খুলনায় দিনভর বৃষ্টি, উপকূলবাসীর আতঙ্ক দুর্বল বেড়িবাঁধ

খুলনায় দিনভর বৃষ্টি, উপকূলবাসীর আতঙ্ক দুর্বল বেড়িবাঁধ

ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ বাংলাদেশে সরাসরি আঘাত হানার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তবে এর প্রভাবে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে ঝড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একইসঙ্গে দানার প্রভাবে খুলনাসহ ১৪ জেলায় ২-৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের আভাস দিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর।

ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ বাংলাদেশে সরাসরি আঘাত হানার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তবে এর প্রভাবে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে ঝড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একইসঙ্গে দানার প্রভাবে খুলনাসহ ১৪ জেলায় ২-৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের আভাস দিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর।

খুলনা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ সিনিয়র আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, খুলনায় ঘূর্ণিঝড় দানা’র প্রভাবে দিনভর বৃষ্টি হয়েছে। বিকেল পর্যন্ত খুলনায় ৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এবারের ঘূর্ণিঝড় খুলনার উপকূলে সরাসরি আঘাত আনার সম্ভাবনা নেই। তবে এর প্রভাব থাকবে। রাতে বৃষ্টি বাড়বে। ঝড়ের কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।

এদিকে, একের পর এক ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বেড়িবাঁধ ভেঙে বিপর্যস্ত উপকূলীয় খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটার লাখো পরিবার। তাদের প্রত্যেকের জীবনের গল্প প্রায় একই রকম। এবার আবার ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ নিয়ে উপকূলজুড়ে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। উপকূলীয় এলাকার মানুষের আতঙ্কের কেন্দ্রবিন্দু দুর্বল বেড়িবাঁধ। জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে বা উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশের আশঙ্কায় রয়েছেন তারা।

বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) ঘূর্ণিঝড় দানা’র প্রভাবে উপকূলীয় জেলা খুলনায় দিনভর বৃষ্টি হয়েছে। এদিন সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত খুলনায় ৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

এর আগে গত ২৬ ও ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালে ৩৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে ১৫ কিলোমিটার ইতোমধ্যে মেরামত সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু ২৩ কিলোমিটার জরাজীর্ণ বাঁধ মেরামত করা সম্ভব হয়নি। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে জলোচ্ছ্বাস বা জোয়ারের পানির চাপ বাড়লে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, খুলনার বিভিন্ন উপজেলায় ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সেই স্থানগুলোতে নজর রেখে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবহিত করা হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের সময় অস্বাভাবিক জোয়ারের পানির চাপ ও বাতাসে অনেক স্থানে বেড়িবাঁধের নদীর দিকের অংশ ক্ষয়ে প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। কোথাও কোথাও ওপরের মাটি ধুয়ে বাঁধ নিচু হয়ে গেছে। এরপর গত পাঁচ মাসেও তা সংস্কার না করায় বাঁধের অবস্থা আরও জরাজীর্ণ হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কয়রা উপজেলার দশহালিয়া, শিকারিবাড়ি, হোগলা, কালীবাড়ি, গুরিয়াবাড়ি, ৪, ৫ ও ৬ নম্বর কয়রা, মঠবাড়ি এবং কাটমারচর এলাকার প্রায় ৭.৮৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া দাকোপ উপজেলার কাকড়াবুনিয়া, বানিশান্তা, নিশানখালী, আন্ধারমানিক, আড়াখালী, কালিবাড়ী, খলিসা, মৌখালী, রায়বাড়ি, তাঁতখালী ও তিলডাঙ্গা এলাকায় ৪.২৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধও ঝুঁকিতে।

স্থানীয়রা জানান, গত শনিবার দাকোপ উপজেলার লক্ষ্মীখোলা গ্রামে প্রায় ৪০ মিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড দ্রুত জিও টিউব দিয়ে কোনোমতে তা মেরামত করেছে। তবে জায়গাটি এখনো পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত হয়নি।

এ ছাড়া, জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে পাইকগাছা উপজেলার জামাইপাড়া, বাসাখালী, হারিখালী, বাইনতলা খেয়াঘাট, পশ্চিম কানাইমুখী, ননিয়াপাড়া, পাইশমারী, কুড়ুলিয়া, সেলেমানপুর ও পুরাইকাটি এলাকার ৭.৪৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ।

বটিয়াঘাটা উপজেলার বারোভূঁইয়া, কড়িয়া, কড়িয়া জব্বারখালী, ঠাকুরানবাড়ি, বুজবুনিয়া, দ্বীপ বরণপাড়া, কল্যাণশ্রীপুর, বটিয়াঘাটা বাজার এলাকার ৩.২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থাও জরাজীর্ণ।

কয়রা উপজেলার রেজাউল ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন বছরে অন্তত দুটি ঝড় আসে। আমরা আতঙ্কে থাকি বাঁধ নিয়ে। বাঁধ ভেঙে গ্রামে পানি ঢুকে ঘের, ফসল ও ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়। এতে দুর্ভোগের সীমা থাকে না। এই অবস্থা থেকে বাঁচতে প্রয়োজন টেকসই বেঁড়িবাধ।

ইনিশিয়েটিভ ফর কোস্টাল ডেভেলপমেন্টের (আইসিডি) প্রতিষ্ঠাতা আশিকুজ্জামান আশিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাঁধ নিয়ে মানুষের শঙ্কার শেষ নেই। এবারের ঝড় উপকূলে সরাসরি আঘাত না হানলেও জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা রয়েছে। এতে বাঁধ নিয়ে চিন্তিত উপকূলের মানুষ। এখানকার মানুষের সাইক্লোন সেল্টারে যাওয়ার প্রবণতা কম।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সকাল থেকে উপকূলে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি নিয়ে সমস্যা নেই। তবে উপকূলের মানুষের আতঙ্ক দুর্বল বেঁড়িবাধ। ঝড়ের সরাসরি আঘাত উপকূলে না এলেও জলোচ্ছ্বাস হবে। উপকূলের মানুষ ঝড়ের চেয়ে জলোচ্ছ্বাসকে বেশি ভয় পায়। এতে দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া জোয়ারের সময়ে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে পারে।

তিনি অভিযোগ বলেন, প্রতিবছর বরাদ্দ হয়, কিন্তু বাঁধ সঠিকভাবে মেরামত হয় না। ১৫৫ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে কয়রায়। এরমধ্যে সাড়ে ৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া অনেক স্থানে বাঁধ দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। এই দুর্বল বাঁধ নিয়ে মানুষের যত চিন্তা। তবুও মানুষ সতর্ক রয়েছে। কিছু হলে দ্রুত মেরামতের জন্য নারী-পুরুষ সবাই মিলে একত্রে বাঁধ মেরামতে কাজ করে।

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনা-২-এর নির্বাহী মো. আশরাফুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ ও বটিয়াঘাটা এই চার উপজেলায় ৬৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। সম্প্রতি ২৩ কিলোমিটার বাঁধ মেরামতের জন্য সম্প্রতি দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ কোটি টাকা। আপাতত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কয়েকটি স্থানে কিছু মেরামত কাজ করা হয়েছে। এবারের ঝড়ে এখন পর্যন্ত তেমন সমস্যা হয়নি। তবুও আমরা প্রস্তুত রয়েছি। ঝড় পরবর্তী সময়ে কোনো বাঁধ মেরামতের প্রয়োজন হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আবহাওয়া অফিস জানায়, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ২-৩ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। এর ফলে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় দানা মোকাবিলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে খুলনা জেলা প্রশাসন।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ নিজ কর্মস্থলে থাকার জন্য বলা হয়েছে। সতর্ক থাকার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিপদ সংকেত জারি হলে তারা এলাকায় মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করবেন। শুকনো খাবার, ওষুধ, ঢেউটিন ও নগদ টাকা প্রস্তত রাখা হয়েছে। প্রস্তত রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি নেই।

খুলনা জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার জন্য ৬০৪টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যাতে পরিস্থিতি অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার লোকজন আশ্রয় নিতে পারেন। এসব শেল্টারে মোট ৩ লাখ ১৫ হাজার ১৮০ জন আশ্রয় নিতে পারবে। এ ছাড়া তিনটি মুজিব কিল্লায় ৪৩০ জন মানুষ ও ৫৬০টি গবাদিপশু রাখা যাবে।

খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ত্রাণ তহবিলে ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকা, শিশুখাদ্যের জন্য ৪ লাখ টাকা, গোখাদ্যের জন্য ৪ লাখ টাকা এবং ৭০৭ টন চাল মজুত রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজন আসার পর এগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী ইউএনওদের মাধ্যমে বরাদ্দ করা হবে। কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা এই চারটি উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্র ৪৩১টি। এগুলোতে ২ লাখ ৬০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে।

এমজেইউ

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *