মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে চিকিৎসা অন্যতম। কিন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসীন মনোভাবের কারণে সেই চিকিৎসা থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। নেত্রকোণার কেন্দুয়ায় ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জনবল সংকট ও নানা অনিয়মে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। চিকিৎসা নিতে এসে, ডাক্তার সংকট, গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি বিকল, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, পানি সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যায় রোগীরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে চিকিৎসা অন্যতম। কিন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসীন মনোভাবের কারণে সেই চিকিৎসা থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। নেত্রকোণার কেন্দুয়ায় ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জনবল সংকট ও নানা অনিয়মে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। চিকিৎসা নিতে এসে, ডাক্তার সংকট, গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি বিকল, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, পানি সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যায় রোগীরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা বলছেন, হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সরা মানসম্মত সেবা দিতে পারছেন না। অপ্রতুল ডাক্তার ও রোগ নির্ণয়ের ন্যূনতম সুবিধা না থাকার কারণে রোগীদের ময়মনসিংহে রেফার্ড করার প্রবণতা প্রচুর। হাসপাতালে সিজারিয়ান বিভাগ চালু থাকলেও নেই আলট্রাসনোগ্রাম করার সুযোগ। কারণ আলট্রাসনোগ্রাম করার লোক নেই। পাশাপাশি খালি রয়েছে কার্ডিওলজি বিভাগও।
হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত সূত্র জানায়, কেন্দুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ মোট ৩৪ জন ডাক্তারের মধ্যে রয়েছেন ১১ জন। মেডিকেল অফিসার ১৩ জনের স্থলে ৪ জন, কনসালটেন্ট ১০ জনের স্থলে কর্মরত আছেন মাত্র ৫ জন। ২৫ জন নার্সের জায়গায় দায়িত্ব পালন করছেন ১৮ জন।
তবে নার্সিং বিভাগের লোকজন বলছেন, হাসপাতালে মিডওয়াইফ নার্সসহ মোট ৩৪টি পদ রয়েছে। তার বিপরীতে কাজ করছেন ২০ জন।
এছাড়াও ল্যাব টেকনিশিয়ান, ফার্মাসিস্ট, স্টোর কিপার, অফিস সহকারী, ক্লিনারসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ পদ একেবারে শূন্য রয়েছে। বেতন নিয়েও দায়িত্ব পালন করছেন না অ্যাম্বুলেন্স চালকের মতো পদের লোকজন। ফলে চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি ব্যাহত হচ্ছে অফিসিয়াল কার্যকম। হাসপাতালে মঞ্জুরিকৃত ৫২ জন জনবলের পরিবর্তে কাজ করছেন ২৮ জন। যেখানে শূন্য পদ রয়ে গেছে ২৪টি।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, আবাসিক মেডিকেল অফিসার, জুনিয়র কনসালটেন্ট (চর্ম ও যৌন), জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (কার্ডিওলজি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু), জুনিয়র কনসালটেন্ট (নাক কান গলা), সহকারী সার্জন (অ্যানেস্থেসিয়া), মেডিকেল অফিসার (পিএমও), মেডিকেল অফিসার (ইউনানি), নার্সিং সুপারভাইজার, সহকারী নার্স, পরিসংখ্যানবিদ, স্টোর কিপার, এমটি (ইপিআই), এমটি (ফিজিও থেরাপি) অফিস সহায়ক, মালি, ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট পদ শূন্য রয়েছে।
চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা অভিযোগ করে বলছেন, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের বেশির ভাগই বাহির থেকে কিনতে হয়। জরুরি প্রয়োজনে পাওয়া যায় না অ্যাম্বুলেন্স সেবাও।
হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়া রোগী মো. কাজল বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা যেমন-তেমন। একটা অ্যাম্বুলেন্স আছে, ড্রাইভার আছে, যিনি প্রতি মাসে বেতন নেন, কিন্তু ডিউটি করেন না। তাকে অ্যাম্বুলেন্সসহ কখনো পাওয়া যায় না। যার কারণে বাইরে থেকে রোগীদের তিন থেকে চার হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে ময়মনসিংহ যেতে হয় উন্নত চিকিৎসার জন্য।
অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে আসা নাজমুল হক বলেন, আমরা এখানে চিকিৎসা নিতে এলে তারা একটু ভালোভাবে পরীক্ষা না করেই ময়মনসিংহে প্রেরণ করে দেন। আর ওষুধের বিষয়ে যদি বলি, ওষুধ বেশিরভাগই বাইরে থেকে কিনতে বলেন তারা। হাসপাতালে শুধু অল্প দামের স্যালাইন ও অল্প কিছু ওষুধ পাওয়া যায়। বাকি সব ওষুধ বাইরে থেকেই কিনতে হয়।
আরেক রোগী মাহাবুব আলম বলেন, আমি গতকাল ভর্তি হয়েছি। ভর্তি হওয়ার পর বেশিরভাগ ওষুধই বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়েছে। আমরা যারা সাধারণ জনগণ, আমরা চাই সরকারি চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হতে। কিন্তু আমরা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও ওষুধ পাই না। তাহলে আমরা সাধারণ জনগণ চিকিৎসা কীভাবে করব?
বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখাতে আসা আফিয়া আক্তার বলেন, যদি কোনো কারণে ভর্তি থাকা হয়, তাহলে হাসপাতালের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে একটা অস্বস্তি কাজ করে। ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় আমাদের জন্য। জরুরি বিভাগে প্রচুর ভিড় থাকার কারণে ডাক্তাররা আমাদের গুরুত্ব দিতে চান না। নিয়মিত ডাক্তার থাকলে এত রোগীর চাপ থাকতো না। এত করে ডাক্তাররাও রোগীদের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলে চিকিৎসা দিতে পারতেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একজন সিনিয়র নার্স ঢাকা পোস্টকে জানান, এই হাসপাতাল মোট ৩৪ জন নার্সের পদ রয়েছে। তার মধ্যে ২০ জন নার্স দায়িত্ব পালন করছেন। কেন্দুয়া এলাকায় মারামারির ঘটনা একটু বেশি হয়। এখন সব স্বাভাবিক থাকলেও মাঝে মধ্যে প্রচুর পরিমাণে আহত রোগী এসে হাজির হয়। তখন সামলানো খুব কষ্টসাধ্য হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, এটা যেহেতু উপজেলা শহর, এখানে সব ওষুধ সব সময় থাকে না। অনেক সময় রোগীরা ওষুধ না পেয়ে খারাপ আচরণ করে আমাদের সাথে।
অপরিচ্ছন্নতার বিষয়ে এই নার্স বলেন, লোকবল সংকটের মধ্যেও তুলনামূলক পরিষ্কার থাকে আমাদের এই হাসপাতাল। কিন্তু রোগীরা সচেতন না হওয়ার কারণে তারা কিছুক্ষণের মধ্যে আবার নোংরা হয়ে যায়। এমনকি হাসপাতালে অনেকে ধূমপান করেন, তাদের কিছু বলতে গেলে উল্টো বিভিন্ন কথা শুনিয়ে দেন।
জনবল সংকটে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন দায়িত্বরত ডাক্তাররা। কেন্দুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গাইনি কনসালটেন্ট নাদিয়া মির্জা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এখানে যে সকল সার্ভিস আছে তার মধ্যে নরমাল ডেলিভারি ও সিজারিয়ান সেকশন চালু আছে। সিজারিয়ান সেকশনের ক্ষেত্রে আমাদের ওটি বা ওষুধপত্র নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে আমরা কাজের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বোধ করি একটি ব্লাড ব্যাংকের। যেমন আমাদের প্রায়ই প্রিভিয়াস সিজারিয়ান সেকশন করতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে ক্লিনিক্যালি অথবা ইনভেস্টিগেশনের ওপরে নির্ভর করতে হয়। সে ক্ষেত্রে দেখা যায় আমরা ব্লাড ডোনার রেডি রাখি। কিন্তু এখানে যদি একটা ব্লাড ব্যাংক থাকতো তাহলে আমরা নিশ্চিন্তে রোগীদের সেবা দিতে পারি। আমি অবশ্যই চাইবো এখানে যেন সিজারিয়ান সেকশনের সুবিধাটি অব্যাহত থাকে। পাশাপাশি একটা ওটির আইডিয়াল এনভায়রনমেন্টের যে বিষয়টা সেটা যদি নিশ্চিত করা হয় তাহলে খুব ভালো হয়। যেমন ছোট পরিসরে একটি ব্লাড ব্যাংক ও ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুতের জন্য জেনারেটরের ব্যবস্থা রাখা উচিত বলে মনে করে করি।
জনবল সংকটের ফলে চিকিৎসাসেবা ও দাফতরিক কাজসহ নানা রকম অসুবিধা হচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন ভারপ্রাপ্ত উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নিজাম উদ্দিন।
তিনি বলেন, আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৫০ বেডের একটি হাসপাতাল। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং আবাসিক মেডিকেল অফিসারের মতো পদ খালি পড়ে আছে। সব মিলিয়ে ৩৪ জন চিকিৎসকের বিপরীতে রয়েছেন ১১ জন। ২৫ জন নার্সের মধ্যে রয়েছেন ১৮ জন। পাশাপাশি অন্যান্য লোকবল সংকটও রয়েছে। একটি অ্যাম্বুলেন্স আছে তার ড্রাইভার ডিউটিতে আসে না। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো সে ডিউটিতে আসেনি।
তিনি আরও যোগ করে বলেন, আমাদের এখানে ওয়ার্ড বয় ও পরিচ্ছন্ন কর্মীরও ঘাটতি রয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসনিক কর্মকর্তা কর্মকর্তাদের পদ খালি থাকায় ব্যাহত হচ্ছে হাসপাতালের কার্যক্রম। ডাক্তারের সংকট থাকায় আমরা চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছি। আমাদের এখানে এক্সরে, ইসিজি, রক্ত পরীক্ষা, আলট্রাসনোগ্রাম ও প্রস্রাব পরীক্ষার সুবিধা আছে। তবে আল্ট্রাসনোগ্রাম সুবিধা কিছু দিন যাবত বন্ধ আছে। জনবল সংকটের বিষয়টি সমাধানের জন্য আমরা সিভিল সার্জনকে ইতিমধ্যে অবহিত করেছি। তিনি সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।
নেত্রকোণার সিভিল সার্জন ডা. অনুপম ভট্টাচার্য বলেন, কেন্দুয়া হাসপাতালসহ সকল হাসপাতালেই চিকিৎসক সংকট রয়েছে। এ বিষয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। আশা করি অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যেই চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি সমাধান হবে। তাছাড়া স্বাস্থ্যকর্মী ও অফিস স্টাফসহ আরও কিছু জনবলের ঘাটতি রয়েছে। আমাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান আছে, এই প্রক্রিয়া শেষ হলেই জনবল সংকটের বিষয়টি সমাধান হবে। এছাড়া অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার অনুপস্থিতির বিষয়টি আমি জেনেছি। তার বিষয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আরএআর