আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু, শয্যার তুলনায় দ্বিগুণ রোগী

আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু, শয্যার তুলনায় দ্বিগুণ রোগী

দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এর ওপর দেশে এখন এডিস মশার প্রজননের মূল মৌসুম হওয়ায় মানুষের মধ্যেও তৈরি হচ্ছে আতঙ্ক, উদ্বেগ ও নানা শঙ্কা। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির কথা বলা হচ্ছে। তবে, বাস্তব চিত্র বলছে, রোগীর ঢেউ আসার আগেই হাসপাতালগুলোতে পা ফেলার ঠাঁই নেই। বাধ্য হয়ে রোগীরা তাই চিকিৎসা নিচ্ছেন হাসপাতালের মেঝে-বারান্দায় থেকে। আবার অতিরিক্ত রোগীর চাপে যেন দম ফেলারও ফুরসত নেই চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের।

দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এর ওপর দেশে এখন এডিস মশার প্রজননের মূল মৌসুম হওয়ায় মানুষের মধ্যেও তৈরি হচ্ছে আতঙ্ক, উদ্বেগ ও নানা শঙ্কা। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির কথা বলা হচ্ছে। তবে, বাস্তব চিত্র বলছে, রোগীর ঢেউ আসার আগেই হাসপাতালগুলোতে পা ফেলার ঠাঁই নেই। বাধ্য হয়ে রোগীরা তাই চিকিৎসা নিচ্ছেন হাসপাতালের মেঝে-বারান্দায় থেকে। আবার অতিরিক্ত রোগীর চাপে যেন দম ফেলারও ফুরসত নেই চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের।

মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে এ চিত্র দেখা গেছে।

শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) রাত ৪টায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এসে ভর্তি হন কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা আবুল হাসান। তিন দিনে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ায় বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। 

ঢাকা পোস্টকে আবুল হাসান বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, এখন অবস্থা কিছুটা ভালো। কিন্তু ভর্তি হওয়ার সময় যে অবস্থা হয়েছিল, মনে হচ্ছিল আর বাঁচব না। চিকিৎসক-নার্সদের আন্তরিক সেবা আমাকে দ্রুত সুস্থ হতে সহযোগিতা করেছে।

তিনি বলেন, যাত্রাবাড়ী এলাকায় সবসময়ই ডেঙ্গু সংক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। এবারও যাত্রাবাড়ী-কোনাপাড়ায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনেকটাই বেশি। কিন্তু সেই তুলনায় বাড়িওয়ালাদেরও তেমন তৎপরতা নেই, সরকারিভাবেও দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। অধিকাংশ নতুন বাসাবাড়ির ছাদগুলোতে দিনের পর দিন পানি জমিয়ে রাখা হয়েছে। কেউ গিয়ে কোনোদিন স্প্রে বা কোনো ওষুধও ছিটায় না। যে কারণে আশঙ্কা করছি, এবারও ওই এলাকায় ভয়াবহ অবস্থা হবে।

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা আরেক রোগীর স্বজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার রোগীর শুরুতে টানা ৩/৪ দিন জ্বর ছিল। এরপর ইবনে সিনা মেডিকেলে পরীক্ষা করার পর সেখানে ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। তখন তার প্লাটিলেট ছিল এক লাখ ২২ হাজার। তারপর আরও দুই দিন বাসায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। পরে হঠাৎ করেই জ্বরের সঙ্গে বমি-পাতলা পায়খানা শুরু হয়। একপর্যায়ে শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাওয়ায় দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসি। এখন আমার রোগী আগের তুলনায় অনেকটাই ভালো।

তিনি বলেন, নতুন করে আবার ডাক্তার পরীক্ষা দিয়েছে, পরীক্ষা করে দেখি কী অবস্থা। যদি দেখি যে অবস্থা ভালো, তাহলে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে যাব।

হাসপাতালের চিকিৎসাসেবায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর এখন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাসেবা খুবই ভালো। আগের মতো এত ঝামেলা দেখছি না। ডাক্তারও নিয়মিত আসছে, নার্সরাও এসে খোঁজখবর নিয়ে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে এখন চিকিৎসাসেবা মোটামুটি ভালোই।

দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় গত জুলাই মাসে ২০ শয্যার ডেডিকেডেট ডেঙ্গু ইউনিট গঠন করে ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালটির নতুন ভবনের চার তলায় অবস্থিত ডেঙ্গু ওয়ার্ডে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে ঢোকার রাস্তা থেকে শুরু করে ওয়ার্ডের ভেতর পর্যন্ত রোগীতে ভরপুর। 

জানা গেছে, ওয়ার্ডটিতে শুধুমাত্র পুরুষ রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে, যাদের অধিকাংশই হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া, ডেঙ্গু আক্রান্ত নারী রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে একই ভবনের ৮ তলায় মেডিসিন বিভাগে। সেখানে অন্যান্য রোগীদেরও চিকিৎসা চলছে।

ডেঙ্গু রোগীর চাপ প্রসঙ্গে ঢামেক ডেঙ্গু ওয়ার্ডের নার্সিং ইনচার্জ ও সিনিয়র স্টাফ নার্স নাজনীন নাহার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এই ডেঙ্গু ওয়ার্ডে সর্বমোট সিট আছে ২০টি, এর মধ্যে সোমবার দুপুর রোগী ভর্তি আছে ৫৭ জন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর আমাদের ওয়ার্ডে নতুন রোগী ভর্তি হয় সাতজন, এতে করে ওইদিন ২০ সিটের বিপরীতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ৭০ জন। এরপর গতকাল সোমবার আরও ১০ জন নতুন রোগী আসে এবং কিছু রোগী ছাড়া পেয়ে বাসায় চলে যায়। যার ফলে ওইদিন এই ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ জনে। এদিকে, আজ মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত নতুন রোগী ভর্তি হয় সাতজন।

তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেলে গত ১০ সেপ্টেম্বরের পর থেকে রোগী বাড়তে শুরু করে। এর আগে, প্রতিনিয়ত আমাদের ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি ছিল ৩০ থেকে ৩৫ জনের মতো। কিন্তু এখন নিয়মিত ৬০ থেকে ৭০ পর্যন্ত থাকছে।

ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গুতে এ বছর কতজনের মৃত্যু হয়েছে? এ প্রসঙ্গে নাজনীন নাহার বলেন, ঢাকা মেডিকেলে গত জুলাই মাস থেকে ডেঙ্গু ওয়ার্ড চালু হয়। গত ১১ আগস্ট একজন রোগী মারা যায়। এরপর আর কারো মৃত্যু হয়নি। সবমিলিয়ে মৃত্যুর হার খুবই কম।

হাসপাতালটির ৮তলায় মেডিসিন ওয়ার্ডে সরেজমিনে গিয়ে রোগীদের আরও ভয়াবহ অবস্থায় দেখা যায়। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেডিসিন বিভাগের নারী ওয়ার্ডে যে পরিমাণ রোগী বেডে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তার চেয়ে তিনগুণ রোগী শুয়ে আছেন মেঝে, সিঁড়ি সংলগ্ন ফাঁকা জায়গা ও বারান্দায়। 

ডেঙ্গু রোগীদের তথ্য জানতে একাধিক নার্স ও চিকিৎসকের সঙ্গে কথার বলতে চাইলেও রোগীদের চিকিৎসাসেবায় ব্যস্ত থাকায় তাদের সঙ্গে কথা বলাই সম্ভব হচ্ছিল না।

দেখা যায়, চিকিৎসক-নার্সরা ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। তাদের কথা বলারও সময় নেই। 

তারা বলেন, আমাদের বিলম্বের কারণে একজন রোগীর মৃত্যু হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে চেষ্টা করে যাব যেন কোনো ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাসেবা যেন ব্যাহত না হয়।

এদিকে, দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় মেডিসিন বিভাগের কর্তব্যরত ট্রেইনি চিকিৎসক অমিত ঘোষের সঙ্গে। এ সময় তিনি বলেন, মেডিসিন বিভাগে সব ধরনের রোগীই ভর্তি আছে। এর মধ্যে কিছু ডেঙ্গু রোগীকেও আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি। মূলত ডেঙ্গু রোগীদের জন্য চার তলায় ডেঙ্গু ওয়ার্ড চালু হয়েছে, কিন্তু সেখানে রোগীদের জায়গা দেওয়া যাচ্ছিল না বলেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নারীদের এই ওয়ার্ডে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে।

তিনি আরও বলেন, গত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ ডেঙ্গু রোগী তুলনামূলক একটু বেশি আসছে। আমাদের ওয়ার্ডে প্রতিদিন নতুন ১০ থেকে ১৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে। যারাই চিকিৎসা নিতে আসছে, অধিকাংশরই ১০৩ ডিগ্রি জ্বর, বমি-পাতলা পায়খানা রয়েছে।

আশঙ্কা জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, অন্যান্য সময়ের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি মনে হচ্ছে। হয়তো বৃষ্টি-বাদল বেশি হচ্ছে, তাই রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। সামনের দিনগুলোতে যে কী অবস্থা হয়, সেটিই ভাবছি। মনে হচ্ছে গত বছরের তুলনায় অবস্থা আরও খারাপ হবে।

এ বছর ডেঙ্গু রোগীদের উপসর্গ কেমন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অন্যান্য সময়ের মতোই এবারের উপসর্গ হলো, প্রচুর জ্বর, টানা ৩/৪ দিন থাকছে…। এরপরই ডেঞ্জার পিরিয়ডে চলে যায়। তখন শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়, ইন্টার্নাল ব্রিডিং শুরু হয়, নারীদের ক্ষেত্রে মাসিকের রাস্তা দিয়ে ব্লিডিং হয়। সেইসঙ্গে বমি, পেট ব্যথা, পাতলা পায়খানা দেখা যায়। এসব রোগীদের নিয়ে পরীক্ষা করলেই ডেঙ্গু পজিটিভ আসছে। এমনকি ওই অবস্থায় অনেকের প্লাটিলেট ১০/২০ হাজারেও নেমে যায়।

অমিত ঘোষ বলেন, ওইসব অবস্থায় আমরা রোগীর প্রেশারটাকে (বিপি) বেশি গুরুত্ব দেই। প্রেশার যদি ৯০/৫০ এর নিচে চলে যায়, তখনই স্যালাইন দেওয়া শুরু করি। যদি বিপি না বাড়তে থাকে, তাহলে স্যালাইনের ডোজ বাড়ানো হয়। একপর্যায়ে স্যালাইন ২/৩ লিটারে চলে গেলেও অনেকেরই বিপি বাড়ে না। তখন তাদের জন্য অন্য ট্রিটমেন্ট ভাবতে হয়। ওই অবস্থায় রোগীদের ঝুঁকিটা বেশি থাকলেও ভালো ট্রিটমেন্ট পেলে প্রায় সবাই সুস্থ হয়ে যায়।

ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ ও চিকিৎসাসেবা প্রসঙ্গে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি আসলে গত বেশ কিছুদিন দেশের বাইরে ছিলাম। এসে যেমনটা তথ্য পেলাম, গত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ ডেঙ্গু রোগী একটু বেশি আসছে। আজকের দিনের সর্বশেষ তথ্য হলো, বর্তমানে ১২০ জনের মতো ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি আছে। তাদের মধ্যে পুরুষের তুলনায় অধিকাংশই নারী। এর মধ্যে প্রতিদিন নতুন করে আরও ২৫/৩০ জনের মতো রোগী ভর্তি হচ্ছে।

তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বরাদ্দকৃত যে সিট সংখ্যা আছে, তা ইতোমধ্যে রোগীতে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। শুধু ডেঙ্গু নয়, আমাদের হাসপাতালে সব ধরনের রোগীই সবসময় শয্যার তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ পর্যন্ত থাকে। এর মধ্যেই আমরা আমাদের সীমিত জনবল দিয়ে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে ১৯ হাজার ৩৪২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বছরের এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ১০৮ জনের।

টিআই/কেএ

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *