সচিব-সদস্যের বিচার চায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ১৬ জুলাই মধ্যরাতে হঠাৎ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তদারকি প্রতিষ্ঠান মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সব শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার জন্য নির্দেশনা দেন ইউজিসির তৎকালীন সচিব ফেরদৌস জামান ও একজন সদস্য।
সচিবের সই করা নির্দেশনায় বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকবে। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে আবাসিক হল ত্যাগ করতে হবে। এরপরই সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনিরাপদ হয়ে পড়েন। বাসায় ফেরার পথে নানা জায়গায় হামলার শিকার হন তারা। শিক্ষার্থীদের এই বিপদে ফেলানোর জন্য ওই সময়ের দায়ীদের শাস্তি চেয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।
জানা গেছে, কমিশনের সচিব পদ থেকে সদ্য অপসারিত ফেরদৌস জামান ও একজন সদস্য অতি উৎসাহী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেন বলে সংস্থাটির প্রশাসন শাখার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান। যদিও কমিশনের ওই সদস্য বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ ঘোষণা করতে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ফোন করে বন্ধের নির্দেশ দেন।
তার দাবি, সরকারের নির্দেশ তখন আমরা মানতে বাধ্য ছিলাম। কোন আইনে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেন এমন প্রশ্নে তিনি জানান, ওই সময় দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না তাই আইনি বিষয়টি দেখার সুযোগ হয়নি।
ইউজিসির প্রশাসন শাখার কর্মকর্তারা বলেন, কোটা আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নিজ উদ্যোগে যোগাযোগ করেন ইউজিসির সচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জহুরুল হক হলের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফেরদৌস জামান। তিনি মন্ত্রীকে বিশ্ববিদ্যলয়গুলো বন্ধের পরামর্শ দেন। এরপর কমিশনের চলতি দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যানকে অবহিত করে চিঠি ইস্যু করে দেন। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হলে কমিশনের অন্যান্য সদস্য জানাতে হয়। সেটি তিনি করেননি।
তাড়াহুড়া করে ১৬ জুলাই মধ্যরাতে প্রথমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেয় ইউজিসি। একটু পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্থলে বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনার কথা জানানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ কেন করা হলো, কোন আইনে করা হলো, এর কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ও সদস্য প্রফেসর আলমগীর হোসেন কোনও মন্তব্য করতে চাননি। আর সচিব ফেরদৌস জামানকে একাধিবারে ফোন ও এসএসএম দেওয়া হলেও রেসপন্স (উত্তর) মিলেনি। যদি সম্প্রতি তাকে সচিব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আসিফ সোহেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশের সবগুলো উচ্চপর্যায়ের প্রতিষ্ঠানকেই আওয়ামী লীগ দলীয়করণ করেছিল। তারা এমন একটি বলয় এবং পরিস্থিতি তৈরি করেছিলো যে, কোন প্রতিষ্ঠানের কী কাজ, তারা কতটুকু কাজ করতে পারে বা কতটুকু সীমাবদ্ধতা রয়েছে এমন ধরনের কোনও সীমারেখা অবশিষ্ট ছিল না। ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মিশন-ভিশন বজায় রেখে কাজ করতে পারেনি। ইউজিসির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হয়েছে।
তিনি বলেন, যারা অতি উৎসাহী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের জীবনকে হুমকি ও বিপন্ন করেছিল তাদের বিচার চাই। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শক্তির সাথে একাত্মতা পোষণ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা এই চক্র সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। ইউজিসির সংস্কারের দিকেও আমরা নজর দেবো।
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দায়িত্বপালন করা ইউজিসির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অপসারণ দাবি করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকগুলো বিষয় বিবেচনা করেই আমরা সংস্কারের বিষয়টি চিন্তা করব। তবে সংস্কার যে চাইবো এতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্য কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারী যদি বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ান তবে অবশ্যই আমরা তার অপসারণ চাইব।
আইনে যা আছে:
১৬ জুলাই মধ্যরাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে ইউজিসি জানায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকবে।
এদিকে ইউজিসি কর্তৃক সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে সমালোচনা ঝড় ওঠে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এর প্রতিবাদ করেন। তারা বলেন, প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব আইনে চলে। কোনও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ফোরাম সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এছাড়াও ১৯৭৩ সালে বিশেষ অধ্যাদেশে দেশের প্রথম চারটি- ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়।
এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কোনও বিষয়ের সিদ্ধান্ত অন্য কারো নেওয়ার এখতিয়ার নেই। তারপরও ইউজিসি আগ বাড়িয়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ ঘোষণা করে। এটি ইউজিসি করতে পারে না।
ইউজিসির এমন সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ জানিয়ে ওই সময় নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে প্রশ্ন তুলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় বা ইউজিসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করার কে? ৭৩ এর অধ্যাদেশ কি নাই হয়ে গেছে? ইউজিসি কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে পারে? জীবনে কখনও শুনিনি। এমন কখনও হয়নি।
আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য প্রফেসর ড. এ কে আজাদ চৌধুরী ১৭ জুলাই ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের বিশেষ অ্যাক্টে পরিচালিত হয়। এই আইনে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও খোলার ক্ষমতা একমাত্র সিন্ডিকেটের। সিন্ডিকেটে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেউ বিরোধিতা করলেও হবে না।
তিনি বলেন, বিশেষ কোনও ইমারজেন্সি (জরুরি) হলে সরকার ভাইস চ্যালেন্সরকে রিকোয়েস্ট (অনুরোধ) করতে পারেন, যেন জরুরি সিন্ডিকেট ডেকে বন্ধ করে দেয়। সেটা তিনি শুনবেন কি শুনবে না এটাও তার এখতিয়ার। সেটা শুনলেও উপাচার্য তার ক্ষমতাবলে মাত্র চারদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর সিন্ডিকেট ডেকে সেটার অনুমোদন নিতে হবে। নইলে উপাচার্য শাস্তির মুখে পড়বেন।
তিনি আরও বলেন, ইউজিসি সব জেনেও এটা কেন করেছে তারা ভালো বলতে পারবে। তবে আমি মনে করি, এ ধরনের সিচুয়েশনে ইউজিসি এমন ভূমিকা নিতে পারে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওই সময় যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তাতে কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সিন্ডিকেট ডাকার পরামর্শ দিতে পারতেন। এতে আইনের মধ্যে থেকেই সমাধান হতো। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ব্যাপারে একমাত্র সিন্ডিকেটে সর্বময় ক্ষমতার অধিকার।
ইউজিসির কাজ কী?
স্বাধীনতা পরপরই ১৯৭২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক বরাদ্দ এবং বিষয় অনুমোদনের ক্ষমতা দেওয়া হয়। কিন্তু এখন দেশে ১১৫টি বেসরকারি ও ৫৮টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সময়ের ব্যবধানে বর্তমানে কাজ অনেক বিস্তৃত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক অনুমোদন, বিষয় খোলা, গবেষণা, স্কলারশিপ এবং ফেলোশিপ, ইউজিসি লাইব্রেরি এবং উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প। এছাড়াও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন ব্যতীত সার্বিক তদারকির কাজটি করে থাকে এ সংস্থা। তবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ খোলার মতো কাজ ইউজিসির এখতিয়ারে নেই। অতীতে এ ধরনের নজির নেই।
প্রসঙ্গত, গত ১৪ জুলাই কোটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে আন্দোলনের পরিস্থিতি। চীন সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না, তো কি রাজাকারের নাতিরা পাবে? বিচিত্র আমাদের দেশ, বিচিত্র আমাদের মানসিকতা— বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে এদিন রাতেই প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতিবাদ ও প্রত্যাহারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। তার দুদিন পরই ১৬ জুলাই মধ্যরাতে হঠাৎ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে ইউজিসি।
এনএম/পিএইচ