বাংলাদেশে হিন্দু নারীদের ধর্ষণ-বাড়িতে আগুনের দাবি কী সত্য?

বাংলাদেশে হিন্দু নারীদের ধর্ষণ-বাড়িতে আগুনের দাবি কী সত্য?

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভ চলাকালীন বাংলাদেশি হিন্দু নারীদের ধর্ষণ ও তাদের ওপর হামলার পুরোনো কিছু ছবি অনলাইনে নতুন করে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই এসব ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করে নানা ধরনের প্রশ্ন তুলছেন। কিন্তু আসলেই কী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে? জার্মানির ইংরেজি সংবাদমাধ্যম ডিডাব্লিউ এমন কিছু ভাইরাল দাবির ফ্যাক্ট চেক করে সত্য তথ্য তুলে ধরেছে। ঢাকা পোস্টের পাঠকদের জন্য সেই ফ্যাক্ট চেক তুলে ধরা হলো।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভ চলাকালীন বাংলাদেশি হিন্দু নারীদের ধর্ষণ ও তাদের ওপর হামলার পুরোনো কিছু ছবি অনলাইনে নতুন করে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই এসব ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করে নানা ধরনের প্রশ্ন তুলছেন। কিন্তু আসলেই কী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে? জার্মানির ইংরেজি সংবাদমাধ্যম ডিডাব্লিউ এমন কিছু ভাইরাল দাবির ফ্যাক্ট চেক করে সত্য তথ্য তুলে ধরেছে। ঢাকা পোস্টের পাঠকদের জন্য সেই ফ্যাক্ট চেক তুলে ধরা হলো।

কয়েক সপ্তাহের ব্যাপক বিক্ষোভের পর গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত তা শেখ হাসিনার শাসনের অবসানের দাবিতে বৃহত্তর আন্দোলনে রূপ নেয়। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর জনতা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে ঢুকে পড়ে এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ভবন ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, এমপি-মন্ত্রীদের বাড়িতে ভাঙচুর চালায়।

ভারতীয় ও স্থানীয় কিছু গণমাধ্যম বলছে, দেশজুড়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কিছু বাড়িঘর, উপাসনালয় এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে। রাজধানী ঢাকা, নাটোর, পটুয়াখালী, যশোরসহ কয়েকটি শহরে হিন্দু মন্দিরকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। তবে জনগণের সহিংসতা থেকে রক্ষার জন্য অনেক এলাকায় শিক্ষার্থী ও ধর্মীয় নেতারা মন্দিরের সামনে জড়ো হয়ে নিরাপত্তা দিচ্ছেন।

প্রতিবেশি ভারতের মতো বাংলাদেশেও হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় উত্তেজনার ইতিহাস রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে বসবাসরত সংখ্যালঘু হিন্দুরা উন্মত্ত কিছু জনতার আক্রমণের শিকার হয়েছেন। তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালীন হিন্দু সম্প্রদায় ও তাদের মন্দিরে বিক্ষোভকারীদের হামলার বিষয়ে করা অনেক অভিযোগ সঠিক নয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশের বেশি হিন্দু ধর্মাবলম্বী।

দাবি: বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের হিন্দু খেলোয়াড় লিটন দাসের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এমন অভিযোগ করে একটি পোস্ট করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি হিন্দু ক্রিকেটার লিটন দাসের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। প্রমাণ হিসেবে দুটি ছবি কোলাজ করে প্রকাশ করা হয়েছে।

একটি ছবিতে একজন যুবককে হিন্দু উপাসনালয়ের পাশে বসে থাকতে ও অন্য ছবিতে একটি জ্বলন্ত বাড়ি দেখা যায়। এক্সের ১০ লাখের বেশি ব্যবহারকারী পোস্টটি দেখেছেন। একই ছবি আরও অনেক অ্যাকাউন্ট থেকে একই দাবিতে শেয়ার করা হয়েছে।

ছবিতে দেখা যাওয়া যুবক লিটন দাস। এটি সত্য। রিভার্স ইমেজ সার্চে দেখা যায়, মন্দিরের পাশে লিটন দাসের বসে থাকার ছবিটি তার অফিসিয়াল অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোলাজ ছবিতে যে জ্বলন্ত বাড়িটি দেখা যায়, সেটি তার বাড়ি নয়। সেই ছবির রিভার্স ইমেজ সার্চে দেখা যায়, ছবিটি আসলে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার বাড়ির। বিক্ষোভকারীরা মাশরাফির বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন বলেও গণমাধ্যমে প্রতিবেদন হয়েছে। ঢাকা পোস্টও মাশরাফির বাড়িতে বিক্ষোভকারীদের আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনার বিষয়ে খবর প্রকাশ করেছে।

ডিডাব্লিউ বাড়িটির জিওলোকেট করে নিশ্চিত হয়েছে, বাড়িটি মুর্তজারই। আর তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের এমপি হওয়ায় লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। চলতি বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে টানা দ্বিতীয়বারের মতো নড়াইলের একটি আসনে জয় পেয়েছিলেন তিনি।

বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘু নারীদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে অনেক দাবি প্রচার করা হচ্ছে। এর মধ্যে দু’টি দাবি একাধিকবার শেয়ার করা হয়েছে এবং তা হাজার হাজার বার দেখা হয়েছে। কিন্তু কিছু পুরোনো ও কিছু প্রেক্ষাপটের বাইরের ছবি নতুন করে ছড়ানো হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ঠিক যেমনটা হিন্দু নারীদের ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির অভিযোগের ক্ষেত্রে ঘটেছে।

এক্সে দেওয়া পোস্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি এই মুসলমানদের দিকে সতর্কতার সাথে খেয়াল করুন: হিন্দু মেয়েদের অন্তর্বাস খুলে ফেলা হয়েছে এবং তারপর তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। এখন তিনি নির্লজ্জভাবে সেই অন্তর্বাস নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং তার পুরুষত্বের প্রমাণ দিচ্ছেন। এই ভিডিওটি প্রায় ৩০ হাজার বার দেখা হয়েছে।

২৩ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, হাজার হাজার বিক্ষোভকারী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবনে ঢুকে পড়েছেন। এই সংক্রান্ত অনেক ছবি ও ভিডিও অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীরা গণভবনে ঢুকে শেখ হাসিনার জিনিসপত্র লুটপাট করছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর গণভবনে ঢুকে তার জামাকাপড় ও অন্তর্বাস নিয়ে যাচ্ছেন তারা। ভিডিওটির শেষ কয়েক সেকেন্ডে লাল-বাদামী দেয়াল বিশিষ্ট একটি ভবন দেখা যায়; যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনের মতো।

সংবাদমাধ্যমের ফুটেজের সাথে গণভবনের ভিডিও ও ছবিতে ভবনটির তুলনা করলে দেখা যায়, ওই ভবনটি প্রকৃতপক্ষে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন। ভিডিওর শেষ কয়েক সেকেন্ডে দেখা যাওয়া ভবনের সাথে গণভবনের সামনের পাম গাছ ও জানালার মিল পাওয়া যায়।

এক্সে দেওয়া আরেকটি পোস্টে একটি টেলিগ্রাম পোস্টের স্ক্রিন শট দেখা যায়। এতে একজন নারী রয়েছেন। বাংলায় লেখা ছবির ক্যাপশনে হিন্দুদের হুমকি ও তাদের ভারতে ফেরত পাঠানোর জন্য সহিংসতা চালানোর বিষয়ে উসকানি দেওয়া হয়।

এই পোস্টটি শেখ হাসিনার বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার তিন দিন আগে গত ২ আগস্ট করা হয়। ছবিতে গ্রাফিক সহিংসতার বিষয়েও সতর্ক করে দেওয়া হয়। সম্প্রতি অন্যান্য আরও অনেক অ্যাকাউন্ট থেকে ক্রমবর্ধমান হারে ছবিটি শেয়ার করা হয়েছে। এক্সে এখন পর্যন্ত ৩০ হাজারের বেশি বার দেখা হয়েছে ছবিটি।  

ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, তথাকথিত জামায়াতে ইসলামির কোটা আন্দোলনকারীরা ইসলামিক আর্মি গ্রুপে একটি হিন্দু মেয়েকে গণধর্ষণের ভিডিও ফাঁস করেছেন। শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে সব হিন্দু মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে এনে তারা ধর্ষণের হুমকি দিয়েছেন।

একই স্ক্রিন শটের রিভার্স ইমেজ সার্চে দেখা যায়, গত কয়েক বছর ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের দাবি জানিয়ে ছবিটি অসংখ্যবার শেয়ার করা হয়েছে। তবে এই ছবিটি বাংলাদেশের নয়। একই ছবি ২০২৩ সালে ভারতের মণিপুর প্রদেশের একটি গণধর্ষণের ঘটনা দাবি করে শেয়ার করা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, হিন্দু পুরুষরা একজন খ্রিস্টান মেয়েকে অপহরণের পর গণধর্ষণ করছে। আবার ২০২১ সালে একই ছবি ইন্দোনেশিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। সেই সময় দাবি করা হয়েছিল, ইন্দোনেশিয়ান অভিবাসী এক নারী কর্মীকে পাঁচ বাংলাদেশি নাগরিক নির্যাতন ও ধর্ষণ করেছেন।

ভারতীয় ফ্যাক্ট-চেকিং প্ল্যাটফর্ম বুম ২০২১ সালের মে মাসে পূর্ব ব্যাঙ্গালুরুর রামামূর্তি নগরে ভিডিওটির উৎপত্তিস্থল বলে ‍নিশ্চিত করেছিল। যেখানে পুলিশ ২২ বছর বয়সী একজন তরুণীকে লাঞ্ছিত ও ধর্ষণের দায়ে তিন নারীসহ ১২ বাংলাদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছিল।

বাংলাদেশে জাতিগত উত্তেজনা বাড়ানোর লক্ষ্যে কোনও ধরনের সত্যতা যাচাইবাছাই ছাড়াই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টের ছড়াছড়িতে শুধু পুরোনো বা ম্যানিপুলেটেড ছবি কিংবা ভিডিও ব্যবহার করা হয়নি, বরং আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই) ব্যবহার করে তৈরি করা ছবিও এতে ভূমিকা রেখেছে।

এআইয়ের মাধ্যমে তৈরি করা একটি ছবি এক্স ও ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মে ভাইরাল হয়েছে। বিশাল একটি পতাকা স্টান্ডের চারপাশে জড়ো হওয়া বিপুল জনসমাগমকে চিত্রিত করা হয়েছে ছবিতে। যেখানে ঝাপসা হয়ে আসা আকাশের নিচে পতাকা স্টান্ডের ওপরে উঠে বাংলাদেশের পতাকা নাড়ছেন একজন। তার নিচে আরও কয়েকজন ওই স্ট্যান্ডে চড়ে আছেন। আর এর সামনে হাজার হাজার জনতাকে দেখা যায়; যা বড় ধরনের জনসমাগম কিংবা বিক্ষোভের ইঙ্গিত দেয়। এই ছবিকে জাতীয় গর্ব এবং ঐক্যেরও প্রতীক মনে হয়।

ছবিটি দেখলেই সেটি যে এআইয়ের মাধ্যমে তৈরি করা তার কিছু বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। কারণে পতাকা স্ট্যান্ডের আকার বিকৃত করা। এতে মানুষের পায়ের অবস্থান অস্বাভাবিক দেখা যায়। ভিড়ের দৃশ্যও অস্বাভাবিক। এছাড়া পতাকা স্ট্যান্ডে লাগানো কিছু রশির টুকরোও কোনও ধরনের সংযোগ ছাড়াই বাতাসে ভাসছে। এছাড়া এআইয়ের মাধ্যমে তৈরি করা একই ধরনের ছবি ব্যবহার করে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর সহিংসতা যাতে না ঘটে সেই বিষয়ে বার্তা দিয়ে লেখা হয়েছে, ‘‘অল আইজ অন বাংলাদেশ, সেইভ হিন্দুস।’’

এসএস

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *