কমলা হ্যারিস নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্প?

কমলা হ্যারিস নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্প?

স্বভাবতই ভোটারদের মনে এই প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে যে ৬০ বছর বয়সী কমলা নাকি ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প-মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে কে বেশি উপযুক্ত।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে। অল্প কিছুদিন বাকি মাত্র। ইতিমধ্যে অনেকগুলো অঙ্গরাজ্যে ভোটাররা আগাম এবং ডাকযোগে ভোট দিয়েছেন। দেড় কোটির বেশি ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। বুথ ফেরত জরিপে উভয় প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া গেছে।

শেষ সময়ে এসে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের মধ্যে লড়াই জমে উঠছে। ঘনঘন পরিবর্তন হচ্ছে জরিপের ফলাফল। মাসখানেক আগেও কমলা হ্যারিস প্রায় প্রতিটি জরিপে ট্রাম্পের তুলনায় ভালো অবস্থানে থাকলেও এই পর্যায়ে এসে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়গুলোয় মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোর ফলাফল মুখ্য হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে এবার যে ৭টি রাজ্যকে দোদুল্যমান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোয় বিশেষ মনোযোগ দিতে হচ্ছে উভয় প্রার্থীকে।

এর বাইরে প্রতিবারের নির্বাচনে কিছু বৈশ্বিক ইস্যু থাকে, যা নির্বাচনের মাঠে প্রভাব ফেলে। এবার এ ধরনের ইস্যুর মধ্যে বিশ্বে চলমান দুটি বড় যুদ্ধ ইউক্রেন-রাশিয়া এবং ইসরায়েল ও হামাস-হিজবুল্লাহর মধ্যকার সংঘাত অন্যতম আলোচিত ইস্যু।

সম্প্রতি দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোয় প্রচারের পাশাপাশি দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে বৈশ্বিক এসব সংঘাত নিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প কমলা হ্যারিসের চেয়ে এগিয়ে আছেন বলে ধারণা করা যাচ্ছে। নির্বাচিত হলে এসব যুদ্ধ নিষ্পত্তির বিষয়ে ট্রাম্পের বক্তব্য ভোটারদের কাছে টানছে।

অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ডেপুটি হওয়ার কারণে বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা কমলা হ্যারিসকে বহন করতে হচ্ছে। সেদিক দিয়ে বিগত নির্বাচনে জো বাইডেন মার্কিন মুসলিম ভোটারদের যেভাবে নিজের পক্ষে টানতে পেরেছিলেন, এবার কমলার জন্য তা খুব কঠিন হবে বলে সাম্প্রতিক জরিপগুলোয় উঠে এসেছে।

তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকাকে নেতিবাচক হিসেবে দেখা হলেও মার্কিন ভোটারদের মধ্যে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দিনশেষে এটা যে খুব একটা বড় বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

বাইডেন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমা শক্তিগুলো একত্র করতে সক্ষম হয়েছেন এবং রুশ আধিপত্যকে খর্ব করতে এখন পর্যন্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কমলা হ্যারিস তার প্রশাসনে কাজ করছেন। সেই সূত্রে বলা যায় নির্বাচিত হলে তিনি বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতাকেই অক্ষুণ্ন রাখবেন।

এক্ষেত্রে অবশ্য বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা নিয়ে মার্কিন সমাজে একধরনের অসন্তোষ বিরাজ করলেও ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার থেকে যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো এক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর পরিবর্তে তার দিক থেকে সুস্পষ্টভাবে কোনো বক্তব্য নেই। যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে আগামী দিনে যে প্রশাসনই আসুক না কেন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। 

স্বভাবতই ভোটারদের মনে এই প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে যে ৬০ বছর বয়সী কমলা নাকি ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প-মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে কে বেশি উপযুক্ত।

এবারের নির্বাচনে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর সেটি হচ্ছে যখন নির্ধারিত ছিল বাইডেন-ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন, তখন বাইডেনের বয়স এবং শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য নিয়ে যেধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল, বর্তমানে এটা মোকাবিলা করতে হচ্ছে ট্রাম্পকে।

কমলা হ্যারিস ইতিমধ্যে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করলেও তার বিভিন্ন বক্তব্যে তিনি ট্রাম্পকে উদ্দেশ্য করে একই কাজটি করতে বললেও ট্রাম্প শিবির থেকে এর জবাব পাওয়া যায়নি। স্বভাবতই ভোটারদের মনে এই প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে যে ৬০ বছর বয়সী কমলা নাকি ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প-মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে কে বেশি উপযুক্ত।

নির্বাচন যখন কাছাকাছি হয়ে আসছে, এই সময়ে দুই প্রার্থীর প্রচারণাতেই মুসলিম, ল্যাটিন, আদিবাসী এবং অভিবাসী ইস্যু প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সেই পুরোনো এবং পরিচিত স্লোগান ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ নিয়ে অভিবাসনবিরোধী প্রচারণাকে তুঙ্গে রেখেছেন।

কমলা হ্যারিস সে তুলনায় অনেকটাই উদার মনোভাব প্রদর্শন করছেন। তবে একজন আফ্রো-এশিয়ান আমেরিকান হিসেবে সংখ্যালঘুদের তিনি ব্যাপকভাবে কাছে টানতে পারবেন এটা অনেকটাই নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সেই পুরোনো এবং পরিচিত স্লোগান ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ নিয়ে অভিবাসনবিরোধী প্রচারণাকে তুঙ্গে রেখেছেন। কমলা হ্যারিস সে তুলনায় অনেকটাই উদার মনোভাব প্রদর্শন করছেন।

মার্কিন নির্বাচন নিয়ে জরিপের বিষয়টি খুব আগ্রহ জাগানিয়া। যদিও নিকট অতীতের অভিজ্ঞতায় জরিপের ফলাফল সবসময় সঠিক তথ্য দেয় না এমন নজিরও দেখা গেছে, বিশেষ করে ২০১৬ সালের নির্বাচনের বিষয়টি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, যেখানে বেশিরভাগ জরিপেই হিলারিকে এগিয়ে রাখা হলেও এবং মোট প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধানে হিলারি ক্লিনটন এগিয়ে থাকলেও নাটকীয়ভাবে ইলেক্টোরাল কলেজের হিসাব নিকাশের জেরে তিনি ট্রাম্পের কাছে পরাজিত হন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বাইডেনের স্থলে কমলা হ্যারিস প্রার্থী হিসেবে মাঠে নামার পর থেকেই জরিপগুলোয় কমলা স্পষ্টভাবে এগিয়ে থাকলেও উপরে উল্লিখিত সমীকরণের জেরে নির্বাচনটি প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। একমাস আগেও বিভিন্ন জরিপে দোদুল্যমান সাতটি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ৫টিতেই ট্রাম্প এগিয়ে থাকলেও সম্প্রতি উভয়েই সমান অবস্থানে রয়েছেন বলে ধারণা পাওয়া গেছে। এর কারণ হিসেবে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে উভয়েই এই মুহূর্তে এই অঙ্গরাজ্যগুলোর দিকে অধিক মনোযোগ দিয়েছেন।

ওয়াশিংটন পোস্টের সর্বশেষ জরিপে নিবন্ধিত ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্প ও কমলা উভয়েই ৪৭ শতাংশ ভোটারের সমর্থন পেয়েছেন, অপরদিকে সম্ভাব্য ভোটারদের মধ্যে ৪৯ শতাংশ ভোটার কমলাকে এবং ৪৮ শতাংশ ভোটার ট্রাম্পকে সমর্থন দিতে পারেন বলে ধারণা পাওয়া গেছে।

বাস্তবিক অর্থে মার্কিন প্রশাসনে ভাইস প্রেসিডেন্টের ভূমিকা খুব একটা আলোচিত না হলেও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে এই কারণে যে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর যে সীমাবদ্ধতাগুলো ভোটের ক্ষেত্রে এককভাবে সমাধান করা সম্ভব নয় সেগুলো অতিক্রম করতে এমন কাউকে বাছাই করা, যার মধ্য দিয়ে একটি জুটি তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেন। এক্ষেত্রে ট্রাম্প এবং কমলা দু’জনই তাদের রানিংমেট বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন বলা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প এবং বাইডেন—এই দুজনকেই দেখেছেন। সেক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে ভোটারদের নতুন করে ভাবনার কোনো অবকাশ নেই। ২০১৬ সালের নির্বাচনের প্রচারাভিযান এবং পরবর্তীতে নির্বাচিত হয়ে একদিকে অভ্যন্তরীণভাবে মূলধারার আমেরিকান এবং অভিবাসীদের মধ্যে বিভাজন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্পষ্টতই রাশিয়ার প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন, চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা এবং এবং ইউরোপের সাথে দূরত্ব সৃষ্টির মত কারণে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন।

তার চার বছরের দায়িত্ব পালনকালে ৩ বার দেশের পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী পরিবর্তন করেছেন। সবচেয়ে ঘৃণ্য যে কাজটি করেছেন, তা হলো ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে তার সমর্থকদের দিয়ে ওয়াশিংটনের ক্যাপিটাল হিলে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন। সবকিছুই এই নির্বাচনে প্রভাব পড়বে। এই বিষয়গুলো প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে জো বাইডেন তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন, যা ট্রাম্পকে স্পষ্টতই এগিয়ে রেখেছিল।

তবে ট্রাম্পের তুলনায় কমলা হ্যারিসের তুলনামূলক গ্রহণযোগ্যতা এবং তারুণ্য, উন্মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি এবং অশ্বেতাঙ্গ হিসেবে কৃষ্ণাঙ্গ এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সমর্থন লাভের সম্ভাবনা ভোটের সার্বিক অবস্থাকে পাল্টে দিতে পারে।

ড. ফরিদুল আলম ।। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *