দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব সংস্থায় ব্যাপক রদবদল করে। নির্বাচন কমিশনেও আসে রদবদল। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ পুরো কমিশন পদত্যাগ করেন। এরপর ইসির গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পরিবর্তন আনা হয়। অভিযোগ উঠেছে, এই রদবদলে বিএনপিপন্থি এক কর্মকর্তা দলীয় প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছেন। তার মতামতের বাইরে গিয়ে কোনো পদায়ন বা বদলি করা যাচ্ছে না। ফলে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বহু ইসি কর্মকর্তা।
দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব সংস্থায় ব্যাপক রদবদল করে। নির্বাচন কমিশনেও আসে রদবদল। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ পুরো কমিশন পদত্যাগ করেন। এরপর ইসির গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পরিবর্তন আনা হয়। অভিযোগ উঠেছে, এই রদবদলে বিএনপিপন্থি এক কর্মকর্তা দলীয় প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছেন। তার মতামতের বাইরে গিয়ে কোনো পদায়ন বা বদলি করা যাচ্ছে না। ফলে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বহু ইসি কর্মকর্তা।
অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের উপ-সচিব মো. মনির হোসেন। তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তারকে দিয়ে পদোন্নতির জন্য ইসি সচিব শফিউল আজিমকে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিধিবহির্ভূত হওয়ায় সচিব তা প্রত্যাখ্যান করেন বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসি কর্মকর্তারা বলেন, বিএনপির প্রেসক্রিপশনেই এখন বদলি ও পদায়ন হচ্ছে নির্বাচন কমিশনে (ইসি)। বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের মাধ্যমে ইসি সচিব শফিউল আজিমকে ফোন দিয়ে এসব করানো হচ্ছে। চাপে পড়ে বিএনপি সিন্ডিকেটের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হচ্ছেন সচিব।
তারা আরও অভিযোগ করেন, নির্বাচন কমিশনের দীর্ঘদিনের সিস্টেমকে নষ্ট করে ফেলছে এই গ্রুপ। তারা তদবির করে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো বাগিয়ে নিচ্ছে। ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা ভালো ভালো পদ পাচ্ছে। যা অতীতে কখনোই ছিল না। বর্তমানে নিয়ম অনুযায়ী কোনো পদায়ন বা বদলির আদেশ হচ্ছে না। এর ফলে আগে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তা ও তালিকায় আগে থাকা কর্মকর্তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয় ও মাঠ পর্যায়ের পদায়নে বৈষম্যের অভিযোগ করে সংস্থাটির কর্মকর্তারা ইসি সচিব শফিউল আজিমের কাছে একটি চিঠি দিয়েছেন। ওই চিঠিতে ইতোমধ্যে পদোন্নতিপ্রাপ্তদের যথাযথ স্থানে পদায়নের দাবি জানান তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একাধিক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর নির্বাচন কমিশনে যেভাবে জ্যেষ্ঠতা না মেনে বদলি-পদায়ন হয়েছে, অতীতে এভাবে কখনো হয়নি। এগুলো খারাপ দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এ নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপ-সচিব মো. মনির হোসেন। সরকার পরিবর্তনের পর তিনিই সচিবকে বলেছেন, বিএনপির পক্ষ থেকে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তারের রেফারেন্সে সচিবকে চাপ প্রয়োগ করেন তিনি। আব্দুস সাত্তার নিজেও সচিবকে ফোন দিয়ে মনির হোসেনের পক্ষে নির্দেশনা দেন।
এ বিষয়ে এ বি এম আব্দুস সাত্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ এবং অপপ্রচার। আমার হস্তক্ষেপের প্রশ্নই আসে না। আমি অলরেডি সচিবকে বলেছি, চাইলে আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমি সচিবকে বলেছি, তার (মনির হোসেন) কোনো সুপারিশ যেন আর বিবেচনায় না নেওয়া হয়। আমাদের কথা বললে আর আমলে নেবেন না বরং আমাকে জানাবেন।’
তিনি বলেন, ‘আগে যে বদলিগুলো হয়েছে, সেগুলো আমি জানি না বা বুঝতেও পারিনি। হয়ত আমার নাম ভাঙানো হয়েছে এবং আমি জানতে পারার সাথে সাথেই সচিবকে বলে দিয়েছি। প্রয়োজনে ওকেই (মনির হোসেন) সরিয়ে দেওয়া হবে। আমি সচিবকে সতর্ক করে দিয়েছি। আমার কথা বলে কেউ পুরো নির্বাচন কমিশন নিয়ন্ত্রণ করবে, এটা আমি সহ্য করব না।’
আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘অবৈধ নির্বাচনের সময় যারা আওয়ামী দোসরদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে এবং যারা আওয়ামী লীগের সময় সুবিধা পেয়েছে তাদের সুবিধা পাওয়ার এখন নৈতিক অধিকার নেই। আমাদের দাবি যারা আওয়ামী লীগের সময় অপরাধ এবং অন্যায় করেছে, তাদের শাস্তি পেতে হবে। সেটা যেকোনো ধরনের শাস্তি হতে পারে। এটাই আমাদের নীতি।’
বেগম জিয়ার একান্ত সচিব বলেন, ‘আমাদের একটা দাবি ছিল এবং আছে। জনপ্রশাসনসহ অন্যান্য দপ্তরগুলোর শীর্ষ পদে যারা আছেন, যারা বিগত নির্বাচনে দোসর ছিলেন, তাদের আমরা দেখতে চাই না। শীর্ষ পদে দেখতে চাই না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একাধিক জেলা নির্বাচন অফিসার, উপ-সচিব ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মনির হোসেন ছিলেন রাঙ্গামাটির সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে এ বি এম আব্দুস সাত্তারের মাধ্যমে তদবির করে বদলি হয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে নির্বাচন পরিচালনা-২ শাখার উপসচিবের পদ দখল করেন তিনি। এরপর বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়কও হন নিজের ইচ্ছায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা জানান, সচিবালয়ে বদলি হয়েই মোহাম্মদ মনির হোসেন গোপনে ২৪ জন অফিসারকে টপকে জোর করে যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতির ফাইল তোলেন। কিন্তু ইসি সচিবের কাছে গিয়ে তা আটকে যায়। কারণ, ইসি কর্মকর্তাদের উপ-সচিব হওয়ার পর আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা হতে হয়। তারপরই কেবল যুগ্ম-সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেতে পারেন। কিন্তু তিনি উপ-সচিব থেকে সরাসরি যুগ্ম-সচিব হতে চেয়েছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী, পদোন্নতি না চাওয়ায় সচিব তার ফাইল ফেরত পাঠিয়ে দেন।
এছাড়া সুপারনিউমারারি পদে ষষ্ঠ গ্রেডে জেলা ও অতিরিক্ত জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এবং অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ৩১ জন, পঞ্চম গ্রেডে সিনিয়র জেলা ও পরিচালক সমমান পদে ২৮ জন এবং চতুর্থ গ্রেডে আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির ফাইল আউয়াল কমিশন অনুমোদন করে গেলেও তা আটকে দেন উপ-সচিব মো. মনির হোসেন। ওই ফাইলে জুনিয়র আরও ৩০০ অফিসার যুক্ত করে পদোন্নতির জন্য জনপ্রশাসনের কাছে পাঠান। যা আজও জনপ্রশাসনে পড়ে আছে।
উপ-সচিব মনির হোসেনের প্রভাব বিস্তার প্রসঙ্গে ইসি সচিব শফিউল আজিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর একরকম পরিস্থিতি ছিল। আমি খুব কনফিডেন্টলি বলতে পারি, এগুলো যে বা যারা করতে চেয়েছিল এবং যাদের তিনি (মনির হোসেন) ইউজ (ব্যবহার) করতে চেয়েছিলেন বিষয়টি তাদেরও নজরে এসেছে। ওনাদের নলেজে গেছে। কিছু কিছু বিষয়ে তাদের সহকর্মীরাই মনে হয় তার (মনির হোসেন) উপর বিরক্ত। এখন আর সেই দিন নেই। সে সময় তো (৫ আগস্টের পর) সব জায়গায় অন্যরকম পরিস্থিতি ছিল। ওদের (মনির হোসেন) সহকর্মীদের মধ্যে অ্যাসোসিয়েশনের বিষয়ে বিরোধ ছিল। একটা অ্যাসোসিয়েশন হলেও কিন্তু গণতান্ত্রিকভাবে হতে হয়। গায়ের জোরে বা আরকজনের শক্তিতে বেশিক্ষণ নেতাগিরি করতে পারবেন না। আমার মনে হয়, এটা ওর (মনির হোসেন) রিয়েলাইজেশনে আসবে।’
চাপ প্রয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ওইভাবে চাপে পড়লে তো ৫ থেকে ৬ আগস্টের মধ্যে ও (মনির হোসেন) যেভাবে ওইখানে (যুগ্ম-সচিব) আসতে চেয়েছিল, সেটা তো হয়ে যেত। যারা আমাকে বলেছিল (মনির হোসেনের যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতি দিতে যারা তদবির করেন) তারাও জানতেন না, তার আরেকটা সিনিয়র ব্যাচ আছে। তারা (মনির হোসেন) ২০০৫ সালের ব্যাচ। কিন্তু তিনি (মনির হোসেন) ২০০৪ রেখেই পদোন্নতি চেয়েছিলেন। ও (মনির হোসেন) যাদের দিয়ে বলিয়েছিল তারাও বিষয়টি জানার পর বিব্রত হয়েছেন। আমাকে সহ্য করতে হয়েছিল এবং ধৈর্য সহকারে তাদের বোঝাতে হয়েছে।’
সচিব বলেন, ‘ওনার (আব্দুস সাত্তার) সাথে আমার দু’একবার কথা হয়েছে। স্যার আমাকে বলেছেন, আমরা অনেক ইনফরমেশন জানি না, তাই তোমার যেটা ভালো মনে হবে সেটাই করো। মনির ভুল করেছে, ও আস্থা হারিয়েছে। সে সহকর্মীদের আস্থাও হারিয়েছে আবার আপনি যাদের কথা (আব্দুস সাত্তার) বললেন, তাদের আস্থাও হারিয়েছে। সে তাদের গিয়ে বলেছে, আমি যুগ্ম-সচিব হওয়ার যোগ্য। কিন্তু তার আগে একটা ব্যাচ যে আছে সেটা বলেনি। সাত্তার স্যার পরে বুঝতে পেরেছেন মনিরের কথার মধ্যে ঘাপলা আছে।’
বদলি পদায়নে অর্থ চাওয়া হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে– এ প্রসঙ্গে কী বলবেন? জবাবে সচিব বলেন, ‘আমি আপনাকে একটা চিঠি দেখাতে পারি। এরা পাগল হয়ে গেছে। এটা করে মনে করছে তারা লাখ লাখ টাকা কামাবে। আমরা তো বুঝতে পারি কে কেমন। আমার উপরে ভর করে পয়সা কামাবে, আমি এটা হতে দেব না। একটা গ্রুপ অস্থির হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবে তারা টাকা-পয়সা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে।’
সচিব বলেন, ‘ও (মনির) যেই জায়গাটা ব্যবহার করত এবং যেখান থেকে শক্তি আহরণ করত, সে জায়গাটা কেটে গেছে। সে ওখান থেকে ডিসকানেক্ট হয়ে গেছে। তার এই বাড়াবাড়িগুলো তাদের কাছে পৌঁছে গেছে।’
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিএনপি থেকে এ ধরনের কোনো কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। যেহেতু আমাদের অগোচরে এটা হয়েছে, সেহেতু নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তার উচিত ছিল এটা বিএনপির সেন্ট্রাল কমান্ডকে জানানো। তারা না জানিয়ে বিষয়টা ভালো করেনি। সুতরাং আমি মনে করি, এ ধরনের নাম ভাঙানোর কাজে যারা আছে, তাদের কোনোরকম প্রশ্রয় না দিয়ে বরং তারা যেটা বলবে তার উল্টোটা করে দেখিয়ে দেওয়া। আমরা এ ধরনের অভিযোগে বিব্রত। জনগণের যে অফুরন্ত ভালোবাসা বিএনপির প্রতি আছে, ওইটাই তো আমাদের পুঁজি। দুইজন, পাঁচজন কর্মকর্তাকে আমরা দায়িত্ব দিতে যাব, এত পাগল নাকি আমরা। প্রয়োজনে আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলতে পারি।’
এসআর/এসকেডি