‘আমি যদি মারা যাই, তোমাদেরকে সবাই বলবে শহীদের স্ত্রী-সন্তান’

‘আমি যদি মারা যাই, তোমাদেরকে সবাই বলবে শহীদের স্ত্রী-সন্তান’

‘আমি আন্দোলনে গেলে শহীদ হবো। আমার সন্তানকে আমি আন্দোলনে নিয়ে যাবো। আমার সন্তানকে সামনে রাখবো, আমি পেছনে থাকবো। আমি যদি মারা যাই, তখন তোমাদেরকে সবাই শহীদের স্ত্রী-সন্তান বলে ডাকবে। আর আমার সন্তান মারা গেলে, তখন সবাই আমাদেরকে শহীদের বাবা-মা বলে ডাকবে।’

‘আমি আন্দোলনে গেলে শহীদ হবো। আমার সন্তানকে আমি আন্দোলনে নিয়ে যাবো। আমার সন্তানকে সামনে রাখবো, আমি পেছনে থাকবো। আমি যদি মারা যাই, তখন তোমাদেরকে সবাই শহীদের স্ত্রী-সন্তান বলে ডাকবে। আর আমার সন্তান মারা গেলে, তখন সবাই আমাদেরকে শহীদের বাবা-মা বলে ডাকবে।’

আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে মাজহারুল ইসলাম মাসরুর ওরপে আলী আজগর (২৯) তার সহধর্মিনী বিবি সালমাকে এভাবেই বলতেন।

মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে নবাগত শিশুকে কোলে নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিবি সালমা প্রতিবেদককে এসব কথা জানান।

এদিকে মাসরুর যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তখন তার স্ত্রী সালমা আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তার মৃত্যুর ঠিক দেড় মাস পর গত রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) তার স্ত্রীর কোলজুড়ে ফুটফুটে ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। শিশুটির এখনো কোনো নাম রাখা হয়নি। বাবাহীন ছেলেটির ভবিষ্যৎ জীবন মেঘে ঢাকা।

এ ছাড়াও তার সাড়ে তিন বছর বয়সী নাফিজা আক্তার নামে এক কন্যা সন্তান রয়েছে। যে প্রতিদিন তার বাবার সঙ্গে মোবাইলফোনে কথা বলতো। গত দেড় মাস ধরে বাবার সঙ্গে তার নাফিজার কথা হয় না। বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই তার দুই চোখ পানিতে ভিজে যায়। ছোট্ট নাফিজা বাবা হারার বেদনা কি? হয়তো তাও বুঝতে পারছে না। তবে বাড়িতে সবার উপস্থিতিতে তার দুই চোখ শুধু তার বাবাকে খোঁজে। হয়তো তার ভাবনা—তার বাবা কাজ থেকে বাড়িতে ফিরবে। তবে কথা বলতে না পারায় প্রায়ই বাবার জন্য নাফিজা কান্না করে বলে জানিয়েছেন তার মা সালমা। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সালমা এখন তার বাবার বাড়ি চরফলকন ইউনিয়নের ফলকন গ্রামে আছেন।

বিবি সালমা বলেন, মাসরুর আমাকে বলেছিলেন, আন্দোলনে তার সঙ্গী হতে। আমাকে আন্দোলনে যেতে বুঝিয়ে গেছে। হাজিরহাট মিছিল হবে, আমাকে যেতে বলেছে। তবে সঙ্গে আমার সন্তানকে নেওয়ার জন্যও বলেছিল। এখন সবাই আছে, শুধু মাসরুর নেই। কিন্তু সামনের দিকে আমাদের পরিস্থিতি পুরো অন্ধকার। এখন কোনো রকমভাবে আছি। আল্লাহপাক জানেন, কি অবস্থায় আমি ছেলে-মেয়েকে নিয়ে থাকবো।

ঘটনার দিনই সালমার সঙ্গে মাসরুরের কথা হয়। তখন মাসরুর দোকানে ছিলেন। সালমাকে তিনি জানিয়েছিলেন, তিনি আন্দোলনে যাবেন। সালমা খাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে আন্দোলনে যাবো, তারপর খাওয়া-ধাওয়া করবো। পরে সালমা তার ভাইয়ের কাছে জানতে পারেন মাসরুর মারা গেছেন।

মাজহারুল ইসলাম মাসরুরের বৃদ্ধ বাবা আবদুল খালেক। ছবি : ফাইল ফটো

 

মাসরুর গত ৫ আগস্ট গাজীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের সঙ্গে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তিনি লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার পাটওয়ারীর হাট ইউনিয়নের চরবড়ালিয়া গ্রামের এলাকার বৃদ্ধ আবদুল খালেকের ছেলে। জীবিকার তাগিদে তিনি মাদরাসায় শিক্ষকতা, পোলট্রি খামার ও ইলেকট্রিক সরঞ্জামের ব্যবসাও করেছেন। তবে কোথাও স্থায়ী হতে পারেননি। সবশেষ প্রায় সাত মাস আগে গাজীপুরে তার শ্বশুর মো. মোস্তফার কাছে যান ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে। সেখানে ব্যবসায় ভালোই করছিলেন। কিন্তু ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতি করায় স্বৈরাচারী সরকার পতনের আন্দোলনে সবসময় সক্রিয় ছিলেন তিনি। মাসরুল ইসলামী আন্দোলনের পাটওয়ারীর হাট ইউনিয়ন শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।

মাসরুরের শিক্ষকতা জীবনের সহকর্মী সিরাজুল ইসলাম মেহরাজ বলেন, ঘটনার দিন মাসরুর তার এক বন্ধুকে বলেছিল, গুলিবিদ্ধ কেউ একজনকে তিনি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। গুলিবিদ্ধ সেই লোকটি তার বন্ধু ছিল। এরপর আর তার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। পরে গাজীপুরের শহীদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তার মরদেহ পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে—গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনদের দুশ্চিন্তায় না ফেলতে সেদিন তিনি ঘটনাটি লুকিয়েছিলেন।

মাসরুরের ছোট ভাই হুমায়ুন কবির বলেন, আমার ভাই জীবনে অনেক কষ্ট করেছে। নিজে পড়ালেখা করেছে। পাশাপাশি আমাদের জন্য কষ্ট করেছেন। তিনি একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। পরে ওই মাদরাসার দায়িত্ব আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি গাজীপুরে ব্যবসা করতে যান। আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। সবাই বলেছে, তার শরীরের একটা গুলি লেগেছে। তবে শেষ গোসলের পরে তার পেটে ও পিঠে দুটি গুলির চিহ্ন দেখা গেছে।

মাসরুরের চাচা শ্বশুর ওমর ফারুক বলেন, মাসরুর আর্থিকভাবে তেমন একটা স্বাবলম্বী ছিলেন না। গাজীপুর যাওয়ার আগে তার অন্ত্বসত্ত্বা স্ত্রীকে শ্বশুর বাড়িতে রেখে যান। এখন তো কোনোভাবে দিন কাটছে তাদের। সামনে তারা কীভাবে চলবে, যতই সময় যাচ্ছে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। সরকার যদি পরিবারটির দিকে মুখ তুলে তাকায়, হয়তো মাসরুরের স্ত্রী ছেলে-মেয়েকে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারবে।

মাসরুরের কথা জিজ্ঞেস করতেই তার বৃদ্ধ বাবা আবদুল খালেকের চোখ থেকে পানি ঝরতে শুরু করে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, মাসরুর সবার চেয়ে ভালো ছিল। পরিবারের সবার দেখভাল করতো। দ্বীনের কাজে গিয়ে সে মারা গেছে। আমি শুকরিয়া আদায় করছি। মৃত্যু তো ঠেকানো যায় না, বাড়িতে থাকলেও মারা যেত। তার ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীর বিষয়ে পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, মাসরুরের মৃত্যুতে লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের দক্ষিণ তেমুহনী এলাকাকে ‘শহীদ মাসরুর’ চত্বর ঘোষণা করে লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কের ওপর লিখে রাখা হয়েছে। সড়কের পূর্বপাশে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও মাসরুর চত্বর ঘোষিত একটি বড় ব্যানার সাঁটানো হয়।

হাসান মাহমুদ শাকিল/এএমকে

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *