কাউকে পিটিয়ে মারতে একজন শিক্ষার্থীর কতটুকু মানসিক শক্তি প্রয়োজন? 

কাউকে পিটিয়ে মারতে একজন শিক্ষার্থীর কতটুকু মানসিক শক্তি প্রয়োজন? 

‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ একজন যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হলো, তাও আবার সন্দেহের জেরে! নির্যাতনের আগে

‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ একজন যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হলো, তাও আবার সন্দেহের জেরে! নির্যাতনের আগে তাকে খেতে দেওয়া হয়। নির্মমভাবে পেটানোর পরে তোফাজ্জল মেঝেতে কুঁকড়ে পড়ে আছেন। তাকে ঘিরে কয়েকজন দাঁড়িয়ে, আর সামনে বসে আছে কয়েকজন; কেউ দেখছে, কেউ পেটাচ্ছে। কেউ এসে গ্যাস লাইট দিয়ে পায়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। কেউ এসে তোফাজ্জলের ভ্রু ও চুল কেটে দিচ্ছে। মারা যাওয়ার মতো অবস্থা হয়ে পড়লে, কেউ একজন পানি খাওয়ান, তারপর সে ওঠে বসে। আবারও শুরু হয় পেটানো।

কেউ এসে তোফাজ্জলের আঙ্গুলের মধ্যে স্ট্যাম্প রেখে তার ওপর শরীরের সম্পূর্ণ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তাদের এতটাই নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা, হিংস্রতা ছিল যে শেষ পর্যন্ত মারা যেতে হলো তোফাজ্জল নামে ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ এ যুবককে। যা ঘটল প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

একই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল শিক্ষার্থী পিটিয়ে হত্যা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে। অনেকেই এ দুটি ঘটনাকে ‘মব ভায়োলেন্স’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু সচেতন সমাজের দাবি, এসব ঘটনা কোনোভাবেই ‘মব ভায়োলেন্স’ নয়। জড়িতদের দ্রুতই আইনের আওতায় আনতে হবে। তা-নাহলে এমন ঘটনার পরিসর এবং ব্যাপ্তি আরও বাড়বে। যা একসময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদ গণপিটুনিতে নিহত হন। শুধু এই তিনটি ঘটনাই নয়। গত দুই মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনির শিকার হয়ে অন্তত ৩৩ জন মারা গেছেন। এ অবস্থায় মানুষের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন নিয়ে কথা বলছেন অনেকেই। প্রশ্ন জেগেছে, কেন মানুষ এত হিংস্র হয়ে উঠছে? কেন এমন নিষ্ঠুরতা?

মনোবিজ্ঞানীদের ভাষ্য, মানুষের এমন অমানবিক আচরণ মূলত তার পাশবিক প্রবৃত্তি। এ ধরনের আচরণের পেছনে রয়েছে মানুষের অবদমিত কামনা-বাসনা। অবচেতন মনে মানুষ যা কামনা করে, চেতন মনে সে তার শিক্ষা, সভ্যতা, সামাজিকতা আর নৈতিকতা দিয়ে সেগুলো ঢেকে রাখে। সেই অবদমিত কামনা—সরাসরি পূরণ হয় না বলে হিংস্রতা আর নৃশংসতার মধ্য দিয়ে ঘুরপথে পূরণ করার চেষ্টা চলে। কখনো এই হিংস্রতা সে একাই প্রকাশ করে আবার কখনো প্রকাশ করে যূথবদ্ধভাবে। এই যূথবদ্ধ হিংস্রতার প্রকাশ ‘মবসাইকোলজি’ বা ‘ক্রাউড সাইকোলজির’ বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা। কিন্তু মানুষ নিষ্ঠুর হয়ে জন্মায় না। তার পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন উপাদান তাকে অমানবিক করে, কখনো কখনো হিংস্র করে তোলে। কিছু ক্ষেত্রে অমানবিক আচরণ আসে অসহায়ত্ব-হতাশা থেকে।

সচেতন নাগরিকরা বলছেন, আমরা কেন এত অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছি? আমাদের মধ্য থেকে লোপ পেয়েছে ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, মমতা ও ভালোবাসা। পরস্পরের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সমীহভাব প্রদর্শনে আমরা ভীষণ কৃপণ হয়ে উঠছি। নিজেরাই হয়ে উঠছি অভদ্র, অশোভন, অমার্জিত ও নিষ্ঠুর। তা না হলে এভাবে মানুষকে পিটিয়ে মারার   মতো নিষ্ঠুরতার দেখা মিলত না।

‘মব জাস্টিস’ বলে আসলে কিছুই নেই

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও মনোচিকিৎসক ডা. আহমেদ হেলাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, একদল মানুষ তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এ কাজগুলো করছে। কিন্তু এটি অন্যায়, মব জাস্টিস নামক একটি কথা আমরা প্রায়ই শুনছি। এই মব জাস্টিস বলে আসলে কিছু নেই। এটি আসলে একটি ভায়োলেন্স। তারা সহিংসতা করছে।

তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের মনের ভেতরে দুইটা অংশ থাকে। একটি সব সময় প্রতিহিংসা কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে চায়। আরেকটি যেটা সুপার ইগো সেটা মানুষকে সবসময় ভালোর দিকে টানে। ইগো এবং সুপার ইগোর মাঝখানে ব্যালেন্স করাটাই হচ্ছে ইগো ডিফেন্স মেকানিজম।

কেন এমন হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের পাশবিক প্রবৃদ্ধি যখন খুব মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, তখনই এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটে। আর এটি সংক্রমিত হয় , একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে সংক্রমিত হয়। যেমন গণপিটুনির সময় দেখা যায় যে ব্যক্তি কোনোদিন ঝগড়া পর্যন্ত করেনি সেই ব্যক্তিও সুযোগ পেয়ে দুটো মেরে আসছে। একটা মব সাইকোলজি, মব ভায়োলেন্স চর্চা চলছে। আমাদের সমাজটা বিশ্বাসভিত্তিক সমাজ, আমরা মানুষকে বিচার করি তার আইডিওলজি দিয়ে। আমরা কিন্তু মানুষের তার কর্ম দ্বারা, জ্ঞান দ্বারা মূল্যায়ন করি না। যে কারণে আমাদের নলেজ বেস সোসাইটি নয়। এটি না হওয়ার কারণে আমরা মানুষের প্রতি মানুষের রেসপেক্ট হারিয়ে ফেলেছি।

এই মনোচিকিৎসক বলেন, যারা এসব কাজ করছে তারা মানসিকভাবে দুর্বল। আসলে তাদের মধ্যে সক্ষমতা কম, জ্ঞান কম। যখন মানুষের জ্ঞান কম থাকে, সক্ষমতা, গুণ কম থাকে তখন সে পেশী শক্তির মাধ্যমে নিজের সক্ষমতা প্রকাশ করতে চায়। পেশী শক্তির মাধ্যমে দুর্বলের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। একই সঙ্গে হয়ে দুর্বলের ওপর প্রতিহিংসাপরায়ণ।

এমন ঘটনা প্রতিরোধে করণীয়

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এ সহকারী অধ্যাপক বলেন, এগুলো আসলে একটি সামাজিক অপরাধ। সামাজিক অপরাধকে সামাজিকভাবেই দমন করতে হবে।আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বাহিনীর মাধ্যমে। সে ক্ষেত্রে তাদের জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। পাশাপাশি সরকারকে এ বিষয়ে কোনো নমনীয়তা দেখানো যাবে না। যদি কোনো কারণে নমনীয়তা দেখায় তাহলে তারা সুযোগ পাবে। সেই কাজটি বারবার করবে। তাদের দেখাতে হবে যে এই ধরনের ঘটনা ঘটার পর সরকার কী ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। আর সেটি মানুষের কাছে আরও বেশি করে উপস্থাপন করতে হবে, যা দেখে অন্যরা ভয় পাবে এবং পরবর্তীতে এ ধরনের ঘটনা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে বাধ্য হবে।

তিনি আরও বলেন, অন্যদিকে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এবং পরিবারে মানবিকতার চর্চা করতে হবে। জ্ঞানের চর্চা করতে হবে, অপরের মতবাদকে মূল্যায়ন করার শিক্ষা দিতে হবে। নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে অন্যকে আঘাত করা, হত্যা করা এমন পরিস্থিতি থেকে বিরত রাখতে পারিবারিক শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শুধুমাত্র রেজাল্ট ভিত্তিক মানদণ্ড দিয়ে একজনকে মূল্যায়ন করা যাবে না। আমরা যেন একজন মানুষকে মানবিকভাবে মূল্যায়ন করি। একজনের মধ্যে মানবিকতা কতটুকু আছে, অন্যজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, অন্যজনকে কতটুকু মূল্যায়ন করে এসব সার্বিক বিষয় নিয়ে একজন মানুষকে মূল্যায়ন করতে হবে।

একই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মাদ কামরুজ্জামান মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাটি মানুষকে ভাবাচ্ছে। কিন্তু আসল ঘটনা এখানে নয়। আসল বিষয়টা হচ্ছে ইরেসপন্সিবল বিহেভিয়ার। আমাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই, রেস্পন্সিবিলিটি গ্রো করেনি। রাস্তাঘাটে আমার মোটরসাইকেল কিংবা গাড়ির মাথাটা এগিয়ে দিয়ে রাস্তা আটকে রাখি যেন আমার আগে কেউ যেতে না পারে। আমি একজন মানুষ যেখানে আমি চিন্তা করি কীভাবে আমার জিনিসটাকে আগে করা যায়। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে এই জিনিসগুলো হয়ত ঠিক হতো।

উদাহরণ দিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, আপনি যদি জানতেন আপনার আচরণের জন্য আপনাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, ইউ হ্যাভ টু পে ফর ইওর বিহেভিয়ার, তাহলে আপনি অনেক কিছুই করতেন না, আবার অনেক কিছুই করতেন। আপনি যদি জানতেন পুলিশ বা রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা আছে তারা আপনার জন্য এই কাজটি করে দেবে তাহলে কিন্তু আপনি নিজে এমন করতেন না। যেকোনো কিছু হলে যদি আপনি জানতেন যে এটার ব্যবস্থা রাষ্ট্র গ্রহণ করবে, তাহলে কিন্তু আপনি আইন নিজের হাতে তুলে নিতেন না। যদিও যে ঘটনা ঘটেছে সেটা অন্যায়।  

অধ্যাপক মোহাম্মাদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বাংলাদেশের কোনো মানুষ যদি সিঙ্গাপুরে যায় তাহলে রাস্তার কোথাও থুথু ফেলবে না, আবর্জনা ফেলবে না। আবার ওই ব্যক্তিই যখন বাংলাদেশে আসবে এ কাজগুলো কিন্তু ঠিকই করবে। কারণ সেখানে একটা কিছু করলে তার জন্য তাকে শাস্তির মধ্য দিয়ে যেতে হবে, অথবা তাকে পে করতে হবে। কিন্তু যখন দেখে এটা বাংলাদেশে নেই তখন সে এসে এই কাজটা ঠিকই করছে। তবে এটা একজনে বা একদিনে কখনোই গড়ে উঠবে না। এটা যদি শুরু করা যায় তাহলে ২০ বছর পরে হলেও এটার ফল সবাই ভোগ করতে পারবে।

তিনি বলেন, এখন এমন একটা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, যখন আমরা মনে করছি, যা ইচ্ছা তাই করা যাবে। তার জন্য আমাকে কোনো জবাবদিহিতা করতে হবে না। বর্তমান সরকারের একজন উপদেষ্টা বলেছিলেন, কোনো কিছুই আনপানিশড থাকবে না, যে যা কিছু করছে তার রেসপন্সিবিলিটি তাকেই নিতে হবে। এমন হলে মানুষের কাছে একটি মেসেজ যায়; আমি কী করছি, কী করব তার জন্য কোনো না কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে সরকারের পক্ষ থেকে। তখন কিন্তু কেউ কিছু একটা করতে গেলে হাজার বার ভাববে।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে গত দুই মাসে ৩৩ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে একদিনে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে।

পুলিশ বলছে, সামাজিক অস্থিরতার কারণে গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে। তুচ্ছ কারণে মানুষ সংঘর্ষে জড়িয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে।

এইচআরএসএসের পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে যে সহিংসতা শুরু হয়েছিল তা এখনো চলছে। এখনো মানুষের মধ্যে সহনশীলতা ফিরে আসেনি। সুযোগ পেলেই মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। চলতি বছর ১৫ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ৩৩ জনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে। মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ায় জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

এএসএস/এসকেডি

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *