ড. আলা উদ্দিন
শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য হলো জ্ঞান, দক্ষতা এবং মূল্যবোধ অর্জনের মাধ্যমে সৃজনশীল ও সমৃদ্ধশালী মানবসম্পদ তৈরি করা। এটি সমাজের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং নাগরিকত্বের চেতনা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যার মাধ্যমে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন সম্ভব হয়।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ঐতিহ্য শিক্ষার্থীদের মানসিক ও নৈতিক উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি সুস্থ পরিবেশ হিসেবে বিবেচিত। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই দৃশ্যপট বদলে গেছে, বিশেষত ঢাকাসহ প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। শিক্ষার্থীরা কেন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে, কেন তারা হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে—এই প্রশ্নগুলো আজ আমাদের সমাজে গভীরভাবে আলোড়ন তুলছে।
এ ঘটনা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের হিংস্র কর্মকাণ্ড নতুন কিছু নয়। বিগত শাসনামলে বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড—এসব ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে সহিংসতা এখন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি প্রায় নিয়মিত চিত্রে পরিণত হয়েছে।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ভেতরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা খুন করে। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অবরোধের মধ্যে সূত্রাপুরের বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একটি মিছিল থেকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে বিশ্বজিৎকে হত্যা করা হয়।
কিন্তু, কেন এই হিংস্রতা? শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সহিংস প্রবণতা বেড়ে চলেছে, তার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। এই সমস্যার গভীরে যাওয়ার আগে, আমাদের খতিয়ে দেখা দরকার কেন শিক্ষার্থীরা, যারা সাধারণত যার যার গ্রামে/এলাকায় মেধাবী ও কিশোরদের কাছে দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিচিত, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে হিংস্র হয়ে উঠছে এবং হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
অপরাজনীতি ও ছাত্ররাজনীতি: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের হিংস্রতায় পরিণত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো ছাত্ররাজনীতি এবং এর ভেতরকার অপরাজনীতি। ছাত্ররাজনীতি একসময় আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতীয়তাবোধের প্রতীক ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে তা পরিণত হয়েছে ক্ষমতার লড়াইয়ে।
অধিকাংশ ছাত্র সংগঠন এখন রাজনৈতিক দলগুলোর অধীনস্থ হয়ে ক্ষমতার লোভে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোর মাধ্যমে ক্যাম্পাসগুলোয় প্রভাব বিস্তার করতে চায়, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই এবং প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখার মানসিকতা সৃষ্টি করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও সংস্কৃতি: বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও সংস্কৃতিও শিক্ষার্থীদের আচরণে গভীর প্রভাব ফেলে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শিক্ষার পরিবেশ বলে কিছু নেই। প্রশাসনের দুর্বলতা, অদক্ষতা এবং পক্ষপাতিত্বের কারণে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতো করে আইন হাতে তুলে নিচ্ছে।
প্রশাসনিক পদক্ষেপের অভাব শিক্ষার্থীদের হিংস্র কর্মকাণ্ডে প্ররোচিত করে। একসময়ের মেধাবী ও দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ছাত্ররা এমন একটি সংস্কৃতির মধ্যে প্রবেশ করছে, যেখানে পড়াশোনার চেয়ে ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তারের মনোভাব বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ক্ষমতার অপব্যবহার ও আইনের শাসনের অভাব: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার ও আইনের শাসনের অভাবও শিক্ষার্থীদের হিংস্রতায় পরিণত হওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা শিক্ষার্থীদের অপরাধের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকে এবং তাদের অপরাধ ঢেকে রাখে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা অপরাধ করে পার পেয়ে যায় এবং অপরাধ করতে উৎসাহিত হয়। শিক্ষার্থীরা যখন দেখে যে অপরাধের পরও কোনো শাস্তি হয় না, তখন তারা আরও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
মাদক ও অস্ত্রের সহজলভ্যতা: অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক ও অস্ত্রের সহজলভ্যতাও শিক্ষার্থীদের হিংস্রতায় প্ররোচিত করছে। মাদকাসক্তি এবং অস্ত্রের ব্যবহার শিক্ষার্থীদের সহিংসতায় নিয়োজিত হতে উসকানি দেয়। মাদকের প্রভাব এবং অস্ত্রের উপস্থিতি শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিকভাবে অস্থিতিশীল করে তোলে, যার ফলে তারা সহজেই সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
সামাজিক অবক্ষয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাব: সামাজিক অবক্ষয় এবং নৈতিক মূল্যবোধের অভাবও শিক্ষার্থীদের অপরাধ প্রবণতার পেছনে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। বর্তমান সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের অভাব, পারিবারিক ও সামাজিক সমর্থনের অভাবে শিক্ষার্থীরা সহজেই অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। নৈতিক শিক্ষা এবং মানবিক মূল্যবোধের ঘাটতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে অপরাধমূলক মানসিকতা তৈরি করছে, যা শেষ পর্যন্ত সহিংস কর্মকাণ্ডে রূপ নিচ্ছে।
বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি একসময় ছিল দেশপ্রেম, আদর্শ ও সংগ্রামের প্রতীক। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ—এইসব মহান আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। কিন্তু বর্তমান ছাত্ররাজনীতি সেই গৌরবময় অতীত থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। বর্তমান ছাত্ররাজনীতি কেবলমাত্র ক্ষমতার খেলা, যেখানে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা হয় বড় রাজনৈতিক দলের স্বার্থে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনগুলো ক্যাম্পাসগুলোয় আধিপত্য বিস্তার করে এবং বিরোধীদের ওপর হামলা চালায়।
এই পরিস্থিতিতে ছাত্ররাজনীতির গৌরবময় অতীতের দিকে ফিরে তাকানোর সময় এসেছে। শিক্ষার্থীদের রাজনীতি করতে হবে দেশের কল্যাণের জন্য, নিজের ভবিষ্যতের জন্য নয়। ক্যাম্পাসগুলোয় সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা মুক্ত চিন্তা ও আলোচনা করতে পারবে এবং রাজনীতির মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে হিংস্রতা বন্ধ করার জন্য শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। পড়াশোনা এবং গবেষণার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারে।
প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ও দক্ষ হতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে প্রশাসন যদি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে শিক্ষার্থীরা অপরাধ করতে ভয় পাবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা বজায় থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নৈতিক শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহানুভূতি, সহমর্মিতা এবং মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা প্রদান করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র বিদ্যায় নয়, নৈতিকতার দিক দিয়েও সুশিক্ষিত হতে পারে।
অপরাজনীতি থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্ত করতে হবে। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, যাতে কোনো রাজনৈতিক দল শিক্ষার্থীদের লেজুড়ভিত্তিক অপরাজনীতিতে জড়িয়ে ক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারে। ক্যাম্পাসে লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হিংস্রতা ও হত্যাকাণ্ডের প্রবণতা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক কাঠামোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, ছাত্ররাজনীতির পুনর্গঠন এবং মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ড. আলা উদ্দিন ।। অধ্যাপক ও প্রাক্তন সভাপতি, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়