় তারপর ২১ অক্টোবর আমাকে ফোন দেয়। আমি ভেবেছিলাম ড. ইউনুস স্যারের অনুরোধে যেহেতু ক্ষমা করে দিয়েছে তাহলে আমার আর সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু ফোন পেয়ে আমি ভয় পেয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে দেশে চলে আসতে চাই। কিন্তু রাত ১২টায় দুবাই বিমানবন্দর থেকে ইমিগ্রেশন পুলিশ আমাকে আটক করে। তারপর প্রায় আট দিন তারা আমাকে আটকে রাখে।
তিনি আরও বলেন, আমাকে তারা কোথায় রেখেছে তা আমি জানি না। কারো সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না। দেয়ালের দিকে মুখ করে থাকতে হতো। ছাত্রদের পক্ষ নেওয়ায় আমার ভাইসহ ৫৭ জনকে ৪৬ দিন এভাবে কষ্ট দিয়েছে। আমি তখন টের পেয়েছি সবাই কেমন কষ্ট পেয়েছে। আমি অনেক কান্নাকাটি করেছি কিন্তু তারা আমার কোনো কথা শোনেননি। শেষে আমি মায়ের কথা বলে হাউমাউ করে কান্নাকাটি করি। তারপর সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে বাংলাদেশ বিমানে তুলে দেয়।
সন্তানকে বুকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা মো. ইয়াসিনের মা আয়েশা বেগম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার সন্তান, আমার জাদু আমার বুকে এসেছে। আমার কাছে খুবই খুশি লাগছে। আমি খুশিতে আত্মহারা হয়েছি। আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া। তিনি আমার মনের ডাক শুনেছেন, আমার জাদুকে আমার বুকে ফেরত দিয়েছেন।
ইয়াসিনের বাবা বাবুল মাঝি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার দুই ছেলে ছাত্র আন্দোলনের কারণে নির্যাতিত হয়েছে। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সব সে দেশে আছে। আমি গরিব মানুষ এখন আর কর্ম করতে পারি না। ড. ইউনুস স্যারের কাছে আবেদন যদি আমার ছেলেদের দুবাইয়ের রেখে আসা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারে তাহলে আমাদের খুব উপকার হবে।
ইয়াসিনের ভাই জাহাঙ্গীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৫৭ জনকে গ্রেপ্তারের পর আমার ভাইকে খুঁজছিল পুলিশ। আমি ৪৬ দিন কারাগারে থাকার পর দেশশে আসি। ড. ইউনুস স্যারের কারণে আমাদের সবাইকে মুক্তি দেয়। ঘটনায় যেহেতু সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছে তাই আমার ভাইসহ সবাই ভেবেছে আর কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু পুলিশ প্রায় তিন মাস পর আমার ভাইকে কল দেয়। তাই সে ভয়ে টিকেট কেটে দেশে চলে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু দুবাই বিমানবন্দর থেকে সে আটক হয়। এক সপ্তাহের বেশি সময় তার কোনো খোঁজ ছিল না। সে বাড়িতে আসায় আমরা খুশি আছি। কর্মস্থলে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য আছে তাই আমরা যেনো আবার দুবাই যেতে পারি সেজন্য প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
এ বিষয়ে নোয়াখালী ওয়েলফেয়ার সেন্টারের সহকারী পরিচালক খুরশীদ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইয়াসিনের নিখোঁজের বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ইয়াসিন তার পরিবারের কাছে ফেরত এসেছে জেনে আমরা খুশি হয়েছি। আমাদের কাছে এর আগেও সংযুক্ত আরব আমিরাত-ফেরত বেশ কয়েকজন ব্যক্তির তালিকা রয়েছে। তাদেরকে যদি সে দেশেই ফেরত পাঠানো যায় তাহলে ভালো হয়। সেখানে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব কিছু রয়েছে।
নোয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ইসমাঈল ঢাকা পোস্টকে বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত-ফেরত প্রবাসীদের বিষয়ে সরকার থেকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তাদের সে দেশে যাওয়ার দাবি রয়েছে, পাশাপাশি তারা পুনর্বাসনে সহযোগিতা চায়। আমরা পুনর্বাসনে কোনো বরাদ্দ পাইনি তবে তাদের একটা স্মারকলিপি জেলা প্রশাসক স্যারের মাধ্যেমে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস স্যারের কাছে পাঠানো হয়েছে। যদি পুনর্বাসনে বরাদ্দ আসে তাহলে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
হাসিব আল আমিন/এএমকে