আর্থিক সহায়তা পেলে ২ বছরের মধ্যে গ্র্যান্ডমাস্টার হবো

আর্থিক সহায়তা পেলে ২ বছরের মধ্যে গ্র্যান্ডমাস্টার হবো

বাংলাদেশের দাবার নতুন বিস্ময় বালক মনন রেজা নীড়। মাত্র ১৪ বছর ৪ মাস বয়সে দেশের সর্বকনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক মাস্টার হয়েছেন। বর্তমান জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন এখন খেলছেন হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে গ্র্যান্ডমাস্টার দাবা টুর্নামেন্টে।

বাংলাদেশের দাবার নতুন বিস্ময় বালক মনন রেজা নীড়। মাত্র ১৪ বছর ৪ মাস বয়সে দেশের সর্বকনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক মাস্টার হয়েছেন। বর্তমান জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন এখন খেলছেন হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে গ্র্যান্ডমাস্টার দাবা টুর্নামেন্টে।

হাঙ্গেরি থেকে ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের-এর সঙ্গে আলাপ করেছেন নানা বিষয়ে।

ঢাকা পোস্ট : ১৯৮১ সালে ১৫ বছর ৫ মাসে নিয়াজ মোর্শেদ সর্বকনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক মাস্টার হয়েছিলেন। ৪৩ বছর পর সেই রেকর্ড আপনি ভাঙলেন। 

নীড় : আসলে আমার হাঙ্গেরিতে টুর্নামেন্ট খেলা মূলত জিএম নর্ম পাওয়ার জন্য। জিএম নর্ম মিস করেছি এজন্য খারাপ লাগছে। তবে আন্তর্জাতিক মাস্টার হয়েছি এটা আনন্দের। কয়েক বছর পর বাংলাদেশ আরেকজন আন্তর্জাতিক মাস্টার পেয়েছে। 

ঢাকা পোস্ট : আজ (গতকাল) শেষ রাউন্ডে হাঙ্গেরির দাবাড়ুর সঙ্গে জিতলেই জিএম নর্ম পেতেন। আপনার চেয়ে কম রেটেড দাবাড়ু। ম্যাচটি ড্র হলো কিভাবে?

নীড় : আসলে ম্যাচটি আমি ভালোই খেলছিলাম। জেতার পজিশনই ছিল। হঠাৎ একটি চালে পরিস্থিতি বদলে যায়। এতে খেলাটি ড্র হয়। 

ঢাকা পোস্ট : নিয়াজ মোর্শেদের ভবিষ্যদ্বাণী আপনি ২-৩ বছরের মধ্যে গ্রান্ডমাস্টার হতে পারবেন এবং আন্তর্জাতিক মাস্টারের মতো সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টারও হবেন। 

নীড় : আমিও চাই ২ বছরের মধ্যে গ্র্যান্ডমাস্টার হতে। দুই বছর পর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ততা বাড়বে। এর আগেই আমি গ্র্যান্ডমাস্টার হতে চাই। 

ঢাকা পোস্ট : ২ বছরের মধ্যে গ্র্য্যান্ডমাস্টার হতে হলে কি করতে হবে? 

নীড় : বছরে অন্তত ৭-৮ টি বিদেশি টুর্নামেন্ট খেলতে হবে। দুই বছরে ১৫-১৬ টি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেললে আশা করা যায় তিনটি জিএম নর্ম পাব। এই টুর্নামেন্ট খেলতে প্রয়োজন আর্থিক সাহায্য। আমি স্পন্সর ও কোচিং পেলে দুই বছরের মধ্যেই জিএম হতে পারব এটা আশাবাদী। অলিম্পিয়াডের পর হাঙ্গেরির এই টুর্নামেন্টগুলো আমার আসলে খেলার কথা ছিল না। নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক এবং মাসুদ আঙ্কেল সহায়তা না করলে আমার এখানে খেলাও হতো না আন্তর্জাতিক মাস্টারও হওয়া হতো না। তাই তাদের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। সামনে আবার কখন কোথায় খেলার সুযোগ পাব এবং খেলতে পারব কি না জানি না। 

ঢাকা পোস্ট : আন্তর্জাতিক মাস্টার ফাহাদ রহমান জিএম নর্মের জন্য ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যে অনেক খেলেছেন। বেশ কয়েকটি টুর্নামেন্ট খেলার পর একটি নর্ম পেয়েছেন। দুই বছর আপনার প্রত্যাশিত ১৫-১৬ বিদেশি টুর্নামেন্ট খেললে কি জিএম হতে পারবেন?

নীড় : জিএম নর্ম পাওয়া বেশ কঠিন। নয় রাউন্ডের খেলায় সাত পয়েন্ট পেতে হয়। তিন জন গ্র্যান্ডমাস্টার ও উচু রেটিংধারী দাবাড়ুরা থাকেন। চেষ্টা, কৌশলের পাশাপাশি জিএম নর্ম পাওয়া খানিকটা ভাগ্যেরও ব্যাপার। ফাহাদ ভাই বেশ কয়েকবার কাছাকাছি গিয়েও মিস করেছেন। আমিই তো একবার থাইল্যান্ডে ও আজ (গতকাল) জিএম নর্ম মিস করলাম। চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আশা করি পারব। 

ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশের ষষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার দৌড়ে এখন ফাহাদ আর আপনি। ফাহাদ একটি গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম নিয়ে এগিয়ে রয়েছে। 

নীড় : ফাহাদ ভাই আমার খুব ভালো বন্ধু ও সতীর্থ। অলিম্পিয়াডে আমরা রুমমেট ছিলাম এই টুর্নামেন্টেও এক সঙ্গে থাকছি। আমাদের দুই জনের মধ্যে অনেকেই গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া নিয়ে অযথা প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টির চেষ্টা করে। কে আগে, কে পরে হবে। এটা কোনো বিষয় নয়। গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া দিয়ে কথা। গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়াই চূড়ান্ত লক্ষ্য আমার নয়। আমি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে চাই। 

ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশি দাবাড়ুদের মধ্যে বিশ্বকাপ দাবায় এনামুল হোসেন রাজীবই শুধু প্রথম রাউন্ড পার হতে পেরেছে। আপনি সেখানে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের স্বপ্ন দেখছেন। এটা অতি উচ্চবিলাসী নয়?

নীড় : আমি জানি রাজীব স্যারই শুধু বিশ্বকাপে পরের রাউন্ডে খেলেছে। এটা জেনেও আমি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দেখি। আগামী দুই বছরের মধ্যে জিএম হতে পারলে আমার পরবর্তী লক্ষ্যপূরণে চেষ্টা করব। দেখা যাক কতদূর যেতে পারি। 

দাবা অলিম্পিয়াড, বিশ্বকাপ আর দু’একটি টুর্নামেন্ট ছাড়া দাবা ফেডারেশন খরচ বহন করে না। দাবা ফেডারেশনের সেই সামর্থ্যও নাই। তাই উঠতি খেলোয়াড়দের নিজের আগ্রহ ও পারিবারিক চেষ্টাতেই খেলতে হয়। ভারতের তরুণরা পরিবার থেকে সাপোর্ট ও অনেক পৃষ্ঠপোষকতা পায়। এজন্য তাদের এখন ১২ বছর বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টার হচ্ছে। বাংলাদেশে খেলে যাওয়া ভারতীয় গুকেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপে খেলছে। 

ঢাকা পোস্ট : এবার আপনি প্রথমবারের মতো অলিম্পিয়াড খেললেন। অভিজ্ঞতা কেমন?

নীড় : প্রথমবারের মতো অলিম্পিয়াড খেলে ভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। এটা দলীয় খেলা। কখনো দলের জন্য জয়ের জন্য অতি মরিয়া হতে হয়। আবার অন্য বোর্ডে জয়-হারে নিজের ওপরও চাপ পড়ে। সব মিলিয়ে চেষ্টা করেছি। তবে নিজের খুব সেরাটা দিতে পেরেছি বলব না। 

ঢাকা পোস্ট : সব খেলাই অনুশীলন নির্ভর। এরপরও দাবার মতো মনোযোগ ও বুদ্ধি নির্ভর খেলায় অনুশীলন প্রয়োজন। আপনি দিনে কয় ঘণ্টা অনুশীলন করেন। 

নীড় : টুর্নামেন্ট থাকলে অপনেন্টের খেলা একটু বিশ্লেষণ করি। আর এমনি নিজে দেড়-দুই ঘণ্টা অনুশীলন করি। সাধারণ সময় অনেক দিন অনুশীলন করিও না। দাবা অনুশীলন না করলেও ফুটবল খেলা আমার কোনো দিনও মিস নেই। হাঙ্গেরিতে এত দিন আছি খারাপ লাগছে ফুটবল খেলতে পারছি না। আমি প্রতিদিনই ফুটবল খেলি হয় সকাল না হয় বিকেলে। দাবা আমার পেশা হলেও ফুটবল আমার নেশা। 

ঢাকা পোস্ট : ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। বাংলাদেশেও জনপ্রিয়তা এখন সেই অর্থে না থাকলেও ফুটবলে এখনো অর্থ কড়ি অনেক। ফুটবল আপনার এত পছন্দ হলেও দাবাড়ু হলেন কিভাবে? 

নীড় : আমি বার্সেলোনা ও মেসির অসম্ভব ভক্ত। ইউরোপীয়ান লিগের খেলা দেখা তেমন মিস হয় না। আমার বাবা বাসায় কম্পিউটারে দাবা খেলতেন। একেবারে ছোটবেলায় একদিন ক্রিকেট ব্যাট কিনতে নিয়ে গেলেন। তখন আমি দাবা বোর্ড ধরি। বাবা বললেন কোনটা নেবে ক্রিকেট ব্যাট না দাবা বোর্ড। আমি দাবা বোর্ড কিনতে বলি। সেই থেকে বাসায় দাবা খেলা শুরু। এরপর থেকেই দাবা চলছে।

ঢাকা পোস্ট : আপনি নবম শ্রেণীর ছাত্র। মাত্র ১৪ বছর বয়সে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন, আন্তর্জাতিক মাস্টার। এত সাফল্যের পেছনে রহস্য কি?

নীড় : মূল রহস্য আমার মা। তিনিই আমার প্রেরণা। আমাদের বাসা নারায়ণগঞ্জ থেকে তিনিই আমাকে দাবা খেলতে ফেডারেশনে এনেছেন। অনেক সময় ৫-৬ ঘণ্টা এক নাগাড়ে বসে থাকতেন। অপেক্ষা করা বেশ কষ্টের এবং বিরক্তিকর। আমি একদিন মায়ের কষ্ট বোঝার জন্য একজনের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। দুই ঘণ্টা পর আর পারিনি চলে গেছি। আমার মা মাসের পর মাস আমার জন্য এভাবে শুধুই বসে থেকেছেন। আমার বাইরে খেলতে যাওয়ার টাকা পয়সা জোগাড় সবই মায়ের কল্যাণে। আমার আজকের এই অবস্থানের মূলেই মা।

ঢাকা পোস্ট : আপনার মা অনুপ্রেরণা। দাবা বোর্ডে আপনি লড়েন। বাংলাদেশের দাবা অঙ্গনের অনেকেই আপনাকে অত্যন্ত মেধাবী ও সহজাত প্রতিভা হিসেবে আখ্যায়িত করছে। আপনার দৃষ্টিতে আপনি কি রকম?

নীড় : আমি মেধাবী এটা বুঝতে পারি। না হলে দেশ-বিদেশে গ্র্যান্ডমাস্টারদের হারাতে পারতাম না। তবে আমার এই মেধার সম্পূর্ণ বিকশিত করতে হলে কোচিং ও স্পন্সর প্রয়োজন। আমার সুনির্দিষ্ট স্থায়ী কোচ নেই। কখনো জিয়া স্যার, রাজীব স্যার, শাকিল স্যার কোচিং করিয়েছেন। ভারতের দুই একজনের কাছেও শিখেছি। গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার জন্য একটু কোচিং নির্দেশনা প্রয়োজন। আর বেশি বেশি খেলা। খেলার জন্য প্রয়োজন আর্থিক সহায়তা। 

ঢাকা পোস্ট : আপনি জাতীয় দাবায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হয়ে খেলেন। সংস্থা থেকে কেমন সহায়তা পান?

নীড় : আমি নৌবাহিনীর খেলোয়াড় হিসেবে মাসিক বেতন পাই। সেটা দিয়ে পারিবারিক ব্যয় হয়। বাইরে খেলতে যাওয়া সম্ভব হয় না। বাইরে খেলতে যেতে হলে আমার মাকে বিভিন্ন জনের কাছে যেতে হয়। কারো সাহায্য, কারো পৃষ্ঠপোষকতা নিয়েই বিদেশে টুর্নামেন্ট খেলি। আর্থিক চাপ না থাকলে আরো ভালো খেলতে পারব। 

এজেড/এফআই

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *