চলতি বছরের ১১ আগস্ট শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা মামলা থেকে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ জনকে খালাস দেওয়া হয়। মামলা প্রত্যাহারে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক মো. রবিউল আলম তাদের খালাস দেন। যদিও মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই বিরোধিতা করেছেন। তিনি দুদকের মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের আপিল বিভাগে আপিলও করেছেন…
সম্প্রতি মানি লন্ডারিং (অর্থপাচার) কিংবা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে চার্জশিটভুক্ত অন্তত পাঁচটি মামলা আদালতে বিচারাধীন থাকাবস্থায় প্রত্যাহার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এভাবে মামলা প্রত্যাহার আইনগতভাবে বৈধ কি না, নৈতিকতার প্রশ্নে এটি কতটুকু যৌক্তিক— তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার হিসেবে বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। অতীতের ইতিহাস খতিয়ে দেখলে জানা যায়, যখন যে পক্ষ ক্ষমতায় এসেছে, নিজেদের স্বার্থে তারা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করেছে।
রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে বিভিন্ন মামলা হয়, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ মামলাই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। অথচ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক ফৌজদারি মামলা এবং আর্থিক কেলেঙ্কারি বা দুর্নীতির কারণে দায়ের হওয়া মামলা কখনই এক নয়। অন্যদিকে, মামলাটি যদি আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় থাকে তাহলে সেটি প্রত্যাহার করে নেওয়া বড় প্রশ্নের জন্ম দেয়।
এমনই এক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে দেশের স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বশাসিত সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সংস্থাটি থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, মানি লন্ডারিং কিংবা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে চার্জশিটভুক্ত অন্তত পাঁচটি মামলা আদালতে বিচারাধীন থাকাবস্থায় প্রত্যাহার করেছে দুদক। সদ্য বিদায়ী কমিশনের অনুমোদনক্রমে মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। প্রত্যাহারের প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল আরও ডজনখানেক দুর্নীতির মামলা। দুদক ক্রিমিনাল ‘ল’ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৮ এর ১০ (৪) ধারা ও ফৌজদারি কার্যবিধি ৪৯৫ ধারার বিধান অনুসরণ করে মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়।
বিচারাধীন অবস্থায় মামলাগুলো প্রত্যাহারের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি আইনগতভাবে বৈধ হলেও নৈতিকভাবে বিষয়টি কতটুকু গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ হিসেবে খাত-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দুর্নীতি মানে আর্থিক অনিয়ম সংক্রান্ত বিষয়। এ সংক্রান্ত মামলা ও চার্জশিট সরাসরি দালিলিক প্রমাণসাপেক্ষ; এখানে মৌখিক বক্তব্যে কাউকে যেমন সাজা দেওয়া যায় না, তেমনি সরাসরি সম্পৃক্ত কাউকে খালাস দেওয়াও সম্ভব নয়।
দুর্নীতি মামলার চূড়ান্ত রায় একমাত্র আদালতের মাধ্যমেই নিষ্পত্তি হওয়া সমীচীন বলে মনে করছেন তারা। এ ধরনের মামলায় বড় কোনো ভুল না হলে প্রত্যাহারের সুযোগ রাখা উচিত নয়— মন্তব্য বিশিষ্টজনদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান মো. ইফতেখারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশের পটপরিবর্তনের পর দুদকের সাম্প্রতিক তৎপরতা দুই ভাবে বিবেচনা করা উচিত। একটি হচ্ছে, প্রাক্তন মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল প্রতীক্ষিত যে সব ঘটনা ছিল সে বিষয়ে সরকার পতনের পর ব্যবস্থা নেওয়া। এখন যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার মতো তথ্য দীর্ঘদিন আগে থেকেই ছিল। অন্তত আমরা সেটি বলতে পারি এবং টিআইবির গবেষণায় সেগুলো দেখানো হয়েছে।
‘নির্বাচনের আগে আমরা দেখিয়েছি কীভাবে জনপ্রতিনিধিদের সম্পদ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তখন দুদক কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যতটুকু জানা যায়, পটপরিবর্তনের পর আগের ওই তথ্যের ভিত্তিতেই এখন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
‘অন্যদিকে, দুদকেরই দায়ের করা মামলা, যা এখন মনে করা হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হয়েছিল, সেটি ধারাবাহিকভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে বা নেওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে। এর মাধ্যমে দুদক নিজেই প্রমাণ করলো যে, ক্ষমতায় থাকাকালে সরকারি দলের উচ্চ পর্যায়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস দেখাতে পারেনি সংস্থাটি। আইনগত যে ম্যান্ডেট বা সক্ষমতা, তা প্রয়োগ করতে পারেনি। কিন্তু ক্ষমতা থেকে ওই পক্ষ যখন পতিত হয়, তখন লম্ফঝম্প করা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্যই তারা এমন পদক্ষেপ নেয়।’
দুদক সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যানের মতে, ‘যে মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে, সেটি কিন্তু একই ফর্মুলায় হচ্ছে। কারণ, যাদের মামলা প্রত্যাহার বা তুলে নেওয়া হচ্ছে, পটপরিবর্তনের ফলে তারা রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। এর মাধ্যমে দুদক নিজেই প্রমাণ করেছে যে, তারা শুধু ব্যক্তির পরিচয় ও অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে কার্যক্রম পরিচালিত করছে। যদিও এটি নতুন কিছু নয়, দুদকের জন্মলগ্ন থেকেই করা হচ্ছে।’
অন্যদিকে, দুদকের সাবেক মহাপরিচালক ও সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম সরাসরি মামলা প্রত্যাহারের বিরোধিতা করেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘বড় কোনো ভুল না হলে মামলা প্রত্যাহারের সুযোগ রাখা উচিত নয়। কারণ, দুদকের যে কোনো মামলা ও চার্জশিট কমিশনের অনুমোদনক্রমে দাখিল হয়। তাহলে অনুমোদনের সময় আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এ ছাড়া পুনরায় তদন্ত ছাড়া কোনো মামলা প্রত্যাহার করা যায় না। যদিও দুদক আইনে সেই ক্ষমতা দেওয়া আছে এবং সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হলে দুদককে মামলার মেরিট দেখে প্রত্যাহার করতে হবে। যে মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেগুলোর মেরিট না দেখেই প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে মনে করি। এটি খারাপ নজির হয়ে থাকবে।’
প্রধান উপদেষ্টার মামলা প্রত্যাহারের উদাহরণ টেনে তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান প্রধান উপদেষ্টার মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই বিরোধিতা করেছেন বলে জানি। তিনি দুদকের প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের আপিল বিভাগে আপিলও করেছেন। এটির সূত্র ধরে রাজনৈতিক হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে আরও মামলা প্রত্যাহার হচ্ছে।’
‘পুলিশের ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তা নিজেই চার্জশিট দিতে পারেন। কিন্তু দুদকের মামলা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কমিশনের অনুমোদন নিয়ে প্রথমে মামলা এবং পরবর্তীতে চার্জশিট দিতে হয়। চার্জশিট দিতেও কমিশনের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। বললেই তারা চার্জশিট দিতে পারে না। যদি ভুলত্রুটি হয়ে থাকে, তাহলে আদালতে নিষ্পত্তি হবে। সরাসরি মামলা প্রত্যাহার এক ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহার বলে মনে করি।’
‘উদাহরণ হিসাবে বলতে পারি, ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরবর্তী সময়ে দুদকের মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে তৎকালীন সরকারের চাপ ছিল। কিন্তু ওই সময়ের চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের নেতৃত্বাধীন কমিশন কোনো মামলাই প্রত্যাহার করেনি।’
ইতিহাস কী বলছে
২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের নজির রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মামলা প্রত্যাহার-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির ৩০টি বৈঠকে মোট ১১ হাজার ১১৩টি মামলা কমিটির বৈঠকে উত্থাপন করা হয়। এর মধ্যে সাত হাজার ১০১টি মামলা সম্পূর্ণ বা আংশিক প্রত্যাহারের আদেশ দিয়েছিল জাতীয় কমিটি। ফলে খুনি, শীর্ষ সন্ত্রাসী, ধর্ষকসহ প্রায় এক লাখ অভিযুক্ত ব্যক্তি অব্যাহতি পান বা পাওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকেন। কমিটির কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ৩০টি বৈঠকে মামলা প্রত্যাহারের সুযোগে খুন, অগ্নিসংযোগ ও ডাকাতির মতো গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিরাও দলীয় বিবেচনায় মুক্তি পেয়েছেন। কমিটি শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসীসহ খুন বা ডাকাতির মতো ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত দেওয়ায় প্রত্যাহারের প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
অন্যদিকে, ওই সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা প্রায় ৩৪৫টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হলেও কোনো মামলাই প্রত্যাহার করা হয়নি বলে জানা গেছে। মামলা প্রত্যাহার নিয়ে উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণও রয়েছে। উদাহরণ হিসাবে দেখা যায়, ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ত্রাণের টিন আত্মসাতের একটি মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত এক আদেশ বাতিল করে উচ্চ আদালত পর্যবেক্ষণ দেয়। ২০২১ সালের ১৩ জানুয়ারি হাইকোর্টের দেওয়া পর্যবেক্ষণটি হলো- ‘ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ৪৯৪ ধারা অনুসারে রায়ের আগ পর্যন্ত কোনো মামলা সরকারকে প্রত্যাহারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের ১০ (৪) ধারা অনুযায়ী, কমিশনের অনুমতি ছাড়া দুর্নীতির কোনো মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়নি।’
ওই পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ২০০৪ সালে প্রণীত দুদক আইন অনুযায়ী কমিশন সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন। কমিশন তার নিজস্ব আইন ও বিধি অনুযায়ী পরিচালিত হবে। কমিশন আইনের ৩২ ধারা অনুযায়ী, কমিশনের অনুমোদন ছাড়া কোনো অপরাধ বিচারের জন্য আমলে নিতে পারবে না আদালত। আইনের ৩৩ ধারা অনুযায়ী, কমিশনের মামলা পরিচালনার জন্য নিজস্ব প্রসিকিউশন টিম থাকবে। সুতরাং দুদক আইন ও ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট একসঙ্গে মিলিয়ে পড়লে এটা স্পষ্ট যে, সিআরপিসির ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী সরকারের ক্ষমতা প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতা শুধুমাত্র কমিশনের। তবে, দুদকের তৎকালীন চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের নেতৃত্বাধীন কমিশন ওই সরকারের কোনো সুপারিশই আমলে নেয়নি বলে জানা গেছে। ফলে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সম্মতি না দেওয়ায় দুদকের ৩৪৫টি মামলা প্রত্যাহারের চেষ্টা সফল হয়নি।
সম্প্রতি যে সব মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে
চলতি বছরের ১১ আগস্ট শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা মামলা থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। মামলা প্রত্যাহারে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক মো. রবিউল আলম আসামিদের খালাস দেন।
যারা আসামি ছিলেন- গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম, পরিচালক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান, পরিচালক পারভীন মাহমুদ, নাজনীন সুলতানা, মো. শাহজাহান, নূরজাহান বেগম ও পরিচালক এস এম হাজ্জাতুল ইসলাম লতিফী, অ্যাডভোকেট মো. ইউসুফ আলী, অ্যাডভোকেট জাফরুল হাসান শরীফ, গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি কামরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান, শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের দপ্তর সম্পাদক কামরুল হাসান ও প্রতিনিধি মো. মাইনুল ইসলাম।
গত ১ ফেব্রুয়ারি আদালতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান। ২০২৩ সালের ৩০ মে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ ৬৭৮০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক। চার্জশিটে নতুন করে একজন আসামিকে যোগ করা হয়েছিল।
মামলা প্রত্যাহারের আবেদনে যা বলা হয়
ক্রিমিনাল ‘ল’ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৮ এর ১০ (৪) ধারা ও ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৫ ধারার বিধানে দুদক মামলা দুটির প্রসিকিউশন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহারসহ তাদের কোনো সম্পদ ক্রোক, অবরুদ্ধ ও বিদেশ গমনের নিষেধাজ্ঞা থাকলে, তার সব দায় থেকে তাদের অব্যাহতি প্রদান করা প্রয়োজন।
যদিও গত ১১ অক্টোবর দুদকের দায়ের করা মামলা বাতিলের আবেদন খারিজের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি দেয় উচ্চ আদালত। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ড. ইউনূসসহ সাত ব্যক্তির করা লিভ টু আপিল (আপিল করার অনুমতি চেয়ে আবেদন) মঞ্জুর করেন আপিল বিভাগ।
এ বিষয়ে গত ২১ অক্টোবর আবেদনকারীদের আইনজীবী আবদুল্লাহ-আল-মামুন গণমাধ্যমকে বলেন, মামলাটি শুনানির জন্য বিচারিক আদালতে ৫ সেপ্টেম্বর তারিখ ধার্য থাকা অবস্থায় এর আগেই আমাদের (লিভ টু আপিলকারী) না জানিয়ে ১১ আগস্ট মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়। যা আইনের লঙ্ঘন।
দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদী হয়ে গত বছরের ৩০ মে মামলাটি করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামিরা ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে, যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ।
বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান লিটুর অবৈধ সম্পদের মামলা
অন্যদিকে, গত ৫ সেপ্টেম্বর বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটুর অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা প্রত্যাহার করা হয়। দুদকের সদ্য সাবেক কমিশনার মো. জহুরুল হকের সই করা মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার অনুমোদনপত্রের ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত থেকে ওই মামলা প্রত্যাহার করা হয়।
গত ১১ জুলাই ৯০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বেঙ্গল গ্রুপ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটুর বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিচালক মো. কামরুজ্জামান।
তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বেঙ্গল গ্রুপ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটুর দাখিল করা সম্পদের বিবরণীতে ১২ লাখ ৪১ হাজার ৮৩৭ টাকার তথ্য গোপনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর বাইরে দুদকের অনুসন্ধানে ৯০ কোটি ৩২ লাখ ৩০ হাজার টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ২৩ এপ্রিল দুদকের উপপরিচালক মোনায়েম হোসেন বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছিলেন। আবুল খায়ের লিটুর বিরুদ্ধে দুদক আইন, ২০০৪ এর ২৬ (২) ও ২৭ (১) ধারায় চার্জশিট দাখিল করা হয়েছিল।
তৌফিক ইমরোজ খালিদীর মামলা
একই দিন অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর মামলাও প্রত্যাহার করা হয়।
২০২০ সালের ৩০ জুলাই অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদী হয়ে তৌফিক ইমরোজ খালিদীর বিরুদ্ধে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ মামলাটি দায়ের করে। গত ২৫ এপ্রিল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়, কোনো ধরনের বৈধ উপার্জন ছাড়াই তৌফিক ইমরোজ খালিদী এইচএসবিসি, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড, সাউথ ইস্ট ব্যাংক লিমিটেড ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের চারটি শাখার বিভিন্ন হিসাবে ৪২ কোটি টাকা জমা রেখেছেন। ‘ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্রতারণার মাধ্যমে’ তিনি এসব টাকা অর্জন করেছেন বলে মামলায় অভিযোগে বলা হয়।
মির্জা আব্বাসের মামলা
গত ২৯ আগস্ট বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাসের দুর্নীতির আরও একটি মামলা প্রত্যাহার করা হয়। ২০০৭ সালের ১৫ জুলাই শাহবাগ থানায় মামলাটি দায়ের করেছিলেন দুদকের তৎকালীন উপ-পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন। চার্জশিট দেওয়ার পর আদালতে বিচারাধীন মামলাটি প্রত্যাহার করা হয় দুদকেরই আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে। ওই মামলায় অপর দুই আসামি হলেন- বিএনপির সাবেক এমপি আলী আসগর লবী ও গণপূর্তের কর্মকর্তা মাহফুজুল ইসলাম।
মামলায় ২০০৬ সালে পূর্তমন্ত্রী থাকাকালে প্যাসিফিক কেমিক্যালস নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ১৯ দশমিক ৪৪ কাঠার জমি বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ ছিল আসামিদের বিরুদ্ধে।
যদিও একই দিন দুদকের দায়ের করা অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলার রায়ে খালাস পান মির্জা আব্বাস। সম্পদের তথ্য গোপন এবং জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক মামলাটি করেছিল ২০০৭ সালে। ওই মামলায় আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সাত কোটি ৫৪ লাখ ৩২ হাজার ২৯০ টাকার সম্পদের মালিক হওয়া এবং ৫৭ লাখ ২৬ হাজার ৫৭১ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে আনা হয়েছিল।
এমজিএইচ গ্রুপের আনিসের অবৈধ সম্পদের মামলা
গত ১৪ অক্টোবর মামলা প্রত্যাহার হয় এমজিএইচ গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আনিস আহমেদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ করা মামলাটি। ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর ১৩৬ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আনিস আহমেদ গোর্কির বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
অভিযোগ রয়েছে, আসামি আনিস আহমেদ নিয়মিত আয়করদাতা হলেও উল্লিখিত মোট আয়ের মধ্যে ২০২০-২১ করবর্ষের আয়কর নথিতে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর ১৯ এএএএ ধারায় ১৩৬ কোটি ২ লাখ ৭৭ হাজার ৪০০ টাকা বিনিয়োগ হিসাবে প্রদর্শন করেন। কিন্তু আসামি আনিস আহমেদ বিনিয়োগ হিসাবে প্রদর্শিত অর্থের পক্ষে সন্তোষজনক কোনো রেকর্ডপত্র উপস্থাপন করতে পারেননি। অনুসন্ধানকালে তার উল্লিখিত আয়ের উৎসের পক্ষে সন্তোষজনক কোনো তথ্য-প্রমাণও পায়নি দুদক।
প্রত্যাহারের তালিকায় আরও যে সব মামলা
দুদক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ও তার স্ত্রীর দুই মামলা প্রত্যাহারের তোড়জোড় চলমান রয়েছে। অন্যদিকে, মামলার তালিকায় রয়েছে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার ও তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমার দুর্নীতির মামলা, হাফিজ ইব্রাহিমের প্লট সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলা, মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলী ফালুর নামে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত দুর্নীতির চার মামলা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর লুৎফুজ্জামান বাবরের দুর্নীতির অপর একটি মামলা। এসব মামলা আদালতে বিচারাধীন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া অর্ধশত দুর্নীতির মামলা রয়েছে যেগুলো বিভিন্ন অজুহাতে প্রত্যাহারের বিবেচনায় নিয়ে প্রাথমিক তালিকায় রয়েছে বলে জানা গেছে।
আরএম/এমএআর/