বাজার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেই, দাম শুনেই কপালে ওঠে চোখ

বাজার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেই, দাম শুনেই কপালে ওঠে চোখ

টেলিভিশনের পর্দায় ইলিশ রপ্তানির সংবাদ নজরে আসে খাদেমুল ইসলামের। সঙ্গে ইলিশ নিয়ে বর্তমান সরকারের উপদেষ্টাদের ইতিবাচক মন্তব্যও চোখে পড়ে। এতে উৎসাহিত হয়ে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাজারে আসেন তিনি; ইচ্ছা- একটা ইলিশ কিনবেন। কিন্তু ইলিশ কিনতে এসে দাম শুনেই চোখ কপালে ওঠে তার।

টেলিভিশনের পর্দায় ইলিশ রপ্তানির সংবাদ নজরে আসে খাদেমুল ইসলামের। সঙ্গে ইলিশ নিয়ে বর্তমান সরকারের উপদেষ্টাদের ইতিবাচক মন্তব্যও চোখে পড়ে। এতে উৎসাহিত হয়ে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাজারে আসেন তিনি; ইচ্ছা- একটা ইলিশ কিনবেন। কিন্তু ইলিশ কিনতে এসে দাম শুনেই চোখ কপালে ওঠে তার।

খাদেমুল ইসলাম পেশায় নির্মাণশ্রমিক। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন মৌসুমে ভ্যানে করে ফল বিক্রি করেন। কয়েক দিন আগে মহল্লার চায়ের দোকানে টেলিভিশনে ইলিশ নিয়ে ইতিবাচক সংবাদে খুশি হয়ে মাছের বাজারে এসেছিলেন। দাম শুনেই চুপসে যান তিনি।

একই অবস্থার কথা বললেন কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক আতিকুর রহমান। আশা নিয়ে বাজারে এসে তিনিও ইলিশের দামের সাথে পেরে উঠলেন না। লাগামহীন এই বাজারে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে ইলিশ যেন এখন সোনার হরিণ।

বুধবার (৯ অক্টোবর) রংপুর সিটি বাজার, স্টেশন বাজার ও শাপলা চত্বর বাজার এবং মাছের সবচেয়ে বড় আড়তসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে চড়া প্রায় সব ধরনের মাছের দাম। সপ্তাহ ব্যবধানে কেজিপ্রতি বেড়েছে ৫০-১৫০ টাকা।

তবে সব ধরনের মাছের তুলনায় ইলিশই সবচেয়ে বেশি দামি। দেড় কেজি ওজনের একেকটি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২৯০০-৩২০০ টাকায়। এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৬০০-১৮০০ টাকায়। আর ৭০০-৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১৪০০-১৬০০ টাকা কেজি এবং ৪০০-৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের জন্য কেজিতে গুনতে হচ্ছে ৮০০-১১০০ টাকা।

ইলিশ নিয়ে ভোক্তাদের যত আক্ষেপ

বেশির ভাগ ভোক্তা বলছেন, ইলিশ এখন শুধুই একশ্রেণির মানুষের খাবার হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের জন্য ইলিশ কেনা দুরূহ ব্যাপার। দাম জিজ্ঞেস করা তো দূরের কথা, এখন ইলিশ ছুঁয়ে দেখতেও ভয় লাগে। তাদের অভিযোগ, বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় দিন দিন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ইলিশ।

রংপুর সিটি বাজারে কথা হয় খাদেমুল ইসলামের সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় জানতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, খুব শখ করে ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু বাজারে এসে দেখি কোথাও স্বস্তি নেই, টিভিতে খবর দেখেই যা স্বস্তি। রুপালি ইলিশ যেন দেখেই শান্তি। দাম শুনে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতেও ভয় লাগে। মাছের বাজার আগে থেকেই অস্থির। দাম কমার কোনো নাম নেই। এই ঊর্ধ্বমুখী দামে সবাই নাজেহাল। অথচ বাজার নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ নেই।

ইলিশ কিনতে এসে দামের কারণে কিনতে পারেননি একজন ক্রেতা। পরবর্তীতে তিনি দুই কেজি পাঙাস মাছ কিনেছেন, আর তার অসুস্থ মায়ের জন্য নিয়েছেন এক কেজি ছোট মাছ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা যা শুনি বাস্তবে তা নয়। বাজারে কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণে নেই। শখ করে একটা ইলিশ কিনে খাওয়ার আগে বারবার হিসেব করতে হয়। এক কেজি ইলিশ কিনলে অন্যান্য খরচের জন্য পকেটে আর টাকা থাকে না। ইলিশ খেতে মন চাইলেও দামের কাছে আমরা অসহায়। ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ হলেও খাবারের প্লেটে আমাদের মতো মানুষের জন্য এটি দুর্লভ। আগে জানতাম মাছে-ভাতে বাঙালি। কিন্তু এখন সাধারণ মানুষের পাতে মাছ ওঠাই দুষ্কর।

‘আড়ত সিন্ডিকেট’ ভাঙার দাবি ব্যবসায়ীদের

ইলিশেরেউচ্চ দামে অখুশি নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চমধ্যবিত্ত সবাই। তাদের অভিযোগ, বাজারে পর্যাপ্ত ইলিশ মাছ থাকলেও সংকটের কথা বলে কারসাজি করছেন ব্যবসায়ীরা। তবে মাছ ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতে ইলিশ রপ্তানি ও এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ইলিশ ধরা বন্ধকে কেন্দ্র করে মজুত শুরু করেছেন আড়তদাররা। এজন্য ইলিশের দাম কমছে না।

সিটি বাজারের মাছ ব্যবসায়ী আকবর আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেকে এখন ইলিশ মজুত করা শুরু করেছেন। সামনে দুর্গাপূজা, আর আগামী কয়েক দিন পর থেকে নদী থেকে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। মাছটি মজুতের প্রবণতা শুরু হওয়ায় বাজারে এর সরবরাহ কমায় দাম বাড়ছে। তাছাড়া এখন তো আর মাছ নষ্ট হয় না, এ কারণে বড় বড় আড়তদাররা বিভিন্ন অযুহাতে ইলিশ মজুত করে রাখতে পারে। তারাই আবার ইচ্ছেমতো বাজারে দাম বাড়িয়ে সরবরাহ করে।

৩৪ বছর ধরে মাছের ব্যবসা করছেন লুৎফর রহমান। তিনি নিজেও ইলিশের এমন ‘চড়া দামে হতাশ’ বলে দাবি করেন। ঢাকা পোস্টকে এই ব্যবসায়ী বলেন, ইলিশের দাম হু হু করে বাড়ছে। বছর তিন-চারেক আগেও প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন মণ ইলিশ মাছ বিক্রি করতাম। এখন সেখানে এক মণ ইলিশও বিক্রি হয় না। দাম বেশি হওয়ায় সাধারণ ক্রেতারা দিন দিন ইলিশ বিমুখ হচ্ছেন। এক ঘণ্টায় অন্তত ৬০-৭০ জন ক্রেতা দাম শুনেছেন, কিন্তু মাছ কিনেছেন মাত্র দুজন। আগের মতো ব্যবসা নেই।

তিনি আরও বলেন, এক সপ্তাহ আগে যে ইলিশ ১৫০০-১৬০০ টাকা কেজি বিক্রি করেছি আজ তা ১৮০০ টাকার কমে বিক্রি করলে লোকসান হবে। সরকারের হিসাবে যতই উৎপাদন বাড়ুক আর বাজারে সরবরাহ বাড়ুক আগে আড়তে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। একটা সময় মাইকিং করে আমরা ইলিশ বিক্রি করেছি। বিক্রি না হলে মাটিচাপা দিয়ে রাখতাম। আর এখন উন্নত সংরক্ষণ ব্যবস্থার কারণে ইলিশের মজুত বাড়লেও দাম কমছে না। এখন আর বাজার মনিটরিং করেও কোনো কাজ হয় না। কারণ আমরা বেশি দামে কিনে তো লোকসানে বিক্রি করি না। এজন্য ধরলে জায়গামতো ধরতে হবে নয়ত ইলিশ নিয়ে সরকারের চিন্তাভাবনা সফল হবে না।

ইলিশের দাম নিয়ে আক্ষেপ আর দুর্বল বাজার মনিটরিং নিয়ে অভিযোগ শুধু রংপুরেই নয়। দেশের সব জেলাতে ওই একই চিত্র। ক্রেতা-বিক্রেতা থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ী ও সচেতন মহলেরও প্রশ্ন- মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে পরিমাণ বাড়লেও বাজারে ইলিশ কেন কম আসছে, এত ইলিশ যাচ্ছে কোথায়।

ব্রহ্মপুত্রে ইলিশ মিললেও পাতে উঠছে না সাধারণ মানুষের

কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নের নওয়াবস এলাকার আবু সাঈদ বলেন, ‘আমি একজন ছোট ব্যবসায়ী। ব্যবসা করেই কোনোরকমে সংসার চালাই। ইলিশ মাছের কথা কী বলব, অনেক দিন ইলিশ খাই না। ইলিশ মাছের যে দাম, আমার মতো মানুষের পক্ষে কেনা সম্ভব না। সত্যি কথা বলতে ২০-২১ বছর হবে ইলিশ কিনিও নাই, খাইও নাই। মাঝেমধ্যে শুনি কুড়িগ্রামের বিভিন্ন নদ-নদীতে ইলিশ ধরা পড়ে। এ মাছ কারা কেনে, কই যায় আমার জানা নেই।’

ওই ইউনিয়নের মাছ বিক্রেতা বিরু মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি বাজারে মাছের ব্যবসা করছি কমপক্ষে ২০ বছর। এতদিনে কোনোদিনও ইলিশ মাছ কেনা-বেচা করি নাই। কারণ ইলিশের অনেক দাম, এলাকার মানুষ কিনতে পারে না। অন্যান্য মাছই কিনতে পারে না, আর তো ইলিশ।’

উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের জেলে বাবু মিয়া বলেন, ‘আমাদের ব্রহ্মপুত্র নদে গত ১০-১১ বছর ধরে ইলিশ মাছ ধরা পড়ে। তখন থেকে মৌসুম এলেই মাছ ধরি। ইলিশ মাছ ধরার সময়টার জন্য একটা বছর অপেক্ষা করি। তখন কিছু টাকা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘যখন ইলিশ ধরি তখন আমাদের এখানে বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন এসে মাছ কিনে প্যাকেট করে নিয়ে যায়। আমাদেরও ঋণ ও কিস্তি আছে, তা পরিশোধ করি ইলিশ বিক্রি করে। মাছ না ধরার জন্য যে সরকার কিছু চাল দেয়, তা দিয়ে কি আমাদের ৭-৮ জন সদস্যের সংসার চলে? তাছাড়া যারা জেলে তারা তো সবাই সরকারের চাল পায় না, মেম্বার-চেয়ারম্যানের লোকজন সে চাল পায়।’

স্থানীয় কবি ও সাংবাদিক বাদশাহ সৈকত ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা গত পাঁচ বছর আগে শুনতে পেলাম কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে। সেসময় এখানকার মানুষ ৩০০-৪০০ টাকা কেজি দরে কিনে খেয়েছে। তারপর থেকে নদ-নদীতে ইলিশ আসে কি না তা আর জানে না এ অঞ্চলের মানুষ।

তিনি আরও বলেন, যখন ইলিশ ডিম দেওয়ার জন্য আসছে তখন জেলেরা ধরছে। আর স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মাছগুলো কিনে ডিপ ফ্রিজে সংরক্ষণ করে রাখছে। পরে তারা সুযোগমতো বেশি দামে বিক্রি করছে। এখানে ধরা পড়লেও এখানকার মানুষ কম দামে ইলিশ কিনে খেতে পারছে না। বর্তমানে কুড়িগ্রামে ছোট ইলিশ ৭০০ টাকা কেজি আর এক কেজির উপরে যেগুলো ১৫০০ টাকা কেজি। এ কারণেই এখানকার সাধারণ মানুষ ইলিশ কিনতে পারছে না।

রংপুরের বাজারে ইলিশের পাইকারি মূল্য

রংপুর মৎস্য আড়ত ও সিটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মাছ ব্যবসায়ীরা বাজারে আসা ইলিশ চারটি ভাগ বা ক্যাটাগরিতে বিক্রি করছেন। প্রথম ক্যাটাগরিতে রয়েছে সবচেয়ে বড় সাইজের মাছ। এসব মাছের ওজন ১ কেজি কিংবা এর কিছুটা বেশি, যার পাইকারি দাম ধরা হচ্ছে ১৫০০-১৬০০ টাকা কেজি। এসব মাছই একই বাজারে খুচরা ১৭০০-১৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে। এরপর রয়েছে মাঝারি আকৃতির ইলিশ, যার ওজন ৭০০-৯০০ গ্রাম। এসব মাছের পাইকারি দাম ধরা হচ্ছে ১০০০-১২০০ টাকা, যা পরবর্তীতে খুচরা বাজারে ১৪০০-১৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তৃতীয় ক্যাটাগরিতে আছে ৫০০-৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ। এগুলো পাইকারিতে সাড়ে ৬০০-৮০০ এবং খুচরায় ৯০০-১১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

চতুর্থ ক্যাটাগরিতে আছে জাটকা বা ছোট সাইজের (দেখতে কিছুটা পুরাতন) ইলিশ। এগুলো পাইকারিতে ৪০০-৫০০ টাকা কেজি এবং খুচরায় ৬০০-৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে। তবে ইলিশের রং, আকার-আকৃতি, তাজা ভাব বিবেচনায় দামের ক্ষেত্রে আরও কিছুটা তারতম্য দেখা গেছে। কেউ কেউ আবার বরিশাল, চাঁদপুর বা পদ্মার ইলিশের তকমা লাগিয়ে আরও বেশি দামে বিক্রি করছেন।

সাগর থেকে যেভাবে রংপুরের নদ-নদীতে মিলছে ইলিশ

ইলিশ মূলত লোনা পানির মাছ। এর আবাসস্থল সাগরে। তবে প্রজনন মৌসুমে ডিম ছাড়ার জন্য সাগর থেকে নদীতে চলে আসে। সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় পদ্মা নদীতে। এই নদী হয়ে মেঘনা থেকে যমুনা আর যমুনা থেকে ব্রহ্মপুত্রে আসে ইলিশ। এভাবেই রংপুর অঞ্চলের চার নদীতে ছড়িয়ে পড়েছে ইলিশ।

রংপুর অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমার ও তিস্তা নদীতে দিন দিন বাড়ছে ইলিশের উৎপাদন। গত তিন বছরে যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন। অথচ এক দশক আগেও এর পরিমাণ ছিল শূন্যের কোঠায়। সাগরের অভিজাত মাছ ইলিশ রংপুরের নদীতে মেলায় এ অঞ্চলের চাহিদা কিছুটা হলেও মেটাচ্ছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা, উলিপুর, নাগেশ্বরী, চিলমারী, রৌমারী, চর রাজিবপুর, গাইবান্ধা সদর, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ইলিশ আহরণ হয়। এই ১০ উপজেলার বাইরে বিচ্ছিন্নভাবে তিস্তা অববাহিকার রংপুরের গংগাচড়া, কাউনিয়া, নীলফামারীর ডালিয়া এবং লালমনিরহাটের কিছু এলাকায় দেখা মেলে ইলিশের। তবে ধরলা, দুধকুমার ও তিস্তা নদীতে ইলিশের দেখা মিললেও সিংহভাগই ধরা পড়ে ব্রহ্মপুত্রে।

এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় সহকারী পরিচালক মনজুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০২৩ সালে রংপুর অঞ্চলের চার নদীতে ইলিশ ধরা পড়ে ৩১৭ মেট্রিক টন। এর আগে ২০২২ সালে ৩২৪ এবং ২০২১ সালে ধরা পড়েছিল ৩৩২ মেট্রিক টন ইলিশ। এর মধ্যে গত বছর কুড়িগ্রামে ৩০৩ এবং গাইবান্ধায় ১৪ মেট্রিক টন ইলিশ ধরা পড়ে। চলতি মৌসুমে এ পরিমাণ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা মৎস্য বিভাগের।

তিনি আরও বলেন, প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সাগর থেকে নদীতে আসে। সেই ধারাবাহিকতায় সাগর থেকে পদ্মা নদী হয়ে মেঘনা ও যমুনা পাড়ি দিয়ে ব্রহ্মপুত্র ও তার শাখাগুলোতে আশ্রয় নেয় ইলিশ। প্রজনন মৌসুম শেষে আবার সেই পথে সাগরে ফিরে যায়। তবে ইলিশের উৎপাদন নানা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এরমধ্যে আবহাওয়া পরিস্থিতি, বৃষ্টিপাত ও নদীর পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ।

ইলিশের প্রজনন মৌসুমে জেলেদের পুনর্বাসনে নানা উদ্যোগের কথা তুলে মনজুরুল ইসলাম বলেন, মা ইলিশ সংরক্ষণে বিভিন্ন ভাগে সচেতনতামূলক কাজ করছে মৎস্য বিভাগ। গত কয়েক বছর ধরে রংপুর অঞ্চলের প্রধান নদ-নদীগুলোকে ইলিশের অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের কারণে এ অঞ্চলে ইলিশের আনাগোনা বেড়েছে। একইসঙ্গে মোবাইল কোর্ট চালিয়ে নিয়মিত কারেন্ট জাল নিধনসহ জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে এই অঞ্চলে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। শুধু তাই নয় প্রজনন মৌসুমে জেলেদের পুনর্বাসনও করা হচ্ছে।

বাজার নিয়ন্ত্রণে নেই কার্যকর পদক্ষেপ

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, জেলা-উপজেলা প্রশাসন ও মৎস্য অধিদপ্তরসহ বাজার তদারকিতে সরকার সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানই জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছেন না বলে মনে করছেন ক্রেতারা। এ কারণে অন্যান্য নিত্যপণ্যের মতো ইলিশের বাজারও সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। শুধু ইলিশ নিয়ে আলাদাভাবে বাজার মনিটরিংয়ে নেই তেমন কার্যকর পদক্ষেপ।

ইলিশের বাজার নিয়ন্ত্রণে কী করা যেতে পারে জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তর রংপুর বিভাগীয় সহকারী পরিচালক মনজুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ বা কোনো পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা মৎস্য বিভাগের কাজ না। আমরা জেলা-উপজেলা প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকারের অভিযানে তাদের সঙ্গে থেকে সহযোগিতা করি। মূলত সচেতনতা তৈরি করা, মাছের উৎপাদন বাড়ানো, জেলেদের পুনর্বাসনসহ অন্যান্য দিকগুলো নিয়ে মৎস্য বিভাগ কাজ করে আসছে। আলাদাভাবে ইলিশের বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করা বা মনিটরিং করার সুযোগ আমাদের হয়ে ওঠে না।

ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সরকারি উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রজনন মৌসুমে ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত নদীতে জাল ফেলা নিষেধ। এ সময় যাতে নদীতে কেউ জাল না ফেলেন সেজন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। মাছ ধরা বন্ধ থাকায় জেলেদের যাতে জীবিকা নির্বাহে সমস্যা না হয়, সেজন্য সরকারিভাবে রংপুর অঞ্চলের ১৩ হাজার জেলেকে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। আশা করছি, এতে করে জেলেরা মা ইলিশ ধরতে নদীতে যাবেন না। এ সময় জেলেদের সচেতনতার পাশাপাশি বাজার মনিটরিং ও নদীগুলোতে টহল জোরদার করা হবে। ফলে এবার ইলিশের উল্লেখযোগ্য উৎপাদন বাড়বে।

মৎস্য অধিদপ্তরের মতো ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরেও ইলিশ নিয়ে নেই আলাদা কোনো তথ্য। সরকারি এ দুটি প্রতিষ্ঠানে নেই রংপুর অঞ্চলে ইলিশের চাহিদা ও কেনা-বেচা এবং বাজার মনিটরিংয়ের তেমন তথ্যসমৃদ্ধ পরিসংখ্যান। তবে এ অঞ্চলে চার নদ-নদীতে ইলিশের উৎপাদন ঘিরে আশার আলো দেখছেন তারা।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় সহকারী পরিচালক আফসানা পারভীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়। তবে ইলিশ নিয়ে আলাদাভাবে বাজার মনিটরিং করা, কাউকে জরিমানা করা কিংবা জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। আমরা ভোক্তা সাধারণ এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও কারসাজি রুখতে বেশি চেষ্টা করছি। তারপরও সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে যখন যেভাবে নির্দেশনা আসে সেটা করতে আমাদের কোনো কমতি থাকে না। যদি ভোক্তা সাধারণ থেকে অভিযোগ আসে সেটার ব্যাপারে আমাদের তৎপরতা সব সময়ই থাকে।

বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৮৬ শতাংশ ইলিশ বাংলাদেশে

দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ। বার্ষিক উৎপাদন প্রায় তিন লাখ ৪৬ হাজার মেট্রিক টন, যার বাজার মূল্য ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আর জিডিপিতে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় এক শতাংশ।

ওয়ার্ল্ডফিশের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। কিন্তু চলতি বছর বাংলাদেশই পড়েছে ইলিশ সংকটে। দেশের যেসব নদীতে একসময় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ত সেসব নদীতেই এবার ইলিশের আকাল দেখা গেছে। জেলিফিশের বাড়বাড়ন্ত আর দফায় দফায় বৈরী আবহাওয়ার কারণে এবার সাগরেও ইলিশ ধরা পড়ছে কম। ফলে চলতি বছরের প্রথমার্ধে আগের বছরের তুলনায় ইলিশের উৎপাদন কম হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ; যার প্রভাব পড়েছে বাজারেও।

বাংলাদেশে ইলিশের চারটি প্রজনন ক্ষেত্র এবং ছয়টি অভয়াশ্রম আছে। চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে শুরু করে ভোলার লালমোহন উপজেলা পর্যন্ত ইলিশের সবচেয়ে বড় প্রজনন ক্ষেত্র। বিশেষ করে মনপুরা, ঢালচর, বালিরচর, মৌলভীরচর- এগুলো হচ্ছে ইলিশের ডিম ছাড়ার সবচেয়ে বড় পয়েন্ট। চট্টগ্রাম, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা মিলিয়ে প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশ মাছ সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে। এর বাইরের উপকূলের অন্যান্য নদীগুলোতেও ইলিশ ডিম ছাড়ে।

ইলিশের অভয়াশ্রমগুলো মূলত মেঘনা নদী ও তার অববাহিকা এবং পদ্মা ও মেঘনার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এর মধ্যে চাঁদপুরে মেঘনা নদীর নিম্ন অববাহিকার ১০০ কিলোমিটার এলাকা, ভোলায় মেঘনা নদীর শাহবাজপুর শাখা নদীর ৯০ কিলোমিটার এলাকা, তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা অন্যতম। এ ছাড়া পদ্মা নদীর ২০ কিলোমিটার এলাকা, বরিশালের হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জে মেঘনা নদীর প্রায় ৮২ কিলোমিটার এলাকাও এর ভেতরে পড়ে।

ইলিশের উৎপাদন বাড়লেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন

মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গেল এক দশকে ইলিশ উৎপাদনের হার ছিল আকর্ষণীয়। বিশেষ করে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে প্রতিবছর ইলিশের উৎপাদন হয়েছে পাঁচ লাখ টনের বেশি। হিসাব অনুযায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ১৭ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ লাখ ৫০ হাজার টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৬৭ হাজার টন ও সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৭১ হাজার টন।

অবশ্য কাগজে-কলমে উৎপাদনের রেকর্ড গড়লেও বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। জেলে এবং এই খাতের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েক বছর আগে ইলিশের উৎপাদন ভালো হলেও গত দুই-তিন মৌসুমে নদীতে উৎপাদন নেমেছে অর্ধেকে। সাগরেও ধরা পড়ছে তুলনামূলক কম।

অবসরপ্রাপ্ত মৎস্য জরিপ কর্মকর্তা জুবায়ের আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইলিশ মূলত সাগরের মাছ। যেসব নদ-নদীর সঙ্গে সাগরের যোগসূত্র রয়েছে, সেই সব নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়। রংপুর অঞ্চলে বর্ষাকালে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র খরস্রোতা হয়ে থাকে। ওই সময় তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্রে ইলিশ পাওয়া যায়। সাগর থেকে ইলিশ আসে ডিম পাড়তে। রংপুর অঞ্চলে ইলিশের আগমন ঘটাতে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার বিকল্প নেই। নদীগুলোকে খরস্রোতা করতে পারলেই দেশের অন্যান্য স্থানের মতো এখানকার নদীতে ইলিশ পাওয়া যাবে।

তিনি আরও বলেন, নদীর ভিন্ন চরিত্র ও বিরূপ আবহাওয়ার জন্য দিন দিন আমাদের ইলিশের উৎপাদন কমেছে। এর মধ্যে সাগর ও নদীতে সৃষ্ট ডুবোচর ও নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ার কারণে সমুদ্র থেকে ইলিশ মিঠাপানিতে আসতে বাধা পেয়ে গতিপথ পরিবর্তন করা উৎপাদন কমার অন্যতম কারণ। ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ইলিশের উৎপাদন ভালো ছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী আমাদের ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমেছে। চাহিদার তুলনায় এখন জোগান কম থাকায় দিন দিন ইলিশের দাম বাড়ছে।

ইলিশ বাঁচাতে যা বলছেন নদী গবেষক

নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইলিশ আমাদের জাতীয় সম্পদ। দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও একটি বড় ক্ষেত্র ইলিশ। এটিকে লালনপালন ও পরিচর্যা জরুরি। সঙ্গে বিভিন্ন গবেষণাধর্মী পরিকল্পনা নিয়ে সামনে আরও বেশি উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, দেশের নদ-নদীগুলো দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। নাব্যতা হারিয়ে বহু নদ-নদী মরতে বসেছে। এ কারণে ইলিশের অভায়শ্রমগুলো কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সে জায়গাগুলো থেকে উত্তরণ করা দরকার। ইলিশের বিচরণ পথ সুগম ও নিরাপদ করতে হবে। তা না হলে ইলিশের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে। এজন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। নদীর সুরক্ষার বিষয়টিও এখন জরুরি।

ইলিশ নিয়ে সরকারের উপদেষ্টাদের বক্তব্য

গত ৫ অক্টোবর পদ্মা নদীর পাড়ে এক সচেতনতা সভায় এসে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, দাম বেশি হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ ইলিশ খেতে পারে না। এটা বড় ধরনের অন্যায়। এটা থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে। আমরা যদি ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে পারি, তাহলে অবশ্যই বাজারে ইলিশের দাম কম হবে।

তিনি আরও বলেন, একটা নতুন বাংলাদেশের কথা বলছি। আগের উদাহরণ দিয়ে লাভ নেই। আগের মতো আমরা করব না। আমরা যেন সফল হতে পারি সেই চেষ্টা করব। জেলেদের যে তালিকা করা হতো, যাদের বিশেষ পদ্ধতিতে করা হতো, সেগুলো এবার থাকবে না। ফলে আশা করছি, তালিকা অনেকটা স্বচ্ছ হবে। প্রকৃত জেলেরা যেন তাদের চাল ও অন্যান্য সবকিছু পায় তা মন্ত্রণালয় থেকে নিশ্চিত করা হবে।

এমজেইউ/

প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন ঢাকা পোস্টের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জুয়েল রানা, নীলফামারী প্রতিনিধি শরিফুল ইসলাম, গাইবান্ধা প্রতিনিধি রিপন আকন্দ ও লালমনিরহাট প্রতিনিধি নিয়াজ আহমেদ সিপন।

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *