জাতিসংঘে বাইডেন-ইউনূস বৈঠক : বাংলাদেশ কতটা লাভবান?

জাতিসংঘে বাইডেন-ইউনূস বৈঠক : বাংলাদেশ কতটা লাভবান?

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যোগ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আমাদের প্রধান উপদেষ্টাকে ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষভাবে শুভেচ্ছা জানানো হয়।

‘কাউকে পেছনে না ফেলা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শান্তি, টেকসই উন্নয়ন ও মানবিক মর্যাদার অগ্রগতিতে একযোগে কাজ করা’—এই প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশন শুরু হয়েছে।

এমন একসময় বিশ্বনেতারা নিউইয়র্কের সদর দপ্তরে জড়ো হয়েছেন, যখন ইউরোপ, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে। আগামী দিনগুলোয় এই সংকট মোকাবিলা করে কীভাবে সম্মিলিতভাবে এই সংস্থাকে এগিয়ে নেওয়া যাবে, সে ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই।

২৪ সেপ্টেম্বর থেকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়েছে, বিতর্ক চলবে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, অধিবেশন শেষ হবে ৩০ সেপ্টেম্বর। প্রাসঙ্গিকভাবেই মনে হতে পারে বৈশ্বিক অনেক সমস্যার একটা সমাধান পাওয়ার একটা ক্ষেত্র হিসেবে বিশ্বনেতারা জাতিসংঘের শরণাপন্ন হন।

আফসোসের বিষয় হচ্ছে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যেসব বিষয় উত্থাপিত হয় এবং পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত হিসেবে গৃহীত হয়ে থাকে, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর কার্যত কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় এবং সেই সাথে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সাধারণ পরিষদের কোনো ক্ষমতা না থাকায় একে নিছক একটি মিলনমেলা ছাড়া কিছুই বলার সুযোগ থাকে না।

সাধারণত প্রতি বছর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের নিয়মিত বিতর্কের ফাঁকে বৈশ্বিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর কিছু উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এবারও বেশ কয়েকটি সে ধরনের বৈঠক এজেন্ডাভুক্ত রয়েছে। 

১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশনে বাংলাদেশের পথ চলা শুরু হয় এই বিশ্বফোরামে, এর আগে ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সদস্যপদ অর্জন করে। সময়ের হিসাবে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্ণ হলো ২০২৪ সালে।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যোগ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আমাদের প্রধান উপদেষ্টাকে ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষভাবে শুভেচ্ছা জানানো হয়।

বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই মুহূর্তে জাতিসংঘকে কেন্দ্র করে খুব একটা আশাবাদের কিছু না থাকলেও এই অধিবেশনে বিশ্ব নেতাদের সম্মিলনের মধ্য দিয়ে এবং অনেক রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের মধ্য দিয়ে দ্বিপক্ষীয়, কিংবা বহুপক্ষীয় সম্পর্ক ঝালাই করার সুযোগ থাকে।

বাংলাদেশের জন্য এবারের সম্মেলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কিছুদিন আগে দায়িত্ব নেওয়া নতুন সরকার প্রধানের সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্টের বৈঠক, ইতিমধ্যে যা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

অধ্যাপক ইউনূস মার্কিন রাজনীতির পরিচিত মুখ। অনেকটা সে কারণেই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের খুব একটা দৃষ্টান্ত না থাকলেও এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের শুরুতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ড. ইউনূসকে বুকে টেনে নেন, বাংলাদেশের বর্তমান সংস্কার নিয়ে ধারণা নেন এবং সবশেষে ড. ইউনূস সরকারের ওপর তার পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে ইতিমধ্যে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এক দশকের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বন্ধ থাকা জিএসপি সুবিধা ফেরত পাওয়া।

এছাড়া বাংলাদেশের চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সাম্প্রতিক সফরে কিছু আর্থিক সহায়তার আশ্বাস পাওয়া গেলেও সেটা আরও কীভাবে বাড়ানো যায় এবং বাণিজ্যিক ও কারিগরি সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকটি বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলে ধারণা করা যায়।

এর বাইরে জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তির পর থেকে সংস্থাটির সাথে বাংলাদেশ ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে এবং বৈশ্বিক অনেক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশের সম্পর্ককে যদি একনজরে আমরা ফিরে দেখার চেষ্টা করি তবে এটুকুই বলতে হয় বাংলাদেশ সবসময়ই জাতিসংঘের মূলনীতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কাজ করে যাচ্ছে।

উন্নত বিশ্বের ক্ষেত্রে যখন অনেক সময় দেখা যায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত পাস কাটিয়ে কিংবা জাতিসংঘের সনদের অবমাননা হয় এমন অনেক কাজই করা হচ্ছে এবং এর অজুহাত হিসেবে তথাকথিত বিশ্ব শান্তি এবং নিরাপত্তার অজুহাত দেওয়া হচ্ছে, তখন বর্তমান সময়ে জাতিসংঘ উন্নয়নশীল বিশ্বের অগাধ সমর্থন নিয়ে শত প্রতিকূলতার মাঝেও তার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ জাতিসংঘের নীতিমালার অধীনে তার কাজ করে যেতে সর্বদা সচেষ্ট। আর এক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো প্রামাণ্য তা হলো—

প্রথমত, উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ নিয়মিত জাতিসংঘে তাদের অনেক বাৎসরিক চাঁদা পরিশোধ না করলেও এবং ক্ষেত্র বিশেষে দীর্ঘদিন ধরে তা বকেয়া রাখলেও বাংলাদেশ নিয়মিত চাঁদা প্রদানকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা জাতিসংঘে আমাদের অঙ্গীকারকে আরও প্রতিষ্ঠিত করে;

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সবচেয়ে উজ্জ্বল উপস্থিতির জায়গাটি হচ্ছে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে। অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে সর্বাধিক সৈন্য প্রেরণকারী দেশ। ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী UNIIMOG এবং UNITAG নামক কর্মসূচিতে ইরাক এবং নামিবিয়াতে অংশগ্রহণ করে। 

এরপর থেকে বাংলাদেশকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সময়ের পরিক্রমায় শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বেড়েই চলছে। প্রথমে সেনাবাহিনী এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করলেও পরবর্তীতে নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী এবং বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীও এতে সংযুক্ত হয়। এ পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫৫৮ জন শান্তিরক্ষী ৪০টি দেশে ৬৩টি মিশনে অংশগ্রহণ করেছে।

শুরুতেই উল্লেখ করেছি বৈশ্বিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সমাধানের জন্য সাধারণ পরিষদকে নিয়ামক শক্তি ভাবার কোনো উপায় নেই। তবে এখানে একইসাথে এটাও উল্লেখ করা সঙ্গত যে সমাবেত বিশ্বনেতাদের বেশিরভাগই যেহেতু শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত শান্তির বাণী শান্তি বিনাশকারীদের জন্য এক অর্থবহ বার্তা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আর তাই বলা চলে এই শান্তির তাগিদেই এমন এক সম্মিলনের অংশ হওয়া।

জাতিসংঘের এত বছরের যত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অর্জন সেগুলো যদি এক করা হয় তাহলে এত ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যেও এর টিকে থাকার যথার্থতা অনুধাবন করা সম্ভব হবে। তাই কেবল বাংলাদেশ নয়, বাংলাদেশের মতো অনেক দেশ, তারা ক্ষুদ্র হলেও, নানা বিবেচনায় দুর্বল হলেও জাতিসংঘের মূলনীতিকে ধারণ করে বিশ্ব শান্তির ঝাণ্ডা উড়িয়ে চলছে।

 

ড. ফরিদুল আলম ।। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *