মাইশা তাবাসসুম অনিমা
ঢাকার বাড্ডার একটি গলিতে, ২০১৯ সালের এক ভয়াল দিনে বাতাসে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা ভাসছিল। তাসলিমা বেগম রেনু তার সন্তানের ভর্তির খোঁজ নিতে একটি স্কুলের সামনে হাজির হন। ব্যস্ত জীবনের স্রোতে গা ভাসানো সেই এলাকার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল শিশু অপহরণের গুজব।
মুহূর্তের মধ্যেই সেই ফিসফাস রূপ নেয় কঠিন সন্দেহে, আর চোখের পলকে একদল লোক জড়ো হয়ে যায়। ভুল তথ্য বিশ্বাসে পরিণত হয়, সন্দেহ রূপান্তরিত হয় হিংস্রতায়, আর কয়েক মিনিটের মধ্যে রেনুকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল—একটি গুজব, একটি ত্রুটিপূর্ণ মানসিকতার ফল, যা ভয় এবং ভুল তথ্য দ্বারা উসকে ওঠে তাৎক্ষণিক বিচার দাবি করে।
এই ঘটনাটি বাংলাদেশের জন্য নতুন নয়। জনগণ দীর্ঘদিন ধরে কার্যকর আইন-শৃঙ্খলার অভাবে ভুগছিল। যে দাবি যাচাই করা হয়নি, তা দ্রুত সহিংসতায় পরিণত হয়, যেমন উত্তেজিত জনতার নিজেদের হাতে আইন তুলে নেওয়া।
রেনুর মৃত্যুটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের তফাজ্জল হোসেনের হত্যাকাণ্ডের মতোই, যেখানে তাকে চোর সন্দেহে ছাত্ররা পিটিয়ে হত্যা করে। প্রতিটি ঘটনাতেই, অভিযুক্তদের কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি তাদের নির্দোষ প্রমাণ করার, আর জনতার রায় ছিল দ্রুত এবং প্রাণঘাতী।
অনেকগুলো ঘটনার মধ্যে একটি সাধারণ সূত্র হচ্ছে ভুল তথ্যের ভূমিকা। মব জাস্টিস-এর উৎপত্তি খুঁজে পাওয়া যায় মানব সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে, যখন আনুষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থা বিকশিত হয়নি বা অধিকাংশ জনগণের কাছে তা অপ্রাপ্য ছিল। সেই সময়, বিভিন্ন সম্প্রদায়, যারা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, নিজেদের উদ্যোগেই শৃঙ্খলা বজায় রাখত এবং অপরাধীদের শাস্তি দিত। এই ধরনের পরিস্থিতিতে বিচার প্রক্রিয়া ছিল দ্রুত, কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই তা ন্যায্য ছিল। নিরপেক্ষতার অভাবে এই ধরনের বিচার প্রক্রিয়া প্রায়ই প্রতিশোধে পরিণত হতো, যেখানে ন্যায়বিচারের চেয়ে প্রতিহিংসাই ছিল চূড়ান্ত লক্ষ্য।
দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে উপনিবেশ-পূর্ব বাংলায়, কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা থেকে দূরে অবস্থিত বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলো প্রায়ই নিজেদের শাসন কাঠামোর ওপর নির্ভর করত। যখন চুরি, জাদুবিদ্যা বা অন্য কোনো অপরাধের অভিযোগ উঠত, তখন পুরো সম্প্রদায় একত্র হয়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে শাস্তি দিত। যদিও এই ধরনের পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা, তা প্রায়ই নির্দোষ ব্যক্তিদের প্রতি চরম সহিংসতায় রূপ নিত।
ঔপনিবেশিক আমলে দক্ষিণ এশিয়ার আইন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়েছিল, তবে জনগণের মাঝে সম্প্রদায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা পুরোপুরি দূর হয়নি। কার্যকর এবং দ্রুত আইনি প্রক্রিয়া না থাকায়, গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নিজেদের হাতে আইন তুলে নিত, যা তৎকালীন নামে গণপিটুনি (বর্তমান মব জাস্টিস) চলমান সমস্যাকে আরও জোরালো করেছে। আজকের বাংলাদেশ এখনো এই ঐতিহ্যের প্রভাব মোকাবিলা করছে, যেখানে বিচারবহির্ভূত শাস্তির ঘটনা বারবার ঘটছে এবং এটি সমাজের একটি গভীর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এটি কেবল দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়, আঠারো থেকে উনিশ’শো শতাব্দীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত শহরগুলোয়ও এমন ঘটনা দেখা গিয়েছিল। এই সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো, যা প্রতিষ্ঠিত সরকারি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা থেকে অনেক দূরে ছিল, প্রায়ই আইনহীনতার কবলে পড়ত।
এই পরিস্থিতিতে, ‘ভিজিল্যান্স কমিটি’ বা সজাগ কমিটি গঠন করা হয়, যেখানে নাগরিকরা নিজেরাই শৃঙ্খলা বজায় রাখার এবং অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব নেয়, প্রায়শই বিচারবহির্ভূত উপায়ে। যা শুরু হয়েছিল কমিউনিটি পুলিশের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে, তা ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছিল নিছক প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপে, যেখানে যুক্তি বা ন্যায়বিচারের চেয়ে আবেগ প্রবণতা বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল।
মার্কিন ইতিহাসে মব জাস্টিস-এর সবচেয়ে কুখ্যাত উদাহরণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কু ক্লাক্স ক্লান (Ku Klux Klan) এর উত্থান, যা ছিল একটি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী সংগঠন, যারা গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আফ্রিকান আমেরিকানদের ওপর ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। কু ক্লাক্স ক্লান লিঞ্চিং এবং অন্যান্য ধরনের গণহিংসার আশ্রয় নেয়, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে, জাতিগত শ্রেণিবিন্যাস বা আধিপত্য বজায় রাখার জন্য।
উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত, হাজার হাজার আফ্রিকান আমেরিকানকে বিচার ছাড়াই গণপিটুনির মাধ্যমে হত্যা করা হয়—‘ন্যায়বিচার’-এর নামে এই নির্মম কাজগুলো সংঘটিত হতো। এসব সহিংসতার পেছনে সুরক্ষার ছল থাকলেও, আসলে এগুলো ছিল বর্ণগত নিপীড়ন ও সন্ত্রাস কায়েম করার হাতিয়ার।
মব জাস্টিস ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডার গণহত্যার মাধ্যমে সবচেয়ে বিধ্বংসী রূপে পুনরায় আবির্ভূত হয়ে এক কালো অধ্যায় রচনা করে। এই মর্মান্তিক অধ্যায়ে পুরো সম্প্রদায় একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, যা জাতিগত ঘৃণা ও ভয়ের দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিল।
এই গণহত্যার সূচনা হয়েছিল রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে, যা হুতু এবং তুতসি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনাকে আরও উসকে দেয়। সহিংসতা যখন তীব্র আকার ধারণ করে, তখন উন্মত্ত জনতা রাস্তায় নেমে আসে এবং প্রতিবেশীদের নির্মমভাবে হত্যা করতে শুরু করে, যা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জঘন্য ঢেউ সৃষ্টি করে। এটি প্রমাণ করে যে কীভাবে গণপিটুনি, ভয়, ভুল তথ্য এবং রাজনৈতিক ম্যানিপুলেশনের ফল দ্রুত ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে পরিণত হতে পারে।
রুয়ান্ডার ঘটনায়, কার্যকর সরকারি হস্তক্ষেপের অভাব এবং জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি মব জাস্টিস এবং নিয়ন্ত্রণহীন গণহত্যায় পরিণত করেছিল, যার ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে পুরো জাতি ও জনগণকে।
লিঞ্চিং এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সেইসব সমাজে ‘ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠার একটি উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা নিজেদের রাষ্ট্র কর্তৃক পরিত্যক্ত মনে করে। বাংলাদেশেও যেমনটি ঘটে, এখানে ভুল তথ্য এবং গুজব প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা দ্রুত সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিচার প্রক্রিয়া ছাড়াই ত্বরিত ও নির্মম শাস্তি কার্যকর করার চেষ্টা করে একটি উত্তেজিত জনতা।
মব সাইকোলজি হলো, ব্যক্তিরা যখন কোনো দলের অংশ হিসেবে থাকে, তখন তারা সাধারণত ভিন্নভাবে আচরণ করে, যা তাদের এককভাবে কাজ করার সময়ের আচরণের সঙ্গে বিপরীত হতে পারে। জনতার অংশ হিসেবে মানুষ ‘দায়িত্বের বিভাজন’ অনুভব করে, যার অর্থ হলো সহিংস কর্মকাণ্ডের জন্য অপরাধবোধ বা দায়িত্ব অনেক কম অনুভূত হয়, কারণ তা অনেকের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। যে ব্যক্তিগত বিবেক সাধারণত কাউকে সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়াতে বাধা দেয়, তা জনতার সম্মিলিত ইচ্ছার ছায়ায় ম্লান হয়ে যায়।
মব জাস্টিস-এর কারণে ব্যক্তিগত স্তরে, নির্দোষ প্রাণ হারায়, পরিবারগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সমাজের মধ্যে ভয়ের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। সামাজিক স্তরে, মব জাস্টিস আইনের শাসনকে দুর্বল করে, আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট করে এবং সহিংসতার একটি সংস্কৃতি সৃষ্টি করে যা ক্রমাগত চলতে থাকে।
মব জাস্টিস-এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুতর অধিকার লঙ্ঘনের একটি হলো মানবাধিকারের চরম অবমাননা। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা মব জাস্টিস এর মাধ্যমে নিয়মিত লঙ্ঘিত হয়: ন্যায়সঙ্গত বিচারের অধিকার (অনুচ্ছেদ ১০) এবং প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ থাকার অধিকার (অনুচ্ছেদ ১১)। মব জাস্টিস এই সুরক্ষাগুলোর কোনোটিকেই সম্মান করে না; বরং অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আইনগত প্রতিরক্ষার সমস্ত সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে, তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ না দিয়ে নির্মম শাস্তি প্রদান করে।
মব জাস্টিস-এর স্থায়িত্ব আমাদের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচারব্যবস্থা এবং পুরো সমাজের ভূমিকা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে। এই সমস্যার সমাধান করার জন্য প্রথমে মিথ্যা তথ্যের বিস্তার বন্ধ করতে হবে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
মানুষকে যাচাইবিহীন তথ্য ছড়ানোর বিপদ সম্পর্কে সচেতন করতে জনসচেতনতা কর্মসূচি চালু করা জরুরি, যা প্রায়ই মব জাস্টিস এর সহিংসতা উসকে দেয়। তাছাড়া, সমাজের মধ্যে সংলাপ এবং বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য জায়গা তৈরি করা যেতে পারে, যা উত্তেজনা সহিংসতায় পরিণত হওয়ার আগেই থামাতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে, সমাজ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচারব্যবস্থার মধ্যে আস্থা তৈরি করাই মব জাস্টিস-এর মতো সমস্যার সমাধানের মূল চাবিকাঠি।
একাডেমিক ভাষায়, ন্যায়বিচার বলতে আমরা ‘ন্যায়সঙ্গত প্রক্রিয়া’ (due process), ‘দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ থাকার ধারণা’ (the presumption of innocence) এবং ‘আইনের শাসন’ (the rule of law) এর কথা বলি।
এগুলো কেবল আইনগত ধারণা নয়, সমাজের জনগণের কাছে করা প্রতিশ্রুতি—এমন প্রতিশ্রুতি যে তারা সুরক্ষিত থাকবে, তাদের অধিকার সংরক্ষিত হবে এবং কোনো ব্যক্তিকে ন্যায়বিচার ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার বাইরে বিচার করা হবে না কিন্তু বাংলাদেশে, যেখানে এই প্রতিশ্রুতির ওপর থেকে মানুষের বিশ্বাস ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে, সেখানে অসংখ্য মানুষ তাদের শেষ মুহূর্ত কাটিয়েছে আদালতের পরিবর্তে জনতার হাতের আঘাতে। গণপিটুনি ন্যায়বিচার বা সমাধান কিছুই দেয় না। এটি দ্রুত হতে পারে, কিন্তু এটি অন্ধ—তথ্য বা সত্য নয়, বরং আবেগ, ভয় এবং প্রতিশোধ দ্বারা চালিত।
মব জাস্টিস-এর ভুক্তভোগীরা কেবল পরিসংখ্যান নয়; তারা ছিলেন কারও মা, বাবা পুত্র-কন্যারা—তাদের একটি মানবিক জীবন ছিল, যাদের একমাত্র ‘অপরাধ’ ছিল গণ-উন্মাদনার সহিংস ঝড়ে ধরা পড়া। তাদের মৃত্যু নিষ্ঠুর ও অকারণ, সমাজের বিবেকের ওপর এক অমোচনীয় দাগ, যেখানে ভয় এবং ভুল তথ্য যুক্তি ও মানবতার ওপর বিজয়ী হয়েছে। প্রত্যেকটি গণপিটুনির ঘটনা শুধু মানবাধিকারের লঙ্ঘন নয়, এটি আমাদের সম্মিলিত মানবতার চরম ব্যর্থতা।
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে, আমাদের কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে হবে: যত গভীরই হোক না কেন তাৎক্ষণিক ন্যায়বিচারের প্রতি আমাদের আকাঙ্ক্ষা, কোনোভাবেই নির্দোষের রক্তপাতকে ন্যায়সঙ্গত করা যায় না। সামনের পথ সহজ নয়, কিন্তু স্পষ্ট। বাংলাদেশকে তার আইনি প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করতে হবে, দুর্নীতি ও অদক্ষতাকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে, যাতে মানুষ আবারও জনতার পরিবর্তে আদালতের প্রতি আস্থা রাখতে পারে।
মাইশা তাবাসসুম অনিমা ।। প্রভাষক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়