ইসরায়েলের হামলার পরও অটুট হিজবুল্লাহর সুড়ঙ্গ-অস্ত্রাগার

ইসরায়েলের হামলার পরও অটুট হিজবুল্লাহর সুড়ঙ্গ-অস্ত্রাগার

নমনীয় কাঠামোর চেইন অব কমান্ড, বিস্তৃত সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক ও গত এক বছরে ক্ষেপণাস্ত্র এবং অন্যান্য অস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার গড়ে তোলার কারণে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের হামলা সামলে উঠতে পারছে। ইরান-সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত তিনটি সূত্রের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানিয়েছে।

নমনীয় কাঠামোর চেইন অব কমান্ড, বিস্তৃত সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক ও গত এক বছরে ক্ষেপণাস্ত্র এবং অন্যান্য অস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার গড়ে তোলার কারণে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের হামলা সামলে উঠতে পারছে। ইরান-সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত তিনটি সূত্রের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানিয়েছে।

গত সপ্তাহে ইসরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহর জ্যেষ্ঠ কমান্ডারদের টার্গেট করা হয় এবং পেজার ও ওয়াকি-টকি বিস্ফোরণেও অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। গত শুক্রবার ইসরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহর অভিজাত রাদওয়ান বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ও নেতৃত্ব দেওয়া ইব্রাহিম আকিল নিহত হন। সোমবার বৈরুতে হামলায় ৫৬০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৫০ জন শিশু ও ৯৪ জন নারী ছিল বলে জানিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

রোববার ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর প্রধান হার্জি হালেভি দাবি করেছেন, আকিলের মৃত্যু হিজবুল্লাহকে নাড়া দিয়েছে। তার দাবি, হামলায় হিজবুল্লাহর হাজার হাজার রকেট ও শেল ধ্বংস হয়েছে।

তবে হিজবুল্লাহর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত দুটি সূত্র বলেছে, গোষ্ঠীটি দ্রুতই হামলায় নিহত আকিল এবং অন্যান্য জ্যেষ্ঠ কমান্ডারদের দায়িত্ব প্রতিস্থাপন করেছে। হিজবুল্লাহ নেতা সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ ১ আগস্টের একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, যখনই কোনও নেতাকে হত্যা করা হয়, তখন দলটি দ্রুত তার শূন্যস্থান পূরণ করে।

হিজবুল্লাহর একজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, যোগাযোগ ডিভাইস বিস্ফোরণে দেড় হাজার যোদ্ধা আহত হয়েছেন। তাদের অনেকেই অন্ধ হয়ে গেছেন বা তাদের হাত উড়ে গেছে।

এটি একটি বড় ধাক্কা হলেও হিজবুল্লাহর শক্তির একটি ভগ্নাংশই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুক্রবার মার্কিন কংগ্রেসের একটি প্রতিবেদনে গোষ্ঠীটির যোদ্ধার সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০ হাজারের মতো বলে উল্লেখ করা হলেও নাসরুল্লাহর দাবি, দলটির এক লাখ যোদ্ধা রয়েছেন।

গত বছরের অক্টোবর থেকে মিত্র হামাসের সমর্থনে ইসরায়েলে নানা সময় ছোট আকারে হামলা করেছে হিজবুল্লাহ। তিনটি সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, তখন থেকে দক্ষিণের ফ্রন্টলাইন এলাকায় হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের পুনরায় মোতায়েন করেছে। এসব যোদ্ধার অনেকে সিরিয়া থেকেও এসেছেন।

সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়াতে চাইলেও, পরবর্তীতে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের আভাস পেয়ে হিজবুল্লাহ লেবাননে দ্রুতগতিতে অনেক রকেট জড়ো করেছে বলেও জানিয়েছে রয়টার্সের সূত্রগুলো।

হিজবুল্লাহর প্রধান সমর্থক এবং অস্ত্র সরবরাহকারী ইরান। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিভিন্ন দেশে ইরানের মিত্র বাহিনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দল এই হিজবুল্লাহ। তাদের অনেক অস্ত্রই ইরানি, রাশিয়ান বা চীনা মডেলের।

বিষয়টির সংবেদনশীলতার কারণে রয়টার্সের সূত্রগুলো নাম প্রকাশে রাজি হয়নি। নতুন আসা অস্ত্রগুলো সম্পর্কে বা কোথা থেকে কেনা হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানায়নি সূত্রগুলো।

হিজবুল্লাহর মিডিয়া অফিসও এই প্রতিবেদনের বিষয়ে মন্তব্য করতে রয়টার্সের অনুরোধের জবাব দেয়নি। কিংস কলেজ লন্ডনের স্কুল অব সিকিউরিটি স্টাডিজের একজন জ্যেষ্ঠ লেকচারার আন্দ্রেয়াস ক্রিগ বলেছেন, গত সপ্তাহের হামলায় হিজবুল্লাহর কার্যক্রম ব্যাহত হলেও নেটওয়ার্কভিত্তিক সাংগঠনিক কাঠামো এটিকে একটি অত্যন্ত স্থিতিশীল শক্তিতে পরিণত হতে সাহায্য করেছে।

তিনি বলেন, ‘‘সংখ্যা এবং প্রযুক্তি বিবেচনায় নয়, বরং স্থিতিশীলতা বিবেচনায় ইসরায়েলের যুদ্ধক্ষেত্রে তার সবচেয়ে শক্তিশালী শত্রুর মুখোমুখি হয়েছে।’’

এই সপ্তাহে সংঘর্ষ বেড়েছে। ২৪ সেপ্টেম্বর ইসরায়েল হিজবুল্লাহর আরেক শীর্ষ কমান্ডার ইব্রাহিম কুবাইসিকে হত্যা করেছে। তারপরও হিজবুল্লাহ অপারেশন চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা দেখিয়েছে। এত হামলা সত্ত্বেও ইসরায়েলের গভীরে শত শত রকেট নিক্ষেপ করেছে।

বুধবার হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে তেল আবিবের কাছে একটি ইসরায়েলি গোয়েন্দা ঘাঁটি লক্ষ্য করে তারা হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলেছে, তেল আবিবে একটি ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপ করা ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বাধা দেওয়ায় সতর্কীকরণ সাইরেন বেজে উঠেছিল।

হিজবুল্লাহর সবচেয়ে শক্তিশালী রকেটগুলোর মধ্যে কোনটি উৎক্ষেপণ করা হয়েছে তা এখনও জানায়নি গোষ্ঠীটি। হিজবুল্লাহর কাছে ইরান নির্মিত ফাতেহ-১১০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যার রেঞ্জ ২৫০-৩০০ কিলোমিটার। ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ২০১৮ সালের একটি গবেষণাপত্র অনুযায়ী, হিজবুল্লাহর ফাতেহ-১১০ ক্ষেপণাস্ত্রের ৪৫০-৫০০ কেজি ওয়ারহেড বহনের সক্ষমতা রয়েছে।

এক জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা দাবি করেছেন, পেজার এবং রেডিও বিস্ফোরিত হওয়ার পরও হিজবুল্লাহর রকেট হামলা চালাতে সক্ষম হওয়াটাই প্রমাণ করে যে গ্রুপটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মুখেও চেইন অব কমান্ড বজায় রেখে কাজ করতে পারছে।

ফিক্সড-লাইন টেলিফোন নেটওয়ার্ক এবং অন্যান্য ডিভাইস ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রেখে চলেছে। অনেক যোদ্ধা পেজারের পুরোনো মডেল বহন করছিলেন, ফলে গত সপ্তাহের আক্রমণে তাদেরও কোনও ক্ষতি হয়নি।

রয়টার্স এই তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি বলে জানিয়েছে। বিস্ফোরিত পেজারগুলোর বেশিরভাগ আঘাত করেছে বৈরুতে; যা মূল ফ্রন্টলাইন থেকে অনেক দূরে। ইসরায়েলের হামলায় বেশ কয়েকজন কমান্ডার নিহত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় হিজবুল্লাহ ফেব্রুয়ারিতে যোদ্ধাদের সেলফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পেজার ব্যবহার বাড়িয়েছিল।

রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চেইন অব কমান্ড ভেঙে গেলেও সীমান্তের কাছে কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত ছোট, স্বাধীন গ্রুপে কাজ করার জন্য ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারা স্বাধীনভাবেই দীর্ঘ সময়ের জন্য ইসরায়েলি বাহিনীর সাথে লড়াই করতে সক্ষম বলেও জানিয়েছে সূত্রটি।

২০০৬ সালে হিজবুল্লাহ এবং ইসরায়েলের মধ্যে সবশেষ যুদ্ধের সময় এমন ঘটনা ঘটেছিল। ইসরায়েলের হামলার মুখেও কয়েক সপ্তাহ ধরে গোষ্ঠীটির যোদ্ধারা কয়েক সপ্তাহ ধরে সীমান্তের গ্রামগুলোতে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল।

দু’টি সূত্র বলেছে, হিজবুল্লাহ বেশ ভালোভাবেই তাদের অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে। রোববার দক্ষিণ লেবাননের এমন এলাকা থেকে রকেট ছোড়া হয়েছিল যেখানে তার কিছুক্ষণ আগেই ইসরায়েল হামলা চালিয়েছিল।

হিজবুল্লাহর একটি ভূগর্ভস্থ অস্ত্রাগার রয়েছে বলে মনে করা হয় এবং গত মাসে প্রকাশিত এক ফুটেজে দেখা যায়, হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা রকেট লঞ্চার নিয়ে টানেলের মধ্য দিয়ে ট্রাক চালাচ্ছেন। রোববার ছোড়া রকেটগুলো ভূগর্ভ থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল কি না সেটি অবশ্য রয়টার্সের সূত্র জানাতে পারেনি।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেছেন, সোমবারের হামলায় হিজবুল্লাহর হাজার হাজার রকেট ও যুদ্ধাস্ত্র ধ্বংস হয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, ১০০ কেজি বিস্ফোরক বহন করতে সক্ষম ওয়ারহেডসহ রকেট, স্বল্প পাল্লার রকেট এবং বিস্ফোরক ইউএভি সোমবারের আঘাতে ধ্বংস হয়েছে।

তবে ইসরায়েলের এই দাবির সত্যতাও রয়টার্স স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি। মার্কিন কংগ্রেসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, হিজবুল্লাহর অস্ত্রাগারে প্রায় দেড় লাখ রকেট রয়েছে। সবচেয়ে শক্তিশালী এবং দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মাটির নিচেই রাখা হয়েছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

এসএস

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *