বরিশালে আ. লীগ হটিয়ে দখলদারিত্ব, চাঁদা তুলছে বিএনপি

বরিশালে আ. লীগ হটিয়ে দখলদারিত্ব, চাঁদা তুলছে বিএনপি

বরিশাল জেলার হিজলা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক গাফফার তালুকদারকে একমাস আগেও এলাকায় তেমন দেখা যেতো না। ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পালিয়ে যাওয়ার পর দলবল নিয়ে এলাকায় ঢুকে তিনি হামলা, লুটপাট করছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িতে। পাশাপাশি মাছঘাট, গবাদি পশুর খামার, কৃষি খামার দখল ও চাঁদা নির্ধারিত করে দেওয়ার বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে।

বরিশাল জেলার হিজলা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক গাফফার তালুকদারকে একমাস আগেও এলাকায় তেমন দেখা যেতো না। ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পালিয়ে যাওয়ার পর দলবল নিয়ে এলাকায় ঢুকে তিনি হামলা, লুটপাট করছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িতে। পাশাপাশি মাছঘাট, গবাদি পশুর খামার, কৃষি খামার দখল ও চাঁদা নির্ধারিত করে দেওয়ার বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, হিজলা উপজেলার ধুলখোলা ইউনিয়নের মাঝের চরের বাবুল মাতুব্বরের খামারে হামলা চালিয়ে ৫০০ মণ সয়াবিন, ৭০টি মহিষ, ৪০টি গরু, ১০টি ছাগল লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়। মেঘনা নদীর তীরবর্তী ৫০টিরও বেশি মৎস্য অবতরণ ঘাট দখল করে নেন তিনি। পাশাপাশি আড়ত মালিকদের চাঁদা ধার্য করে দিয়েছেন। চাঁদা ধার্য করে দিয়েছেন বিভিন্ন বাজারের দোকান মালিক, ব্যবসায়ী ও আওয়ামীপন্থি গবাদি পশুর খামার মালিকদেরও। তার বেপরোয়া চাঁদাবাজি থেকে রক্ষা পেতে অনেকেই বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকের বাড়িতে গিয়ে চাঁদা না পেয়ে বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করে এসেছেন বলেও সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে।

তবে এসব ঘটনা অস্বীকার করে গফফার তালুকদার দাবি করেছেন, এগুলো তারই ছিল। আওয়ামী লীগ দখলে নিয়ে চালাতো। আওয়ামী লীগ পালিয়ে যাওয়ায় তার দখল তিনি বুঝে নিয়েছেন।

এমন চিত্র কেবল তৃণমূলেই নয়, কেন্দ্রীয় বিএনপির বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট বিলকিস জাহান শিরিনও সরকারি পুকুর ভরাট করে দখলে নিয়েছেন। এ কারণে তার সব পদ স্থগিত করেছে বিএনপি। ১১ আগস্ট দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সাক্ষরিত নোটিশে তার পদ স্থগিত করা হয়। এরপরও থামেননি বিলকিস জাহান। অনুসারীদের নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে এলাকা ছাড়া করার হুমকি, জমি দখলের অভিযোগ এসেছে তার বিরুদ্ধে।

এছাড়াও জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ের বিভিন্ন স্থাপনা, সংগঠনের কার্যালয়, বাস টার্মিনাল, বাজার, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আবাসিক হোটেল দখল করছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দখল হওয়া অধিকাংশ স্থাপনা-প্রতিষ্ঠান এতদিন আওয়ামী লীগের অনুসারীরা নিয়ন্ত্রণ করতো।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের দখলদারিত্ব উচ্ছেদ করে বিএনপি দখলদারিত্ব চালাচ্ছে। এলাকা ভিত্তিক অস্থিরতা, আধিপত্য বিস্তারের কোন্দল দিনে দিনে বাড়ছে।

বানারীপাড়া উপজেলার সন্ধ্যা নদীর খেয়াঘাটটি দখলে নেন উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সবুর হোসেন খান। ওই ঘাটের ইজারাদার ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাওলাদ হোসেন সানার ভাই আরিফুল হক মাসুম। তিনি জানান, ৫ আগস্ট প্রেক্ষাপট বদলে যাওয়ার পরদিন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক লোকজন নিয়ে এসে ঘাট দখলে নিয়ে নেন। আমি এক বছরের জন্য ৯৮ লাখ টাকায় ঘাটটি ইজারা নিয়েছিলাম। ৪-৫ মাসের মধ্যে সেটি দখল করে নিয়েছে।

এলাকায় থাকতে হলে ছাত্রলীগ কর্মী রাশেদ সিকদারের থেকে চাঁদা দাবি করেছিলেন গৌরনদী উপজেলার বার্থী ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি আলামিন তালুকদার। চাঁদার বিষয়টি বনিবনা না হওয়ায় ১৬ আগস্ট রাতে বার্থী বাসস্ট্যান্ডে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন নিহত রাশেদের বড় ভাই রাসেল শিকদার। তার স্ত্রী সুমী আক্তার বলেন, আমাদের দুই বছরের ছেলের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা থেকে বাড়ি এসেছিল রাশেদ। বাড়ি থেকে ছাত্রদল-যুবদলের লোকজন তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে।

গৌরনদী বাস টার্মিনালে দায়িত্বরত কয়েকজন শ্রমিক জানান, বিএনপি নেতা জহির উদ্দিন স্বপনের অনুসারী পরিচয় দিয়ে ৬ আগস্ট সকালে উপজেলার বাস টার্মিনাল, বাজার দখলে নিয়ে চাঁদা তুলছেন বিএনপির কর্মীরা।

বাকেরগঞ্জ উপজেলা বাস স্ট্যান্ড, অটো স্ট্যান্ড দখলে নিয়েছেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নাসির জমাদ্দার। তিনি প্রকাশ্যে জনসভা করে ঘোষণা দিয়েছেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী দেখামাত্র গণধোলাই দিয়ে তাকে খবর দিতে। তিনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কবর রচনা করবেন। এই ঘোষণার দু-দিন পরে জনসমাবেশ করে মিছিলসহকারে সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির নেতা রুহুল আমিন হাওলাদার ও রত্না আমিনের বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র লোকমান হোসেন ডাকুয়া বলেন, ৫ আগস্টের পরে আমরা এলাকাছাড়া। উপজেলায় এমন কিছু নেই যা দখলে নেয়নি বিএনপির লোকজন। শুধু আওয়ামী লীগের কর্তৃত্বে থাকা স্থাপনা, সংগঠনই নয়, ব্যক্তিগত অনেক প্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়েছেন তারা। এলাকায় এলাকায় চাঁদা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

যদিও নাসির উদ্দিন জমাদ্দার বলেছেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গণধোলাই দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছি। কী করবো, বিগত ১৫ বছর ধরে ওদের অত্যাচারে আমরা শেষ।

দখলের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে বলেন, আওয়ামী লীগ পালিয়ে যাওয়ার পরে কেউ কেউ হয়ত পরিচালনা করছে।

বরিশাল মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ রুপাতলী বাস টার্মিনাল ও নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল দখলে নিয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে রূপাতলী বাস টার্মিনালের তিন বছর মেয়াদি কমিটি বাদ দিয়ে নিজেই কমিটি গঠন করেছেন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার।

২৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক নুরুজ্জামান দোলন বলেন, মহানগরের সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার একটি কমিটি গঠন করেছেন। তার নির্দেশনা অনুসারেই রূপাতলী বাস টার্মিনাল পরিচালিত হচ্ছে। আমি বাস মালিক হলেও বিগত ১৭ বছর আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সময়ে টার্মিনালে আসতে পারিনি। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর টার্মিনালে এসেছি। এখন এখানে সবাই বিএনপির নেতাকর্মী। আমাদের আসতে কেউ বাধা দেন না।

তিনি বলেন, সরকার পরিবর্তন হয়েছে। নতুন কমিটি গঠনের কথা শুনেছি। কিন্তু একদিনও বাস টার্মিনালে বাস থেকে চাঁদা তোলা বন্ধ হচ্ছে না। নাতি কালাম নামে একজনের নেতৃত্বে প্রতিটি গাড়ি থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আবুল কালাম ওরফে নাতি কালাম বাস টার্মিনালের শ্রমিক ইউনিয়ন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদারের নামে দখলে নিয়েছেন।

শ্রমিকরা জানিয়েছেন, রূপাতলী বাস মালিক সমিতির ১০১টি বাস থেকে দিনে ২০ থেকে ২২ হাজার চাঁদা তোলা হয়।

রূপাতলী বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সুলতান মাহমুদ বলেন, আমাদের কমিটির বয়স হয়েছে মাত্র ছয় মাস। কমিটির মেয়াদ তিন বছর হলেও বিএনপির সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার নতুন একটি কমিটি করেছেন। ৫ আগস্ট বাস টার্মিনাল বিএনপির লোকজন দখল করে নিয়ে গেছে। আমরা বাস টার্মিনালে উঠতে পারি না।

মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার বলেন, বাস মালিক সমিতি হচ্ছে একটি ব্যবসায়িক সমিতি। ব্যবসা পরিচালনার জন্য এর কাঠামোগত প্রক্রিয়া সবসময়ে সচল রাখতে হয়। কিন্তু আগের কমিটির লোকজন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর কেউ আসছিলেন না। মালিকরা অনেকভাবে যোগাযোগ করেছেন। তারা বলেছেন, তারা আসতে পারবেন না। এ জন্য সাধারণ সভা করে আমাকে কনভেনর করেছে, নতুনভাবে কার্যক্রম শুরু করেছে।

এদিকে নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালেও বাস মালিক গ্রুপের কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। কমিটির সভাপতি যুবলীগ নেতা ওয়াসীম দেওয়ান এবং কিশোর কুমার দে-কে সরিয়ে সেখানে নতুন দুইজন বিএনপিকর্মীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

এছাড়া খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের একটি আবাসিক হোটেল, চারটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার দখলে নিয়েছে ওয়ার্ড বিএনপির নেতা।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বরিশালের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম বলেন, সরকার পরিবর্তন হলেও চরিত্রগত পরিবর্তন কিন্তু হয়নি। একপক্ষ চলে গেছে আরেক পক্ষ এসে সবকিছু দখল করছে। কেউ কাউকে জবরদস্তিমূলক পদত্যাগে বাধ্য করছেন। এভাবে চললে খুব আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। এখন যে মামলাগুলো দেওয়া হচ্ছে সেগুলোও যেন আগের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। সঠিক আইনের প্রয়োগ, বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন না করলে আমরা চলতে পারবো না।

তিনি বলেন, সরকার আইনের প্রয়োগ সঠিকভাবে করতে না পারায় বিভিন্ন স্থানে দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি চলছেই।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/এফআরএস

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *