ইলিশ কেন সবার এত পছন্দের?

ইলিশ কেন সবার এত পছন্দের?

ইলিশ আহরণ ও রপ্তানি

ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘টেনুলোসা ইলিশা’, পূর্বে ‘হিলসা ইলিশা’ নামে পরিচিত ছিল। পশ্চিমে পারস্য উপসাগর থেকে পূর্বে কোচিন চীন (লাওস) পর্যন্ত গোটা ইন্দো-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলবর্তী অঞ্চলের লোনা পানি এবং মিঠা পানির নদীগুলোর বাসিন্দা ইলিশ।

এটি মূলত একটি অ্যানাড্রোমাস মাছ অর্থাৎ যুবক থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক পর্যন্ত সময়ে সাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলের লবণাক্ত পানিতে বসবাস করে, কিন্তু প্রজননের জন্য নদীর মোহনা ও চরাঞ্চলের স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। ডিম ফোটে রেণু বের হয়ে জুভেনাইল (জাটকা) হওয়া পর্যন্ত স্বাদু পানিতে অবস্থান করে। জাটকা ইলিশ পুনরায় সাগরের লবণাক্ত পানিতে অভিপ্রয়াণ করে।

ইলিশ আহরণ ও রপ্তানি

ইলিশ বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে, বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত এবং মিয়ানমারে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ একক মৎস্য শিল্প। বৈশ্বিক ইলিশ আহরণের ৬৫ শতাংশেরও বেশি অবদান রাখে বাংলাদেশ, এরপর ভারত, মিয়ানমার, ইরাক, কুয়েত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং পাকিস্তান।

২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের ইলিশ মাছ আহরণের পরিমাণ ছিল ৫.৬৫ লাখ মেট্রিক টন যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১১ শতাংশের বেশি। দেশের জিডিপিতে ইলিশের অবদান ১ শতাংশের বেশি। দেশের প্রায় ৬ লাখ মানুষ সরাসরি ইলিশ আহরণ এবং ২৫ লাখ মানুষ পরোক্ষভাবে ইলিশ ব্যবসার সাথে জড়িত।

ইলিশের উৎপত্তি, ধারাবাহিকভাবে সর্বোচ্চ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে এবং ইলিশকেন্দ্রিক বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে জেনেভা ভিত্তিক জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন কর্তৃক ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ইলিশকে ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। 

বাংলাদেশ ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৮,৭৯৭ মেট্রিক টন হিমায়িত মাছ রপ্তানি করে ৩৫১.০৯ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে যার সিংহভাগই ইলিশের অবদান। বাংলাদেশের ইলিশ ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। তবে আমরা শুধু ভারতের বিষয়টাই জানি এবং তা সবচেয়ে বেশি প্রচারিত হয়।

ইলিশের পুষ্টিগুণ

ইলিশ ওমেগা-৩ পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (Omega-3 Polyunsaturated Fatty Acid), অপরিশোধিত চর্বি (৭.৯১-১৪.৬১ শতাংশ), অত্যন্ত উচ্চ অপরিশোধিত প্রোটিন (১৯.৪৪-২১.৮৬ শতাংশ), খনিজ পদার্থ যেমন পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রন, দস্তা এবং চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন যেমন ‘এ’ এবং ‘ই’–তে সমৃদ্ধ। ওমেগা-৩ পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড রক্তে কোলেস্টেরল এবং ইনসুলিনের মাত্রা কমায়, ফলে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও বাত নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

রাতকানা রোগ, ক্যান্সার, হাঁপানি নিরাময় এবং ত্বক ও শিশুদের মস্তিষ্কের গঠনেও ইলিশ মাছের ভূমিকা রয়েছে। কথিত আছে, ইলিশ মাছ পানির উপরে উঠালেই মারা যায়, কারণ পানির উপরে আসলে অতিরিক্ত তেল সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ অসমোরেগুলেশন (Osmoregulation)-এর চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় রক্তনালীর শিরা-উপশিরাগুলো ফেটে যায় ফলে ইলিশ দ্রুত মারা যায়।

কোন জায়গার ইলিশ বেশি সুস্বাদু?

ইলিশের স্বাদ, গন্ধ, পুষ্টিগুণ ও সাংস্কৃতিক আভিজাত্যের জন্য অতিথি আপ্যায়ন, উৎসব, নববর্ষের অনুষ্ঠানে ও পূজা-পার্বণে মাছের কদর সর্বোচ্চ। ইলিশের স্বাদ তার বাসস্থানের উপর নির্ভরশীল। পদ্মার ইলিশ সবচেয়ে বেশি সুস্বাদু হয় কারণ পদ্মার পানিতে ইলিশের পছন্দের খাবার—এক বিশেষ ধরনের উদ্ভিদ কণা (ডায়াটম) থাকে, তারপরই রয়েছে মেঘনার ইলিশ।

সাগর থেকে আহরিত ইলিশ তুলনামূলকভাবে কম সুস্বাদু হয় কারণ সাগরের পানিতে লবণের পরিমাণ বেশি থাকায় অসমোরেগুলেশন প্রক্রিয়ায় লবণ ও পানির ভারসাম্য রক্ষা করতে নদীর ইলিশের চেয়ে বেশি শক্তি ব্যয় করে বিধায় সাগরের ইলিশে তুলনামূলকভাবে কম ফ্যাট থাকে এবং স্বাদও কম হয়।

ইলিশ চেনার উপায়

অনেকের মধ্যেই একটি কৌতূহল কাজ করে যে, বাজারে গিয়ে সুস্বাদু পদ্মার ইলিশ চেনার উপায় কী? যেহেতু প্রজনন মৌসুমে ইলিশ মাছ নদীতে অভিপ্রয়াণ করে, সেহেতু মা ইলিশের পেটে ডিম থাকে এবং বাবা ইলিশের পেটে ফ্যাট থাকে বিধায় দেহের আকৃতি প্রস্থে সাগরের ইলিশের তুলনায় বেশি হয়।

সাগরের ইলিশে ডিম থাকে না বলে আকারে লম্বা হয়। তাছাড়া, ইলিশ মাছ যখন নদীতে অভিপ্রয়াণ করে তখন নদীর পানির ঘোলা হওয়ার কারণে সাগরের তুলনায় বেশি থাকায় ইলিশের চোখ লাল হয়ে যায়। তাই, অনেকে ইলিশের লাল চোখ দেখেও নদীর ইলিশকে সনাক্ত করে থাকে।

তাছাড়া, ইলিশের অন্য একটি প্রজাতি (টেনুলোসা টলি-চন্দনা ইলিশ) এবং সারডিন মাছ (সার্ডিনেলা লন্জিসেপস) রয়েছে যা পশ্চিম ভারত থেকে জাভা সাগর এবং দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। বাজারে ইলিশের পাশাপাশি এ মাছগুলোও বিক্রি হয় বিধায় সঠিক ইলিশ ক্রয়ের জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

জেনে রাখা ভালো যে, ইলিশের দেহ পার্শ্বীয়ভাবে পুরু, পিঠের ও পেটের দিক প্রায় সমভাবে উত্তল। সার্ডিনের মাথার আকৃতি ছোট ও অগ্রভাগ ভোতা। ইলিশের মাথার আকৃতি লম্বাটে ও অগ্রভাগ সূচালো। সার্ডিনের চোখের আকৃতি তুলনামূলকভাবে বড়। আসল ইলিশের চোখের আকৃতি তুলনামূলকভাবে ছোট। সার্ডিনের পাখনার উৎসে একটি কালো ফোঁটা রয়েছে। আসল ইলিশের কানকুয়ার পরে একটি বড় কালো ফোঁটা এবং পরে অনেকগুলো কালো ফোঁটা থাকে।

অন্যদিকে, চন্দনা ইলিশের উপরের চোয়ালে একটি স্বতন্ত্র মাঝারি খাঁজ, যা ইলিশ কেলি ছাড়া অন্যান্য অনুরূপ ক্লুপিড থেকে এটিকে আলাদা করে। চন্দনা ইলিশের পুচ্ছ পাখনা ছোট। সর্বাধিক, ফুলকা খোলার পেছনে একটি অন্ধকার বিচ্ছুরিত চিহ্ন, যার পার্শ্বে অন্য কোনো দাগ নেই।

বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত নানাবিধ ‘ইলিশ ফিশারিজ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি’ বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশে ইলিশ আহরণ প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রধান কার্যক্রমগুলোর মধ্যে রয়েছে—৭,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ইলিশের প্রধানতম প্রজনন এলাকা হিসেবে চিহ্নিতকরণ, ৬টি ইলিশ অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা, নিঝুম দ্বীপের নিকটবর্তী ৩,১৮৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ‘মেরিন রিজার্ভ এলাকা’ ঘোষণা, ইলিশের প্রজনন মৌসুমে ১২ অক্টোবর থেকে ০২ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিনের জন্য ইলিশ মাছ ধরা নিষেধ করা, ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই ৬৫ দিনের জন্য সব ধরনের সাগরের মাছ ধরা নিষেধ করা, নভেম্বর থেকে জুন ০৮ মাস জাটকা ধরা নিষেধ করা হয়েছে।

তাছাড়া, মাছ ধরা নিষেধ থাকাকালীন জেলেদের জন্য ভিজিএফ এবং এআইজি এর ব্যবস্থাকরণ। কিন্তু বাংলাদেশে যখন মাছ ধরা নিষেধ থাকে তখন পার্শ্ববর্তী দেশে মাছ ধরা অব্যাহত থাকে। ফলে পার্শ্ববর্তী দেশের জেলেরা সেসময় বেশি মাছ আহরণ করে। তাই, এ অসামঞ্জস্যতা দূর করা লক্ষ্যে অধিকতর গবেষণা আশু প্রয়োজন।

ইলিশের দামদর

ইলিশ আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই মাছ মুক্ত জলাশয় থেকে আহরণ করা হয় বিধায় এর চাষ ব্যবস্থাপনা তথা কোনো উৎপাদন খরচ নেই। তবুও কেন ইলিশ মাছের দাম প্রায় ১,৫০০ টাকা কেজি? আড়ৎদারদের সিন্ডিকেট এই উচ্চ মূল্যের জন্য দায়ী বলে ধারণা করা হয়। কেননা জেলেরা মাছ আহরণ করতে জাল ও নৌকাসহ তাদের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আড়ৎদারদের নিকট থেকে দাদন হিসেবে নিয়ে থাকে।

তাই, তারা তাদের আহরিত সব ইলিশ আড়ৎদারদের নিকট বিক্রি করতে বাধ্য থাকে। আড়ৎদাররা তখন তাদের নিজেদের মতো দাম নির্ধারণ করে তাদের নিয়োজিত সরবরাহকারীদের দিয়ে ইলিশ বাজারজাত করে বিধায় ইলিশের দাম নিয়ন্ত্রণহীন। তাই, ইলিশের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অপরিকল্পিত রপ্তানি ও বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপ আশু প্রয়োজন। কেননা ইলিশের এ উচ্চমূল্যের কারণে ইলিশ আজ গরিব মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে। অন্যথায়, ইলিশ শুধু ধনী শ্রেণির মানুষের খাবারে রসনা বিলাসের প্রতীক হয়ে থাকবে।

পরিশেষে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পন্ন সাগরের অধিকাংশ মাছকে চাষের আওতায় নিয়ে এসেছে কিন্তু বাংলাদেশের ইলিশ মাছকে এখনো চাষের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। যার জন্য প্রয়োজন নিবিড় গবেষণা।

ইলিশের জিনোম সিকুয়েন্সকে এনোটেটিং করে লবণসহিষ্ণু জিনকে সনাক্ত করা প্রয়োজন। লবণসহিষ্ণু জিনের এডিটিং-এর মাধ্যমে ইলিশ মাছকে চাষোপযোগী করা যেতে পারে। তাছাড়া, ইলিশের জনতার গঠন ও কৌলিতাত্ত্বিক জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ইলিশের জনতার সঠিক মনিটরিং এবং ব্যবস্থাপনা করা অত্যন্ত জরুরি।

অধ্যাপক ড. এম এম মাহবুব আলম ।। মৎস্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *