কাশ্মিরে এবারের ভোটকে যে আলাদা মাত্রা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী

কাশ্মিরে এবারের ভোটকে যে আলাদা মাত্রা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী

গত মে মাসে ভারতে সাধারণ নির্বাচনের সময় দক্ষিণ কাশ্মিরের পুলওয়ামা জেলাতে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীর একজন প্রথম সারির নেতা বুথে গিয়ে ভোট দিচ্ছেন, এই ছবি সারা উপত্যকায় হইচই ফেলে দিয়েছিল।

গত মে মাসে ভারতে সাধারণ নির্বাচনের সময় দক্ষিণ কাশ্মিরের পুলওয়ামা জেলাতে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীর একজন প্রথম সারির নেতা বুথে গিয়ে ভোট দিচ্ছেন, এই ছবি সারা উপত্যকায় হইচই ফেলে দিয়েছিল।

কারণটা আর কিছুই না, যে সংগঠনটি তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতের যেকোনও নির্বাচন বয়কট করে আসছে – সেই জামায়াত অবশেষে দেশের মূল ধারার রাজনীতিতে ফিরতে চাইছে কি না, ওই ছবিটি সেই প্রশ্নই তুলে দিয়েছিল।

সেই নির্বাচনের পর চার মাস পরে এখন দেখা যাচ্ছে, জামায়াতে ইসলামীর নেতারা সরাসরি এখন কাশ্মিরের ভোটে অংশ নিচ্ছেন ও বিভিন্ন আসনে লড়ছেন – আর তাতে পুরো অঞ্চলের ‘রাজনৈতিক ডায়নামিক্স’টাই আমূল বদলে গেছে।

কাগজে-কলমে কাশ্মিরের জামায়াত অবশ্য এখনও একটি নিষিদ্ধ সংগঠন এবং ২৫ আগস্টের মধ্যে সেই নিষেধাজ্ঞা যেহেতু প্রত্যাহার করা হয়নি, তাই তাদের পক্ষে সরাসরি দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া সম্ভবও ছিল না।

তবে জামায়াতের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা বা তাদের পরিবারের সদস্যরা অন্তত দশ-বারোটি আসন থেকে প্রার্থী হয়েছেন, কাশ্মিরের একজন বিতর্কিত ও জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ইঞ্জিনিয়ার রশিদের দল তাদের সমর্থনও করছে।

এই তথাকথিত ‘জামায়াত-ইঞ্জিনিয়ার’ জোট কাশ্মিরের পুরোনো দু’টি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল – আবদুল্লাহ পরিবারের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) ও মুফতি পরিবারের নেতৃত্বাধীন পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (পিডিপি)-কেও পেছনে ফেলে দিতে পারে কি না, সে দিকে সবাই সাগ্রহে তাকিয়ে আছেন।

ন্যাশনাল কনফারেন্স আবার ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ও আসন সমঝোতা করে ভোটে লড়ছে। পিডিপি ও বিজেপি (যারা ২০১৪ সালের পর রফা করে একসঙ্গে সরকার গড়েছিল) অবশ্য এককভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এমনিতে জম্মু ও কাশ্মিরে এবারে বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছে পাক্কা দশ বছরেরও বেশি সময় পরে – এর মধ্যে ওই অঞ্চলটি ভারতের একটি পূর্ণ অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা হারিয়েছে, লাদাখ অঞ্চলটিও রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

পাঁচ বছর আগে সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ করার মধ্যে দিয়ে জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ স্বীকৃতিও বিলুপ্ত করা হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি সরকারের সেই বিতর্কিত পদক্ষেপের পর এই প্রথম ওই অঞ্চলে বিধানসভার ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

আজ (বুধবার) জম্মু ও কাশ্মির বিধানসভার সেই ভোটে প্রথম দফার ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হবে। ৯০ আসনের বিধানসভায় ভোট নেওয়া হবে মোট তিনটি পর্বে, আজকের প্রথম দফার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার ভোটগ্রহণ হবে যথাক্রমে ২৫শে সেপ্টেম্বর ও ১লা অক্টোবর।

এরপর ৪ঠা অক্টোবর পুরো অঞ্চলের ভোটগণনা হবে একই সঙ্গে। জম্মু ও কাশ্মিরের সঙ্গে একই দিনে ভোটগণনা হবে হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচনেরও।

জামায়াত এমন একটি সংগঠন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ-সহ দক্ষিণ এশিয়ার নানা প্রান্তেই যাদের সরব উপস্থিতি আছে। কাশ্মিরের জামায়াত অবশ্য আদর্শগত ও ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তানের জামায়াতেরই বেশি ঘনিষ্ঠ।

শ্রীনগর-ভিত্তিক সাংবাদিক ও গবেষক আকিব জাভেদ জানাচ্ছেন, কাশ্মিরেও জামায়াতের অন্তত পাঁচ হাজার সক্রিয় সদস্য আছেন, যারা ‘ফুলটাইমার’ বা সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে সংগঠনের কাজকর্ম করেন।

বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও ইসলামী চর্চাকেন্দ্র স্থাপনের মধ্যে দিয়ে তারা পুরো উপত্যকা জুড়েই বিরাট নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। তবে জামায়াত অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারি এজেন্সির হানা বা তল্লাশিও খুব নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

এর আগে জামায়াত ১৯৮৭ সালে রাজ্য বিধানসভার ভোটে শেষবারের মতো লড়েছিল। পর্যবেক্ষকরা বলেন, সেই ভোটে তাদের ভালো ফল করার সম্ভাবনা থাকলেও কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের মদতে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করে ফারুক আবদুল্লাহর ন্যাশনাল কনফারেন্সকে জিতিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এর কয়েক মাসের মধ্যেই কাশ্মির উপত্যকা জুড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়। আর জামায়াত নির্বাচন বয়কট করে প্রধানত ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে বেশি মনোযোগ দিতে থাকে।

২০১৯ সালে পুলওয়ামাতে যে সন্ত্রাসী হামলায় ৪০ জনের বেশি ভারতীয় আধা সামরিক সেনা নিহত হয়, তারপর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

সরকারের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, জামায়াতের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসবাদে উসকানি দেওয়ার’ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদে ইন্ধন জোগানোর লক্ষ্যে ‘ভারত-বিরোধী প্রোপাগান্ডায় যুক্ত থাকার’ প্রমাণ মিলেছে বলেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সেই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরও পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানো হয়। এর আগেও আবশ্য ১৯৭৫ ও ১৯৯০ সালে দুইবার জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।

তবে আকিব জাভেদ বলছেন, নির্বাচনের আগে জামায়াতের শীর্ষ নেতারা এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য সরকারের কাছেও গোপনে আবেদন করেছিলেন। ‘জম্মু ও কাশ্মির আপনি পার্টি’র প্রেসিডেন্ট আলতাফ বুখারি এ জন্য মধ্যস্থতা করেছিলেন বলেও জানা যাচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত সেই অনুরোধ রক্ষিত হয়নি, তবে তারপরেও জামায়াত নেতারা অনেকেই বিধানসভা ভোটে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

যে প্রভাবশালী সংগঠনটি প্রায় সাঁইত্রিশ বছর হল কোনও নির্বাচনে অংশ নেয়নি বা পরোক্ষে ভোট বয়কট করেছে – এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে পদে পদে সংঘাতে জড়িয়েছে – তাদের নেতারাই এখন ভোটে লড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে যথারীতি নানা ধরনের প্রশ্ন উঠছে।

কাশ্মিরে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা গুলাম কাদির ওয়ানি অবশ্য রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনও ‘সমঝোতা’র জল্পনা উড়িয়ে দিয়ে দাবি করছেন – ভোটে অংশ নেওয়াটাকে তারা ‘গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ জানানোর একটা পন্থা’ হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

২০১৯ সালে সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর তারা সাংগঠনিক কাজকর্ম চালানোর জন্য একটি পাঁচ সদস্যের ‘প্যানেল’ গঠন করেছিল – যে প্যানেলের প্রধান ছিলেন গুলাম কাদির ওয়ানি।

এই প্যানেলের মূল দায়িত্বই ছিল জামায়াত সম্পর্কে ‘বিভ্রান্তি দূর করা’ এবং রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে তারা যে নির্বাচনের বিরোধী নন, এটা সরকারকে বোঝানো। বস্তুত বিগত সংসদীয় নির্বাচনে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা যে ভোট দিতে যাবেন, সেই সিদ্ধান্তও ছিল এই প্যানেলেরই।

ওয়ানি বলছিলেন, “৩৭০ ধারা বিলোপের পর আমাদের কর্মীদের যত নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে, ততটা বোধহয় আর কাউকেই করতে হয়নি। তাদের জেলে ভরা হয়েছে, সম্পত্তি ক্রোক করা হয়েছে, পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, তারা চাকরি পাননি।”

“এই অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিবাদ জানানোর রাস্তা একটাই – আর সেটা হল মানুষের ভোটে জিতে দেখিয়ে দেওয়া। সে কারণেই আমরা ভোটে লড়তে চেয়েছি”, জানান তিনি।

জামায়াত ‘প্যানেলের’ আর এক প্রভাবশালী সদস্য গুলাম কাদির লোনও এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে জানাচ্ছেন, “আসলে জামায়াত কাশ্মিরের মানুষের জন্য কাজ করতে চাইছে। এখানে সংঘাতের জন্য সবচেয়ে বেশি ভুগছেন কিন্তু সাধারণ মানুষই। কিন্তু এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি – সংগঠন হিসেবে আমরা নিষিদ্ধ, প্রকাশ্যে কাজকর্ম করতে পর্যন্ত পারছি না – ফলে ভোটে জিতে এমএলএ হতে না-পারলে মানুষের জন্য কাজ করাও সম্ভব নয়।”

কাশ্মিরে এবারের নির্বাচনে জামায়াতের ‘পোস্টার বয়’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন ৩৫ বছরের কলিমুল্লাহ লোন, যিনি জামায়াত-সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন ল্যানগেট আসন থেকে। কম্পিউটার সায়েন্সে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী কলিমুল্লাহ লোন কাশ্মিরে জামায়াতের একজন খুব সিনিয়র নেতার সন্তান, এবং দলের তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি।

সেই কলিমুল্লাহ লোন হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “ভোট বয়কট করাটা এক সময় জামায়াতের স্ট্র্যাটেজি ছিল, এ কথা ঠিকই! তবে আমরা এখন সেই যুগ পেরিয়ে এসেছি। জামায়াত-সমর্থিত প্রার্থীদের প্রচারণাতেও তাই জোর দেওয়া হচ্ছে জম্মু ও কাশ্মিরের শান্তি, সমৃদ্ধি আর প্রগতির ওপর।”

পুলওয়ামা আসন থেকে লড়ছেন জামায়াতের নেতা ড. তালাত মজিদ, তিনিও পিডিপি ও ন্যাশনাল কনফারেন্স প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভালো সাড়া পাচ্ছেন। ঠিক যে কারণেই জামায়াত নেতারা এবারে কাশ্মিরের ভোটে লড়ার সিদ্ধান্ত নিন, গোটা রাজ্যের নির্বাচনী ল্যান্ডস্কেপে তা যে একটা আলাদা মাত্রা যোগ করেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং-এর (‘র’) সাবেক প্রধান অমরজিৎ সিং দুলাতও স্বীকার করেছেন, জামায়াত নেতাদের ভোটে লড়াটা অবশ্যই একটা ‘ইতিবাচক লক্ষণ’!

কাশ্মিরে এবারের নির্বাচনে আর একটি বর্ণময় চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন আওয়ামী ইত্তেহাদ পার্টির প্রধান ও শেইখ আবদুল রশিদ, যিনি গোটা রাজ্যে তার পুরোনো পেশার কারণে ‘ইঞ্জিনিয়ার রশিদ’ নামেই বেশি পরিচিত।

২০১৭ সালে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের একটি পুরোনো মামলায় তিনি গত বেশ কয়েক বছর ধরে দিল্লির তিহার জেলে বন্দি ছিলেন। অবশেষে গত সপ্তাহেই তিনি অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পেয়েছেন এবং কাশ্মিরের নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। তবে তার এই জামিন পাওয়া নিয়েও রাজনৈতিক বিতর্ক কম হয়নি।

মাসকয়েক আগে জেলের ভেতরে বন্দি অবস্থাতেই তিনি যেভাবে বারামুলা লোকসভা আসনে জিতে পার্লামেন্টে গেছেন, তা সারা দেশেই তাকে ব্যাপক পরিচিতি দিয়েছে। বারামুলা সংসদীয় আসনে তিনি হারিয়েছিলেন ওমর আবদুল্লাহ ও সাজ্জাদ লোনের মতো রাজনৈতিকভাবে হেভিওয়েট প্রার্থীদের।

অথচ জেলে থাকার কারণে ইঞ্জিনিয়ার রশিদ একদিনের জন্যও নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারেননি, জেলবন্দি পিতার হয়ে তার ছেলেরাই পুরো প্রচারের কাজকর্ম দেখাশুনো করেছিলেন। সেই ইঞ্জিনিয়ার রশিদের দল এবারে নিজেরা রাজ্যের বেশ কতগুলো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে – আর বাদবাকি আসনে তারা সমর্থন করছে জামায়াতের যে নেতারা ভোটে লড়ছেন, তাদের।

জামায়াতের সঙ্গে কেন জোট বেঁধেছেন, তার জন্য জোরালো সাফাই দিতেও কোনও ইতস্তত করছেন না ইঞ্জিনিয়ার রশিদ। জামিন পাওয়ার পরে দেওয়া একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেছেন, “জামায়াতের সঙ্গে আমাদের বহু বিষয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের মধ্যে মিল একটাই – আমরা চাই একটি শান্তিপূর্ণ কাশ্মির!”

কাশ্মিরের সামাজিক ও শিক্ষা খাতে জামায়াতের যে প্রভূত অবদান আছে, সে কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। তিনি বলেছেন, “নাগাল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি আলোচনা চালাতে পারে ও শত শত জঙ্গিকে আত্মসমর্পণ করাতে পারে, তাহলে জামায়াতের সঙ্গে আমরা জোট বাঁধলে অসুবিধা কোথায়?”

তবে ইঞ্জিনিয়ার রশিদ ও জামায়াতের এই ‘জোট’ নির্বাচনে কতটা ভালো ফল করবে, তা নিয়ে পর্যবেক্ষকদের মধ্যে দ্বিমত আছে। রাজ্যের সাবেক পুলিশ প্রধান আলি মোহাম্মদ ওয়াতালির ধারণা, এই জোট অন্তত দশ-বারোটা আসন পেতেই পারে এবং বিধানসভায় যদি কোনও দলই গরিষ্ঠতা না-পায়, সে ক্ষেত্রে বিজেপি জামায়াত ও ইঞ্জিনিয়ার রশিদের দলকে নিয়ে সরকার গড়ার চেষ্টা চালাতে পারে।

সাবেক ‘র’ প্রধান এ এস দুলাত অবশ্য বিশ্বাস করেন, ‘ভ্যালি’ বা কাশ্মির উপত্যকায় জামায়াতের রাজনৈতিক সংগঠন তেমন শক্তিশালী নয় – তাদের পক্ষে দু’তিনটির বেশি আসন পাওয়াটা মুশকিল।

বিশ্লেষক আকিব জাভেদ আবার জানাচ্ছেন, “উত্তর কাশ্মিরের সোপোর আর দক্ষিণের পুলওয়ামা বা শোপিয়ানের মতো এলাকায় জামায়াত আসলে খুবই শক্তিশালী। তবে রাজ্যের প্রতিটি জেলাতেই তাদের ক্যাডার বেস আছে, এখন সেটাকে তারা কতটা ব্যালটে রূপান্তরিত করতে পারে সেটাই দেখার বিষয় হবে।”

অনেক পর্যবেক্ষকই আবার বলছেন, বিজেপি আসলে চাইছে রাজ্যে ‘বিজেপি-বিরোধী ভোট’ যত বেশি ভাগ হয় ততই তাদের জন্য সুবিধা – সে কারণেই জামায়াত বা ইঞ্জিনিয়ার রশিদের মতো শক্তিগুলোকে প্রচ্ছন্ন মদত দেওয়া হচ্ছে!

১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে জম্মু ও কাশ্মিরে এ পর্যন্ত মোট ১২টি বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে। তবে এর মধ্যে বেশিরভাগ নির্বাচনেই সহিংসতা হয়েছে ব্যাপকভাবে, ভোটার উপস্থিতির হারও ছিল নগণ্য।

অতীতে নির্বাচনের সময় সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে বারবার হামলা চালিয়েছে, আবার নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে তারা সাধারণ মানুষকে জোর করে পোলিং বুথে ধরে এনে ভোট দিতে বাধ্য করেছে।

১৯৯০র দশক থেকে কাশ্মিরের বহু রাজনৈতিক কর্মীও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাতে অপহৃত বা খুন হয়েছেন। তবে এবারের নির্বাচনের বড় একটি বৈশিষ্ট্য হল, কাশ্মিরের অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাও এই ভোটে অংশ নিচ্ছেন। ৯০ আসনের বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার লক্ষ্যে লড়ছে মোট ১৩টি প্রধান রাজনৈতিক দল।

‘ভ্যালি’ বা কাশ্মির উপত্যকায় চিরাচরিতভাবে প্রভাব বেশি দুটি আঞ্চলিক দলের – ওমর আবদুল্লাহর ন্যাশনাল কনফারেন্স ও মেহবুবা মুফতির পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির। এরা দুজনেই এক সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।

অন্য দিকে হিন্দু-প্রধান জম্মুতে লড়াইটা মূলত বিজেপি আর কংগ্রেসের মধ্যে। রাজ্য পর্যায়ে এবারে জোট হয়েছে কংগ্রেস আর ন্যাশনাল কনফারেন্সের মধ্যে। নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রায় সব রাজনৈতিক দলই জম্মু ও কাশ্মিরের ‘পূর্ণ অঙ্গরাজ্যে’র মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।

এখন ওই অঞ্চলটি একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে রয়েছে, যেখানে কেন্দ্রের নিযুক্ত একজন গভর্নরই প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে আছেন। বিজেপি ছাড়া সব দল ওই অঞ্চলের বিশেষ স্বীকৃতি ফিরিয়ে দেওয়ার কথাও বলছে – যদিও দেশের কেন্দ্রীয় সরকার একাধিকবার জানিয়ে দিয়েছে তা আর কখনওই হওয়ার নয়!

রাজ্যের স্বশাসনের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি নাকচ করে দিলেও ভারতের শাসক দল বিজেপি অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ‘নির্বাচনের পরে একটা উপযুক্ত সময় দেখে’ জম্মু ও কাশ্মিরের পূর্ণ অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা পুনর্বহাল করা হবে।

তবে কাশ্মিরের বহু সাধারণ মানুষও সম্প্রতি বিবিসিকে বলেছেন, ৩৭০ ধারা ফিরিয়ে আনার কোনও ‘বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা’ আছে বলে তারাও বিশ্বাস করেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাশ্মিরি যুবক বিবিসিকে বলেন, “আমরা এবারে ভোট দিতে যাচ্ছি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ইস্যুগুলোর সমাধান হবে, এই আশায়। সার্বিকভাবে কাশ্মির সংকটের সমাধান বা বিশেষ স্বীকৃতি বিলোপের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই!”

৩৮ বছরের জামির আহমেদ আবার বলছিলেন, “বিশেষ স্বীকৃতি বিলোপ করাটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আমাদের যে প্রতিবাদ, সেটা আমরা ভোট দিয়েই রেজিস্টার করতে চাই!”

যে কোনও কারণেই হোক, এবারের জম্মু ও কাশ্মিরের বিধানসভা ভোটে বিগত নির্বাচনগুলোর তুলনায় অনেক বেশি হারে ভাট পড়বে বলে বহু পর্যবেক্ষকই ধারণা করছেন। মাসচারেক আগে ভারতের সংসদীয় নির্বাচনে জম্মু ও কাশ্মিরের লোকসভা আসনগুলোতে মোট ৫৮.৪৬ শতাংশ ভোট পড়েছিল, যা অনেকে ভাবতেই পারেননি।

এখন বিধানসভা নির্বাচনে ভোট পড়ার হারে সেই রেকর্ডও ভেঙে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, আর সেটা হলে তা হবে জম্মু ও কাশ্মিরের নির্বাচনি চালচিত্রে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। বিবিসি বাংলা

টিএম

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *