দেশে ক্রমেই ভয়াবহ হচ্ছে ডেঙ্গু। মশাবাহিত এ জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটা লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে। গত আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে রোগী বেড়েছে প্রায় তিনগুণের বেশি। এ পরিস্থিতিতে রাজধানীর অন্যান্য হাসপাতালের মতো চাপ বাড়ছে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তবে, এ হাসপাতালে এসেও যেন নিস্তার নেই রোগী ও তাদের স্বজনদের। যেখানে নিশ্চিন্তে চিকিৎসা নেবেন, সেখানে উল্টো ডেঙ্গু সংক্রমণের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন তারা।
দেশে ক্রমেই ভয়াবহ হচ্ছে ডেঙ্গু। মশাবাহিত এ জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটা লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে। গত আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে রোগী বেড়েছে প্রায় তিনগুণের বেশি। এ পরিস্থিতিতে রাজধানীর অন্যান্য হাসপাতালের মতো চাপ বাড়ছে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তবে, এ হাসপাতালে এসেও যেন নিস্তার নেই রোগী ও তাদের স্বজনদের। যেখানে নিশ্চিন্তে চিকিৎসা নেবেন, সেখানে উল্টো ডেঙ্গু সংক্রমণের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসপাতাল গেটসহ চতুর্পাশে জমে থাকা পানিতে দেদারসে বংশবিস্তার করছে মশা। এতে করে সেবাগ্রহীতাদের মাঝে প্রতিনিয়ত ডেঙ্গু সংক্রমণের ভয় বাড়ছে। বিষয়টি ভাবাচ্ছে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদেরও। এমনকি ইতোমধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন কয়েকজন নার্স ও চিকিৎসক।
রোববার (৬ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মুগদা মেডিকেলের গেটের ঠিক সামনেই জমে রয়েছে পানি, যেখানে এডিস মশার লার্ভা জন্মানোর শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এছাড়া, জমে থাকা পানিতে ক্ষতিকর রোগ-জীবাণু থেকে অন্যান্য অসুখে সংক্রমণের ভয় তো রয়েছেই। এর বাইরেও জমে থাকা পানি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে।
স্থানীয় এলাকাবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃষ্টি হলেই হাসপাতাল গেটের সামনে পানি জমে থাকে। রাস্তার খানাখন্দ এবং ড্রেন না থাকায় বৃষ্টির পানি বেরিয়ে যেতে পারে না। হাসপাতাল গেটের সামনে ডাবের খোসা, পলিথিনসহ সবসময় নানা ধরনের ময়লা-আবর্জনা জমে থাকে। তাছাড়া, মুগদা এলাকা এখনো তুলনামূলক অনুন্নত এবং শহরের একপ্রান্তে হওয়ায় কচুরিপানা ভরা জলাশয়, পতিত জমি ও নোংরা পরিবেশ চোখে পড়ে। যা মশা জন্মানোর জন্য উপযুক্ত।
হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা চলছে ৮ম তলায়। এছাড়া, বড়দের জন্য হাসপাতালের ১১ তলায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মশার উৎপাতে ভর্তি থাকা রোগীদের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছে।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়েছেন মো. আরাফাত হোসেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমি গত চারদিন আগে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। তিন দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর আজ থেকে আবারও মনে হচ্ছে জ্বর বাড়ছে। ভাবছিলাম আজ-কালকের মধ্যে ছুটি নিয়ে চলে যাব। কিন্তু নতুন করে যে কেন আবার জ্বর বাড়ছে, বুঝতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, মুগদা-যাত্রাবাড়ী এলাকায় সবসময় ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। মনে হচ্ছে এবারও এসব এলাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনেকটা বেশি। কিন্তু সে তুলনায় বাড়ি মালিকদের তেমন তৎপরতা নেই, সরকারিভাবেও দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। অধিকাংশ নতুন বাসা-বাড়ির ছাদে দিনের পর দিন পানি জমিয়ে রাখা হয়েছে। কেউ গিয়ে কোনোদিন স্প্রে বা কোনো ওষুধও ছিটায় না।
মারুফ মিয়া নামের এক রোগীর স্বজন বলেন, রোগী নিয়ে গত দুই দিন ধরে মুগদা হাসপাতালে আছি। হাসপাতালে এত পরিমাণ ডেঙ্গু রোগী আসছে, এসব দেখে খুবই ভয় লাগছে। বিকেল হতেই হাসপাতালের ভেতরে মশা ঘুরঘুর করতে থাকে। এ এলাকার আশপাশের যে অবস্থা, মনে হচ্ছে সুস্থ রোগী হাসপাতালে এসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারে।
তিনি বলেন, হাসপাতালের সামনেই যদি দিনের পর দিন জলাবদ্ধতা লেগে থাকে, স্বাভাবিকভাবে সেখানে মশা জন্মাবে এবং সেগুলো আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে যাবে। তাই যতদ্রুত সম্ভব রাস্তাটি সংস্কার করতে হবে এবং মশা নিধনে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
বাসিন্দাদের একদিকে দুর্ভোগ, অন্যদিকে ডেঙ্গুর ভয়
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের দিক দিয়ে এগিয়ে ছিল রাজধানীর দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্গত মুগদা এলাকা। এ এলাকার সীমানা ঘেঁষেই মান্ডা খাল। যার একপ্রান্ত বন্ধ হয়ে আছে ময়লা-আবর্জনায়। যাদের বাসা-বাড়ি খালের আশপাশে, তাদের যন্ত্রণা আরও বেশি। স্থানীয়দের অভিযোগ, মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশনের যথাযথ উদ্যোগ নেই। উদ্যোগই বা কে নেবে, এখন তো কোনো জনপ্রতিনিধিও নেই।
রফিকুল ইসলাম নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে সামান্য বৃষ্টি হলে হাঁটু সমান পানি হয়ে যায়। বাসা-বাড়ির আশপাশে ময়লা পানি জমে থাকে, যেখানে প্রচুর মশা হয়। মশা দিনেও কামড়ায়, রাতেও কামড়ায়। দিন-রাত মশার কামড়ে আমরা অতিষ্ঠ।
তিনি বলেন, এলাকায় মশার উপদ্রব প্রচুর বাড়ছেন সিটি কর্পোরেশনের কোনো উদ্যোগ নেই। কিছুদিন পরপরই লোকজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের বাসায় ছোট শিশু আছে, বয়স্ক মানুষ আছে, তাদের নিয়ে তো সার্বক্ষণিক ভয় থাকে।
জ্বর-ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন চিকিৎসক-নার্সরাও
এদিকে, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে মেঝেতেও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওয়ার্ডে জায়গা না হওয়ায় বাইরেও অতিরিক্ত বেড বসিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। রোগীদের চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। এমনকি হাসপাতালে দায়িত্ব পালনকালে চিকিৎসক-নার্সরাও ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নার্স বলেন, হাসপাতালে যারা কাজ করেন, তাদের অধিকাংশ আশপাশের বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে থাকেন। একদিকে বাসায় গেলে মশার কামড় খেতে হয়, হাসপাতালে এলেও একই দশা। গত মাসে আমাদের এক স্টাফ নার্স ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। মাঝেমধ্যে শুনি ডাক্তারও আসেন না, তারাও জ্বরে ভুগছেন। এমনটা নিয়মিতই দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, হাসপাতালের গেটের সামনে সারা বছর হাঁটু সমান পানি জমে থাকে। পেছনের দিকেও নানা গর্ত-জলাশয়ে নোংরা পানি জমে থাকে। এসব স্থানে প্রতিদিন যে কী পরিমাণ মশার জন্ম হয়, তা আমাদের নজরের বাইরে। যে কারণে সন্ধ্যার পর ডিউটি পড়লে মশার কামড় ঠেকাতেই ব্যস্ত থাকতে হয়।
সেপ্টেম্বর থেকেই বাড়তে থাকে রোগীর চাপ
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিনিয়ত ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। বর্তমানে হাসপাতালটিতে ১৩৫ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গত সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন তিন হাজার ২৭০ জন। এর মধ্যে শিশু ৮৩৯ জন। সেপ্টেম্বরে শিশুসহ মারা গেছেন আটজন। আর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট আট হাজার ৮১০ জন ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩২ জনের।
হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সত্যজিৎ সাহা বলেন, সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে আমাদের হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চাপ বাড়তে শুরু করেছে। অধিকাংশ রোগী জ্বর, শরীরে ব্যথা বা মাথা ব্যথা, পেটের সমস্যা নিয়ে আসছেন। এছাড়া, উপসর্গ ছাড়াও কিছু রোগী আসছেন। এ অবস্থায় আমাদের যে জনবল আছে, তা দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছি। যদিও চিকিৎসক-নার্সদের ওপর কিছুটা চাপ যাচ্ছে।
তিনি বলেন, রাজধানীর অন্যান্য হাসপাতালের তুলনায় মুগদা হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী তুলনামূলক বেশি। আশপাশের এলাকা ছাড়াও দূর থেকে রোগী আসছেন। গত বছরও মুগদা হাসপাতালে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী ছিল। তখনো হাসপাতালের মেঝেতে রোগী রাখা হয়েছিল। তবে, এবার যদি রোগীর সংখ্যা আরও বেশি বেড়ে যায়, তাহলে তাদের জন্য হাসপাতালের ১২ তলা প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
চিকিৎসায় সংকট নেই, মশা নিয়ে আছে ভয়
ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় কোনো সংকট না থাকলেও চতুর্পাশে ঘুরে বেড়ানো মশা নিয়ে ভয় রয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল পরিচালক ডা. এস এম হাসিবুল ইসলাম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ধীরে ধীরে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। তবে, সংখ্যা বাড়লেও যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত। আমাদের ওয়ার্ড প্রস্তুত, আমাদের ডাক্তার-নার্সরাও প্রস্তুত। ওষুধপত্রের কোনো সংকট নেই। ডেঙ্গু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও নিয়মমতো হচ্ছে। হাসপাতালের চিকিৎসা নিয়ে কোনো সংকট না থাকলেও হাসপাতালের চতুর্দিকের পরিবেশ নিয়ে আমরা খুব ঝামেলায় আছি।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের ঠিক সামনের রাস্তায় সারা বছর পানি-আবর্জনা জমে থাকে। এর কারণে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে বলে আমার ধারণা। এমনকি এসব রোগীর কারণে আমাদের হাসপাতালের অন্যান্য রোগীরাও ভয়ে থাকে। আমরা সবসময় রোগীদের মশারি টানিয়ে রাখার পরামর্শ দেই। কেউ হয়তো নির্দেশনা মানে, আবার কেউ মানে না।
পানি ও আবর্জনা পরিষ্কারে কোনো উদ্যোগে নেওয়া হয়েছে কিনা? এ প্রশ্নের জবাবে পরিচালক বলেন, আমাদের কাজ তো গিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করা না। আমরা চাইলেও সেটি পারব না। এখন তো আবার সিটি কর্পোরেশনের কোনো লোকজন দায়িত্বে নেই। গত ১০-১২ দিন ধরে সামনের রাস্তাটায় একদম হাঁটু পানি জমে রয়েছে। এসবের মধ্যে আবার ডাবের খোসাসহ নানা ময়লা-আবর্জনা পড়ে আছে। এগুলোর মধ্যে প্রতিনিয়ত মশার বংশবিস্তার হচ্ছে এবং এগুলো হাসপাতালজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা মনে করছি, ডেঙ্গুতে অপ্রত্যাশিত মৃত্যুগুলো এ কারণেই কমছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, এ বছর দেশে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) বিভিন্ন হাসপাতালে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রোগী ভর্তি হয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে। এরপর রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুও সবচেয়ে বেশি হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে।
এ বছর ডেঙ্গুতে পুরুষেরা বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। তবে, বেশি মৃত্যু হয়েছে নারীদের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ডেঙ্গু নিয়ে ১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যু বেশি।
টিআই/কেএ