‘মরার আগে জানতে চাই ছেলেটা জীবিত আছে নাকি মেরে ফেলা হয়েছে’

‘মরার আগে জানতে চাই ছেলেটা জীবিত আছে নাকি মেরে ফেলা হয়েছে’

২০১৫ সালের ১৭ মার্চ। সকাল সাড়ে আটটায় ফকিরাপুলের ২৯১ নম্বর ভাড়া বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে মাজহারুল ইসলাম রুবেল নামের ব্যবসায়ীকে আটক করেন ৭-৮ জন মানুষ। সঙ্গে সঙ্গেই সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যান। ঘটনার আকস্মিকতায় পরিবারের সদস্যরা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। শান্ত স্বভাবের রুবেল কী অপরাধ করেছে সে বিষয়ে তাদের কাছে জানতে চান সবাই। কিন্তু সন্তোষজনক কোনো জবাব কিংবা ওয়ারেন্ট না দেখিয়েই নিয়ে যান তারা।

২০১৫ সালের ১৭ মার্চ। সকাল সাড়ে আটটায় ফকিরাপুলের ২৯১ নম্বর ভাড়া বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে মাজহারুল ইসলাম রুবেল নামের ব্যবসায়ীকে আটক করেন ৭-৮ জন মানুষ। সঙ্গে সঙ্গেই সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যান। ঘটনার আকস্মিকতায় পরিবারের সদস্যরা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। শান্ত স্বভাবের রুবেল কী অপরাধ করেছে সে বিষয়ে তাদের কাছে জানতে চান সবাই। কিন্তু সন্তোষজনক কোনো জবাব কিংবা ওয়ারেন্ট না দেখিয়েই নিয়ে যান তারা।

এরপর থেকে শুরু হয় পরিবারের সদস্যদের দৌড়ঝাঁপ। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আজ পর্যন্ত আর সন্ধান মেলেনি রুবেলের। তবে সবাই হাল ছেড়ে দিলেও এখনও হাল ছাড়েননি মা রহিমা। দীর্ঘ ৯ বছর ধরে প্রিয় সন্তানের সন্ধানে ঘুরছেন থানা, কারাগার, কোর্ট, ডিবি অফিস, র‍্যাব-১, র‍্যাব- ৩, র‍্যাব সদরদপ্তরে। কিন্তু রুবেলের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

তবুও আশাবাদী রহিমা। হয়ত প্রিয় ছেলেকে ফিরে পাবেন এমন আশায় রুবেলের ছবি বুকে জড়িয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। তিনি বলেন, ‘ আর কোনো ইচ্ছা নাই। আর কিছু বলার নাই। মরার আগে জানতে চাই গুমের শিকার ছেলেটা জীবিত আছে নাকি মেরে ফেলা হয়েছে।’

অবশ্য এমন দাবি শুধু রহিমার নয়, সারাদেশ থেকে গুম হওয়া ৫০ জনের বেশি মানুষের স্বজনরা প্রিয়জনের সন্ধান চেয়ে আজ সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

এতে বক্তব্য দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন রুবেলের মা রহিমা। তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে আমার ব্যবসায়ী ছেলেকে সাদা রঙের  গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা গাড়ির নম্বরও রেখে দিছি। তার সন্ধানে মিন্টু রোডে গেছি (ডিবি কার্যালয়ে)। এখন পর্যন্ত কত জায়গায় গেছি তার হিসাব নাই। আমি আজকে নয় বছর সন্তান হারা। আমি কি আমার সন্তানের মুখ আর দেখতে পারবো না? আমি সরকারের কাছে আবেদন জানাই দ্রুত তাদেরকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেন। আমরা আর কত কাঁদবো? কাঁদতে কাঁদতে আমাদের জীবন শেষ।’

তিনি আরও বলেন, ‘রুবেলের দুইটা সন্তান ছিল। একটা সন্তান মারা গেছে। আরেকটা সন্তানও সারা দিন বাবার জন্য কান্নাকাটি করে। আমরা এখন গ্রামের বাড়ি (কুমিল্লা) চলে গেছি। আমি একজন অসুস্থ মানুষ। তারপরও ওখান থেকে ছুটে চলে আসি। আপনারা সবাই দোয়া করবেন। যাদের সন্তান গুম হইছে তাদের মুখে যেন মৃত্যুর আগে অন্তত হাসি ফোটে।’

গুমের শিকার বাবার সন্ধানে আসা মেয়ে সুরাইয়া আক্তার বলেন, আমার বাবার নাম মো. মোস্তফা। তিনি দোকানদার ছিলেন। মিরপুরের ভাষানটেক এলাকা থেকে ২০২০ সালের ৬ জুন তাকে তুলে নেওয়া হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে হায়েস গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। পরে আমরা জিডি এবং মামলা করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো লাভ হয়নি। পরিবারের সবাই দিশেহারা। আমার মা কাঁদতে কাঁদতে দিশেহারা। আমি আমার বাবার সন্ধান চাই।

বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে এমন অভিযোগে কুড়িল থেকে ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ গুমের শিকার হন মো. সুজন। এরপর থেকে তার স্ত্রী নাজমা আক্তার দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন স্বামীর সন্ধানে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আর খোঁঁজ মেলেনি তার। নাজমা আক্তার বলেন, আমার একটা সন্তান নিয়ে আমি খারাপ অবস্থার মধ্যে রয়েছে। ২০১৯ সালে সাদা পোশাকে আমার স্বামীকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। তখন স্বামীর সন্ধান চেয়ে থানায় জিডি ও মামলা করতে চেয়েছিলাম। একটা সংবাদ সম্মেলন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোন কিছুই করতে দেওয়া হয়নি। আমার ছোট্ট ছেলেটি এখন বড় হয়েছে। সারাক্ষণ বাবার জন্য কান্নাকাটি করে। আমি কোথায় যাব কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না।

নাজমা বেগমের পাশেই বাবার ছবি নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে ছেলে হৃদয়কেও। বাবা হারানোর বেদনায় অল্প বয়সেই শোকে পাথর হয়েছে শিশুটি।

রাস্তায় চোখের সামনে নিজের স্বামীকে গুম হতে দেখে এমন আরেক ভোক্তভোগী বলেন, আমি চট্টগ্রাম থেকে এসেছি। আমার স্বামীর নাম কামরুল ইসলাম। ২০১৬ সালের ২২ জন চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানাধীন এলাকা থেকে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। ডিবি পরিচয় তাকে ধরা হয়েছিল। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত তার সন্ধান আর পাইনি।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত স্বজনরা গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে বর্তমান সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিও জানান।

এ সময় স্বজনহারা সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে ৮ দফা দাবিও তুলে ধরা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে —

৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গুম ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের ফেরত দিতে হবে; প্রতিটি সেল (আয়না ঘর) বর্তমান গুম কমিশনের দায়িত্বশীলদের দেখতে দিতে হবে; যাদেরকে খুন করা হয়েছে তাদের পরিবারকে সনদ দিতে হবে; প্রতিটি নিখোঁজ পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে; স্বাধীন বাংলাদেশ কোনো প্রকার আয়না ঘর থাকতে পারবে না; আয়নাঘর এবং সব টর্চার সেল ভেঙে ফেলতে হবে; প্রশাসন কালো কাচের গাড়ি ব্যবহার করতে পারবে না; সব থানাতে মামলা নিতে হবে; গুম-খুনে জড়িত সকলকে আইনের আওতায় আনতে হবে; এবং আলোচিত সাত খুনে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।

আরএইচটি/এমএ

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *