বরেন্দ্র জাদুঘরে জায়গার অভাবে নিদর্শনের ঠাঁই হলো স্টোররুমে

বরেন্দ্র জাদুঘরে জায়গার অভাবে নিদর্শনের ঠাঁই হলো স্টোররুমে

সংগ্রহের দিক থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালা বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম বা বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। স্থানীয়দের কাছে এটি বরেন্দ্র জাদুঘর নামে পরিচিত। জাদুঘরটিতে আছে দুষ্প্রাপ্য সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। মানুষের অতীত ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক ও বাহক এটি। কালের সাক্ষী জাদুঘরটি দর্শনার্থীদের অতীতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তবে অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাবে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনগুলোর ঠাঁই হয়েছে স্টোররুমে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ সব নিদর্শনগুলো দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দর্শনার্থীরা।

সংগ্রহের দিক থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালা বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম বা বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। স্থানীয়দের কাছে এটি বরেন্দ্র জাদুঘর নামে পরিচিত। জাদুঘরটিতে আছে দুষ্প্রাপ্য সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। মানুষের অতীত ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক ও বাহক এটি। কালের সাক্ষী জাদুঘরটি দর্শনার্থীদের অতীতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তবে অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাবে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনগুলোর ঠাঁই হয়েছে স্টোররুমে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ সব নিদর্শনগুলো দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দর্শনার্থীরা।

রাজশাহী নগরের হেতমখাঁ সদর হাসপাতালের সামনে প্রাচীন এই সংগ্রহশালাটির অবস্থান। জাদুঘরটি পরিচালনা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। একসময়ের ব্যক্তি উদ্যোগে গঠিত দেশের প্রথম জাদুঘরটি কালের সাক্ষী হয়ে পদ্মা পাড়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে ভবনটি। এখানে উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলের পাল, সেন, মৌর্য ও গুপ্ত আমলসহ হাজার হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন সংরক্ষিত আছে।

জানা গেছে, নাটোরের দিঘাপতিয়ার রাজ পরিবারের জমিদার শরৎকুমার রায়, আইনজীবী অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ও রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রমাপ্রসাদ চন্দ্রের মিলিত প্রচেষ্টায় ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাদুঘরটি।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, প্রায় ১৭ হাজারেরও বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দেশন আছে এই জাদুঘরে। দেশ বিদেশের দর্শনার্থীরা আসেন এখানে। প্রতিদিন প্রায় ৩০০-৪০০ দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখর থাকে এই রিসার্চ মিউজিয়ামটি। তাদের মধ্যে কেউ আসেন দর্শনার্থী হিসেবে আবার কেউ গবেষণার তথ্য উপাত্যের খোঁজে। অথচ জায়গার অভাবে দর্শনার্থীদের জন্য জাদুঘরের মূল অংশে রাখা হয়েছে মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ নিদর্শন। বাকি নিদর্শনের ঠাঁই হয়েছে স্টোররুমে। কর্তৃপক্ষ চাইলেও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করতে পারছে না সেগুলো।

সংগ্রশালাটির তালিকায় রয়েছে- দামি মূর্তি ও ভাস্কর্য। রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার পুঁথিসহ বিভিন্ন শতাব্দীর অন্তত পনেরো হাজার বই। আছে তাল পাতায় লেখা পুঁথিও। কিন্তু জায়গার অভাবে সবগুলো নিদর্শন দর্শনার্থীদের দেখানোর সুযোগ হয় না। এ কারণে অনেক নিদর্শন রাখা হয়েছে স্টোররুমে। এমনকি পাল যুগ থেকে মুসলিম যুগ পর্যন্ত আঁকা বিভিন্ন চিত্রকর্মেরও এখন ঠাঁই হয়েছে স্টোররুমে। স্থান সংকুলান না হওয়াতে এ নিদর্শনগুলো দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দর্শনার্থীরা।

রাজশাহী জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে কালো পাথরের বিখ্যাত গঙ্গা মূর্তিসহ পুরাতত্ত্বের ৩২টি দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন সংগ্রহ করে। জাদুঘরের সংগ্রহে বর্তমানে রয়েছে পাণ্ডুলিপিসহ ১১ হাজার ৩৩১টি প্রত্ননিদর্শন। গ্যালারি আছে ১৪টি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাদুঘর থেকে বিভিন্ন সময়ে হারিয়ে গেছে প্রায় তিন হাজার দুর্লভ প্রত্নসামগ্রী।

ইনভেন্টরি প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত হারিয়েছে ১৮৫টি প্রত্নসামগ্রীসহ প্রায় তিন হাজার দুর্লভ বস্তু। হারিয়ে যাওয়া প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে আছে- দুটি ব্রোঞ্জ, দুটি কপার, দুটি লিনেন, একটি ব্রাশ, দুটি সিলভার, একটি ক্রিস্টাল, ৪৭টি বিভিন্ন ধরনের পাথর, ১০১টি টেরাকোটা, ১৩টি কাগজ ও দুটি প্রাণীর চামড়া। এছাড়া পাঁচ হাজার ৯৭১টি নিবন্ধিত মুদ্রার মধ্যে ৩৩টি ও ১৩ হাজার ৯৩৩টি গ্রন্থের মধ্যে ৮৫টি পাওয়া যাচ্ছে না। হারিয়েছে ১৩ হাজার ৫৭৬টি প্রকাশনার (পুস্তক, পুস্তিকা, গ্রন্থ, জার্নাল ইত্যাদি) মধ্যে তিন হাজার ৫২টিও।

তবে জাদুঘরের এ পর্যন্ত সংগ্রহ সংখ্যা সাড়ে আট হাজারেরও বেশি। এর  মধ্যে প্রায় দেড় হাজার প্রস্তর ও ধাতব মূর্তি, ৬১টি লেখচিত্র, দুই হাজারেরও বেশি প্রাচীন মুদ্রা, ৯০০’র বেশি পোড়ামাটির ভাস্কর্য-পত্র-ফলক, প্রায় ৬০টি অস্ত্রশস্ত্র, ৩০টির মতো আরবি-ফার্সি দলিল, মোগল আমল থেকে ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকারের রৌপ্য-ব্রোঞ্জ-মিশ্র ধাতুর প্রায় ৪০০টি মুদ্রা আছে এখানে। এছাড়া প্রায় সাড়ে চার হাজারেরও বেশি পাণ্ডুলিপি আছে। মোট ১৪টি গ্যালারিতে রাখা এসব সংগ্রহ দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।

বরেন্দ্র জাদুঘরের এক নম্বর গ্যালারিতে আছে প্রাচীন আমলের ঢাল-তলোয়ার, ধাতব পাত্র, মহেঞ্জোদারো ও মহাস্থানের বিভিন্ন নিদর্শন। সম্রাট অশোক থেকে ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত কাঠ, পাথর ও অন্য বস্তু দ্বারা নির্মিত মূর্তিগুলো প্রদর্শিত হয়। দুই নম্বর গ্যালারি সূর্য, বিষ্ণ, শিব, কার্তিক ও অন্য দেবতার মূর্তি, পার্বতী, সরস্বতী, মনসা দুর্গা ও অন্য দেবীর মূর্তি। তিন নম্বর বুদ্ধ গ্যালারিতে সব বুদ্ধ দেব-দেবী ও জৈন মূর্তি, বোধিসত্ত্ব, ঋসভনাথ, পার্শ্বনাথ ইত্যাদি প্রদর্শিত হয়। সেখানে প্রাচীন আমলের আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, বাংলা লেখচিত্র এবং পাল যুগ, সুলতানি যুগ, মোগল যুগের শিলালিপি ছাড়াও শেরশাহর দুটি কামান ও মেহরাব প্রদর্শিত হচ্ছে। চার নম্বর ইসলামী গ্যালারিতে হাতে লেখা কোরআন শরীফ, মোগল আমলের ফারসি দলিল, পোশাক মুদ্রা ইত্যাদি দিয়ে এ গ্যালারি প্রাচীন ঐতিহ্য প্রদর্শন করা হচ্ছে।

বর্তমানে পাঁচ নম্বর আবহমান বাংলা গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হচ্ছে বাঙালি জাতির ব্যবহার্য জিনিসপত্র, প্রাচীন গহনা, দেশি বাদ্যযন্ত্র, আনুষ্ঠানিক মৃৎপাত্র, উপজাতিদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র। কিশলয় বেষ্টিত নদীমাতৃক বাংলার নৌকার মডেল, অস্ত্রের সূর্য নরম সোনালি রোদ ছড়িয়ে জন্মভূমিকে করেছে অপরূপ সৌন্দর্য। এখানে সেই চিত্র ফুটে ওঠে।

টাঙ্গাইল থেকে প্রথমবারের জাদুঘর দেখতে এসেছেন শিক্ষার্থী শান্ত সাহা। তিনি বলেন, শুনেছিলাম দেশের প্রথম জাদুঘর এটি। প্রাচীন এই নিদর্শনগুলো দেখে অনেক ভালো লাগছে। পুরো মিউজিয়ামে অনেক এমন নিদর্শন আমরা ঘুরে দেখেছি। এখানে আসার পরে অন্যরকম একটা অভিজ্ঞাতা হলো। ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম।

নওগাঁ থেকে জাদুঘর দেখতে এসেছেন ওবাইদুল হক বাবু। তিনি বলেন, বেশ কয়েকবার এখানে এসেছি। অনেক ভালো লাগে এই নিদর্শনগুলো দেখতে। বছর বছর একই নিদর্শন আমরা দেখতে পাই। তবে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি আরও অনেক নিদর্শন জায়গার অভাবে দর্শনার্থীদের দেখাতে পারছে না তারা। আমাদের দাবি- এটি দেশের প্রথম ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটা জাদুঘরে কর্তৃপক্ষ যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে সেগুলো সবার দেখার ব্যবস্থা নেয়।

বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের প্রদর্শনীর জন্য পর্যাপ্ত জায়গার ও ভবনের অভাব। এখানের আসা সবগুলো নিদর্শন আমরা দর্শকদের দেখাতে পরি না। এই জাদুঘর নিয়ে আমাদের বড় পরিকল্পনা আছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আরকোলজি বিভাগ নেই। একটা বিভাগ হওয়া প্রয়োজন। এটাকে কীভাবে ইনস্টিটিউটে রূপান্তরিত করা যায় সেটি নিয়ে ভাবা হচ্ছে। এছাড়া বর্তমানে বিভিন্ন গবেষণা স্থবির রয়েছে।

এফআরএস

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *