কলেজপড়ুয়া ছেলেকে হারিয়ে কান্না আর আহাজারি যেন থামছেই না গর্ভধারিণী মায়ের। ঘটনার ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো ছেলের মরদেহ খুঁজে পায়নি বাবা ও স্বজনরা। একমাত্র ছেলে হৃদয় (২০) গত ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় বলে দাবি পরিবারের।
কলেজপড়ুয়া ছেলেকে হারিয়ে কান্না আর আহাজারি যেন থামছেই না গর্ভধারিণী মায়ের। ঘটনার ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো ছেলের মরদেহ খুঁজে পায়নি বাবা ও স্বজনরা। একমাত্র ছেলে হৃদয় (২০) গত ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় বলে দাবি পরিবারের।
হৃদয় টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর ইউনিয়নের আলমনগর মধ্যপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক লাল মিয়া ও রেহেনা বেগমের ছেলে। নিজের পড়াশোনার খরচ ও বাবা-মায়ের মুখে খাবার তুলে দিতে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে অটোরিকশা চালাতেন হৃদয়।
আলমনগরে গিয়ে দেখা গেছে, একমাত্র ছেলে হৃদয়কে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা রেহেনা বেগম। বাড়িতে রাখা ছেলের জামা-কাপড়, খেলাধুলায় পাওয়া বিভিন্ন পুরস্কার হাতে নিয়ে কাঁদছেন আর বিলাপ করছেন। প্রতিবেশীরা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তবুও তিনি কেঁদে যাচ্ছেন। পাশেই তার স্বামী দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছেন। শোকে পরিণত হয়েছে বাড়িটি। হৃদয় বাড়ির একটি জরাজীর্ণ ঘরে থাকতেন। তার বোন জামাইয়ের দেওয়া একটি ঘরের একপাশে থাকে তার বাবা-মা। সেই ঘরেই নিহত হৃদয়ের জামা-কাপড় ও বিভিন্ন জিনিসপত্র রয়েছে। প্রতিদিনই ওই বাড়িতে লোকজন ভিড় করছেন।
পরিবারের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, হৃদয় গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। তার দুই বোনের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। তার বাবা লাল মিয়া এলাকায় ভ্যান চালাতেন। তবে অসুস্থ থাকার কারণে বেশ কয়েক মাস হলো তিনি আর ভ্যান চালাতে পারেন না। এই অবস্থায় নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতে ও সংসার চালানোর জন্য কর্মের সন্ধানে প্রায় তিন মাস আগে গাজীপুরের কোনাবাড়ী যান হৃদয়। পরে সেখানে একটি অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে চালাতেন। গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিন বিকেলে কোনাবাড়ীর কাশেমপুর সড়কের মেট্রো থানার শরীফ মেডিকেলের সামনে আনন্দ মিছিল বের হয়। সেই মিছিলে গিয়েছিল হৃদয়। এ সময় পুলিশ মিছিলে গুলি ছুড়ে। ভয়ে হৃদয় একটি বাড়ির পাশে লুকিয়ে ছিল। সেখান থেকে পুলিশ তাকে ধরে সড়কে নিয়ে যায় এবং মারধর করে। পরে হঠাৎ তাকে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলে। এরপর আর তার মরদেহ মর্গসহ বিভিন্ন স্থানে খুঁজেও পায়নি স্বজনরা।
ওইদিন আশপাশের বাসা থেকে ধারণ করা কয়েকটি ভিডিওতে দেখা যায়, ১০-১২ জন পুলিশ সদস্য এক যুবককে ধরে সড়কের ওপর নিয়ে লাঠিপেটা করছে। এরপর তাকে চতুর্দিকে ঘিরে ফেলে মারধর করে। এর মধ্যে হঠাৎ করেই একজন পুলিশ সদস্য সামনাসামনি গুলি করে। এতে মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মারা যান ওই যুবক। এরপর চারজন পুলিশ সদস্যের দুইজন হাত ও দুইজন পা ধরে তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যান। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, তিনজন পুলিশ সদস্য তাকে ছেঁচড়িয়ে একটি গলির ভেতর নিয়ে যাচ্ছেন। এ সময় আশপাশে প্রচণ্ড গুলির শব্দ। এরপর ওই তিনজন তার মরদেহ ফেলে চলে যান। তার একটু পর আবার দুইজন এসে তার মরদেহ গলির ভেতর নিয়ে যাচ্ছেন।
সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী রবিন বলেন, কোনাবাড়ীতে আমরা বিজয় মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। মেট্রো থানার সামনেই আমরা অবস্থান নিয়েছিলাম। এ সময় পুলিশ আমাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য টিয়ালশেল ও গুলি করে। অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এ সময় আমরা একপাশে ছিলাম। আর হৃদয় ছিল অন্যপাশে। একপর্যায়ে হৃদয় একটি বিল্ডিংয়ের পাশে লুকিয়ে পড়ে। পরে সেখান থেকে পুলিশ তাকে ধরে সড়কের ওপর নিয়ে যায়। হয়ত মনে করেছি মারধর করে ছেড়ে দেবে কিন্তু না, তারা গুলি করে হত্যা করেছে। এ সময় চতুর্দিকে গুলি করা হয়। ভয়ে এগিয়ে যেতে পারিনি। শুধু চেয়ে চেয়ে তার মৃত্যু দেখলাম। ভেবেছিলাম পরিবেশ শান্ত হলে তার মরদেহ আনতে যাব। পরে পুলিশ তার মরদেহ নিয়ে চলে যায়। ওইদিন রাত ১২টার পর যেখানে তাকে হত্যা করা হয়েছে সেখানে শুধু তার রক্তাক্ত লুঙ্গি পাওয়া যায়। পুলিশ মরদেহ কোথায় রেখেছে সেটা আর পাওয়া যায়নি। পরে আশপাশে খোজঁখবর নিতে গেলে কয়েকজনের কাছে তাকে হত্যা করার ভিডিও পাই।
মো. হামিদ নামের আরেকজন বলেন, কোনাবাড়ীতে আমার দোকান রয়েছে। মিছিলের আগে হৃদয় আমার দোকানের সামনেই ছিল। এ সময় তার বোনজামাইও ছিল। তাদের সেখানে যেতে বারণ করেছিলাম। তারপরও তারা আনন্দ মিছিলে যোগদান করে। বোনজামাই দূর থেকে দেখেছে কীভাবে হৃদয়কে গুলি করে মেরেছে পুলিশ। কিন্তু ভয়ে কেউ সামনে যাওয়ার সাহস পায়নি। যারা হত্যা করেছে তাদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হোক। হৃদয়ের মরদেহ যেন তার পরিবার ফিরে পায়।
হৃদয়ের বোন জিয়াসমিন আক্তার বলেন, ঘটনার দিন বিকেলে ভাইয়ের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছে ফোনে। ভাইকে বলেছি তুমি নিরাপদে থেকে বাসায় ফিরে যাও। তাকে আমার স্বামীর কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। এর প্রায় আধা ঘণ্টা পর আমার স্বামী ফোনে জানালো আমার ভাই বেঁচে নেই। পরে ভাইয়ের ফোনে ফোন দিলে অন্য একজন রিসিভ করে জানান ফোনটি তিনি কুড়িয়ে পেয়েছেন। পুলিশ ধরে নেওয়ার পরই তার পরনের লুঙ্গি খুলে ফেলেছিল। পরনে শুধু শর্ট প্যান্ট ছিল। রাত ১২টার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তার মরদেহ আর পাওয়া যায়নি। ভাইয়ের আশা ছিল লেখাপড়া করে চাকরি করবে। বাবা-মায়ের মুখে খাবার তুলে দেবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন পুলিশ শেষ করে দিল। যারা ভাইকে হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই। দেশ স্বাধীনে যেন শহীদের খাতায় ভাইয়ের নাম থাকে।
হৃদয়ের মা রেহেনা বেগম বলেন, ‘আমাদের মুখে খাবার ও পড়াশুনা করার জন্য কোনাবাড়ীতে কাজ করতে গিয়েছিল। ১০ হাজার টাকা কিস্তি তুলে ছেলেকে দিয়েছি গাড়ি চালানো শিখতে। ছেলে গাড়ি চালাবে। সেই কিস্তির টাকা কে দেবে। পুলিশ গুলি করে আমার ছেলেডাকে মাইরা ফেলেছে। আমার ছেলের মরদেহ ফেরত দেন, আমি দেখব। আমি বিচার চাই।’
হৃদয়ের বাবা লাল মিয়া বলেন, ‘বড় মেয়ের জামাইয়ের একটি ঘরে আমি স্ত্রী নিয়ে থাকি। ছেলে একটি ভাঙাচোরা ঘরে থাকত। ছেলেটা কোনাবাড়ীতে অটোরিকশা চালাতো। ঘটনার দিন তাকে বাড়িতে আসতে বলেছিলাম। কিন্তু ছেলে বললো, ভাইয়ের (বোন জামাই) সঙ্গে যাব। বাবাডা আর এলো না। আমার ছেলের মরদেহ ফেরত চাই।’
ঘটনাটি গোপালপুরে না হওয়ায় এবং নিহত হৃদয়ের মরদেহ না পাওয়ার কারণে এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দা ইয়াসমিন সুলতানা কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
এমজেইউ