কমালা হ্যারিসের ‘রানিং মেট’ কে এই টিম ওয়ালজ?

কমালা হ্যারিসের ‘রানিং মেট’ কে এই টিম ওয়ালজ?

কয়েক মাস আগেও যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার বাইরে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া টিম ওয়ালজকে খুব একটা কেউ চিনতেন না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আবহে মিনেসোটার এই গভর্নর এখন আলোচনার কেন্দ্রে।

কয়েক মাস আগেও যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার বাইরে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া টিম ওয়ালজকে খুব একটা কেউ চিনতেন না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আবহে মিনেসোটার এই গভর্নর এখন আলোচনার কেন্দ্রে।

কমালা হ্যারিসের রানিং মেট তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যদি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হ্যারিস জেতেন, তাহলে টিম ওয়ালজ হবেন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট।

টেলিভিশনের পর্দায় রিপাবলিকান সম্পর্কে তার একটা মাত্র বাক্য, “এই মানুষগুলো একেবারে অদ্ভুত” – টিম ওয়ালজকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে।

৬০ বছরের ওয়ালজ মিশুকে, অকপট এবং বিরোধী রিপাবলিকানদের নিশানা করতে তীক্ষ্ণ ভাষা ব্যবহার করেন। তার রাজনীতিতে প্রবেশের আগের অধ্যায়ও বেশ উল্লেখযোগ্য। বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন, ফুটবল কোচ ছিলেন। খুব অল্প বয়সে মার্কিন সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি যেখানে ‘মেরুকরণ’ নতুন ঘটনা নয়, সেখানে তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, রিপাবলিকান প্রভাবিত এলাকায় জয় লাভ এবং মিনেসোটার গভর্নর হিসাবে বামপন্থি নীতিগুলো পাস করার মতো পদক্ষেপ বিশেষ গুরুত্ব রাখে।

টিম ওয়ালজের পরিবারের বাসস্থল নেব্রাস্কার গ্রামীণ অঞ্চলে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ন্যাশনাল গার্ডে (রাজ্যভিত্তিক আধা-সামরিক বাহিনী) যোগ দেন। তিনি ২৪ বছর এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে ছিলেন।

তার বাবা, একজন পাবলিক স্কুল প্রশাসক ছিলেন। তিনিই টিম ওয়ালজকে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য উৎসাহ দিয়েছিলেন। ফুসফুসের ক্যান্সারে তার বাবার মৃত্যু হয়। সেই সময় ওয়ালজের বয়স ১৯ বছর।

তার সাদামাটা জীবন যাপনের কথা জানিয়েছেন মিনেসোটার গভর্নর। তিনি বলেছেন কীভাবে সোশাল সিকিউরিটি (সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প) তার মাকে সাহায্য করেছে, ‘জিআই বিল’ তার কলেজ শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করেছে।

শিক্ষকতায় ডিগ্রীধারী টিম ওয়ালজ এক বছরের জন্য চীনে শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সেই সময়েই তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারে গণহত্যা হয়েছিল। পরে তিনি স্ত্রী গোয়েন হুইপলকে নিয়ে সেখানে হানিমুন করতে গিয়েছিলেন। মার্কিন শিক্ষার্থীদের জন্য চীনে গ্রীষ্মকালীন শিক্ষামূলক ভ্রমণের আয়োজনও করেছিলেন।

নেব্রাস্কায় ফিরে আসার পরে, ওয়ালজ শিক্ষক এবং আমেরিকান ফুটবল কোচ হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। পরে তার স্ত্রী, যিনি ওই স্কুলেরই শিক্ষক ছিলেন, টিম ওয়ালজকে তার জন্মস্থান মিনেসোটায় ফিরিয়ে আনেন।

মানকাতো ওয়েস্ট হাই স্কুলে যোগ দেন তিনি। ওই বিদ্যালয়ে আমেরিকান ফুটবল প্রোগ্রাম তৈরি করতে সহায়তা করেছিলেন ওয়ালজ যার হাত ধরে প্রথমবার স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করে মানকাতো ওয়েস্ট হাই স্কুল।

ওয়ালজ যখন শিকাগোতে ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে ভাষণ দিয়েছিলেন, তখন সেই টিমের প্রাক্তন সদস্যরাও মঞ্চে উপস্থিত হয়েছিলেন। পার্টির বিশ্বস্তদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার সময় বারবার তার মুখে আমেরিকান ফুটবল সম্পর্কিত কথাবার্তাই শোনা যাচ্ছিল।

শিক্ষকতা করাকালীন ‘গে-স্ট্রেট অ্যালায়েন্স’-এর অনুষদ উপদেষ্টা হতে রাজি হওয়ার জন্য প্রশংসাও কুড়িয়েছিলেন টিম ওয়ালজ। যে সময় তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেই সময় কিন্তু সমকামীদের বিষয়ে অনেকেই ভুরু কুঁচকাতেন।

মার্কিন প্রতিনিধি সভার জন্য প্রার্থী হিসাবে মিনেসোটার প্রথম কংগ্রেসনাল ডিস্ট্রিক্ট থেকে নির্বাচনে লড়েছিলেন তিনি। দক্ষিণ মিনেসোটা জুড়ে বিস্তৃত এই গ্রামীণ অঞ্চল মূলত কৃষি প্রধান এবং রিপাবলিকান প্রভাবিত।

তবে ওয়ালজ একজন মধ্যপন্থী হিসাবে তার প্রচার চালিয়েছিলেন। তিনি মূলত জনসেবা এবং প্রবীণদের বিভিন্ন বিষয়ের উপর জোর দিয়েছিলেন। এইসব কারণে নির্বাচনের ফল তার পক্ষে যায়।

কংগ্রেসে টিম ওয়ালজের ১২ বছর সময়কালে, তার মতাদর্শ ঠিক কোন দিকে তা নির্ধারণ করা কঠিন ছিল।

তিনি ‘অ্যাফরডেবল কেয়ার অ্যাক্ট’ (রোগীর সুরক্ষা এবং সাশ্রয়ী মূল্য সম্পর্কিত আইন)-এর পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর বিলসহ লেবারপন্থী পদক্ষেপ যৌথভাবে স্পনসর করেছিলেন এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করার জন্য ‘ক্যাপ-এন্ড-ট্রেড’ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছিলেন। যদিও সেই (ক্যাপ-এন্ড-ট্রেড) প্রচেষ্টা সফল হয়নি।

কিছু ক্ষেত্রে রিপাবলিকানদের সঙ্গেও তার মতামত মিলে গিয়েছে।

তিনি ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে অর্থায়ন অব্যাহত রাখার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকারী শরণার্থীদের কঠোর যাচাই-বাছাই সমর্থন করেছিলেন এবং ২০০৮ সালের আর্থিক বিপর্যয়ের পরে ব্যাংক ও গাড়ি সংস্থাগুলির ওবামা-যুগের ‘বেলআউট’ (সরকারী তরফে ধুঁকতে থাকা সংস্থাকে আর্থিক সাহায্য) আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন।

ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন (এনআরএ) সমর্থিত প্রার্থী টিম ওয়ালজ আক্রমণাত্মক অস্ত্রের উপর নিষেধাজ্ঞার পক্ষে কথা বলেছিলেন পার্কল্যান্ড স্কুলে শ্যুটিংয়ের ঘটনার পর। এনআরএ-র সমর্থন হারান তিনি। এনআরএ কিন্তু একসময় তার প্রচার তহবিলে অনুদানও দিয়েছিল।

২০১৮ সালে ওয়ালজ মিনেসোটা গভর্নরের জন্য নির্বাচনি দৌড়ে ১১ পয়েন্টেরও বেশি ব্যবধানে জিতেছিলেন। তবে তার প্রথম মেয়াদ কোভিড মহামারী এবং মিনিয়াপোলিসে এক পুলিশ অফিসার কর্তৃক জর্জ ফ্লয়েড নামে এক ব্যক্তির হত্যার ঘটনার কারণে আলোচনার উঠে এসেছিল।

জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদে কিছু বিক্ষোভ সহিংস হয়ে উঠলেও ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েনে বিলম্ব করার পাশাপাশি কোভিডকালে মিনেসোটাতে ২৫ কোটি ডলারের জালিয়াতি স্কিমের ঘটনার তদন্ত করতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগে টিম ওয়ালজের তীব্র সমালোচনা করে রিপাবলিকানরা।

এরপর পুনর্নির্বাচনে সংকীর্ণ ব্যবধানে হলেও তিনি জিতেছিলেন। ডেমোক্র্যাটরা একক আসন দিয়েই মিনেসোটা আইনসভা নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়ায় মি. ওয়ালজের দ্বিতীয় দফার কার্যকাল ব্যস্ততার সঙ্গে কেটেছে।

গর্ভপাতের অধিকার নিশ্চিত করে তোলা, বেতনভুক্ত পরিবার এবং অসুস্থতার ছুটি কার্যকর, বন্দুক আইন শক্তিশালী, সর্বজনীন বিনামূল্যে স্কুল খাবারের জন্য অর্থায়ন এবং সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনে বিনিয়োগের মতো একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তার কার্যকালে।

তার কার্যকলাপ সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বাড়াক ওবামা লিখেছিলেন, “যদি আপনাদের মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয় যে নির্বাচনের কোনও ফল রয়েছে, তবে মিনেসোটাতে কী ঘটছে তা দেখুন।”

জাতীয় স্তরে টিম ওয়ালজের তেমন পরিচিতি না থাকলেও রিপাবলিকানদের নিশানা করে তার তীক্ষ্ণ মন্তব্যের কারণে ‘রানিং মেট ভেটিং’ পিরিয়ডের সময় দ্রুত নজর কাড়েন তিনি। “উল্টোদিকের মানুষগুলো অদ্ভুত,” তিনি এমএসএনবিসিকে বলেছিলেন। রিপাবলিকান সম্পর্কে তার এই মন্তব্য ব্যাপকভাবে প্রচার পায়।

মিনেসোটার এই গভর্নর বলেছিলেন, “এরা (রিপাবলিকান) বই নিষিদ্ধ করতে চায়। এরা আপনার (ডাক্তারের) পরীক্ষার কক্ষে থাকতে চায়”। তবে (মিনেসোটায়) তার কার্যকালে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপকে রিপাবলিকানরা সাধারণ আমেরিকানদের জন্য খুব ‘উগ্র’ বলে চিহ্নিত করেছেন।

মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের তৃতীয় সর্বোচ্চ পদমর্যাদার রিপাবলিকান টম এমার অভিযোগ তুলেছিলেন “মিনেসোটাকে কমালা হ্যারিসের স্টেট, ক্যালিফোর্নিয়ায় পরিণত করার চেষ্টা করছেন” ওয়ালজ।

রিপাবলিকানরা ওয়ালজের সামরিক রেকর্ড নিয়েও তদন্ত করেছেন। টিম ওয়ালজ অবশ্য দাবি করেছিলেন তার রেকর্ডই ‘সব কথা বলবে’। যদিও একথাও স্বীকার করেছেন যে তিনি মাঝে সাঝে ‘ভুল বলেছেন’।

আমেরিকান লেবার পার্টির নেতাসহ ডেমোক্র্যাটিকদের মিত্ররা বিশ্বাস করেন যে, ওয়ালজ গ্রামীণ ও শ্রমজীবী শ্রেণির ভোটারদের কাছে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী কমালা হ্যারিসের আবেদনকে আরও প্রশস্ত করে তুলতে পারেন।

মার্কিন প্রতিনিধি সভার অ্যাঞ্জি ক্রেইগ তাকে (টিম ওয়ালজকে) ‘যুদ্ধে পরীক্ষিত নেতা’ হিসাবে প্রশংসা করেছেন। তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন হ্যারিসের রানিং মেট হিসাবে টিম ওয়ালজ সেরা সম্ভাব্য সংযোজন। তার কথায় ওয়ালজ “একজন প্রমাণিত বিজেতা। তিনি কঠিন প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও কোনও নির্বাচন হারেননি।”

টিম ওয়ালজ এবং তার স্ত্রী গোয়েনের দু’জন সন্তান রয়েছে। তাদের নাম হোপ এবং গাস। ওয়ালজের পরিবার ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে উপস্থিত ছিল। সেখানে দুই সন্তানকে তার ‘পুরো পৃথিবী’ বলে অভিহিত করেছিলেন এই সাবেক শিক্ষক এবং ফুটবল কোচ।

তার কথা শুনে গাস চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। আবেগপ্রবণ হয়ে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলে ওঠেন, “উনি আমার বাবা।” তার সেই আবেগঘন মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি হয় এবং ভাইরালও।

ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে, ওয়ালজ দম্পতী পিপল ম্যাগাজিনকে তাদের ১৭ বছরের ‘উজ্জ্বল’ ছেলে গাস সম্পর্কে বলেছিলেন।

তারা জানিয়েছিলেন, গাস ওয়ালজের এডিএইচডি (অ্যাটেনসন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার) এবং অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার (উদ্বেগজনিত সমস্যা) রয়েছে। একইসঙ্গে জানিয়েছিলেন এই কন্ডিশন (এডিএইচডি এবং অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার) গাসকে ‘সুপার পাওয়ার’ দিয়েছে।

শিকাগোতে তার বক্তৃতা চলাকালীন, টিম ওয়ালজ অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সন্তান ধারণের ক্ষমতা সংক্রান্ত সমস্যার কথাও উল্লেখ করেন। এই প্রসঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাও বলেন তিনি।

গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে আমেরিকায় যে বিতর্ক চলছে তার মধ্যে আছে আইভিএফ এর মতো বিষয়ও। তার প্রচারাভিযানের সময় এই প্রসঙ্গ বারবার টেনে এনেছেন তিনি।

টিম ওয়ালসের স্ত্রী সম্প্রতি স্পষ্ট ভাবে জানিয়েছিলেন, সন্তান ধারণের জন্য ভিন্ন পদ্ধতির সাহায্য নিয়েছিলেন তারা। রিপাবলিকানরা ওয়ালজের সমালোচনা করে বলে তার (মি. ওয়ালজের) বক্তব্য বিভ্রান্তিকর।

ওয়ালজ এবং কমালা হ্যারিস আগস্ট মাসে সিএনএন-এ প্রথমবার যৌথ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। যেখানে তিনি বলেছিলেন “আমেরিকা কী হয়ে উঠতে পারে সে সম্পর্কে তিনি উৎসাহী।” বিবিসি বাংলা

টিএম

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *